সুফিদর্শন

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৬, ২০১৮

সুফিবাদ একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। একে তাসাওউফ বলেও অভিহিত করা হয়। এ দর্শনে আত্মাই মুখ্য। এ দর্শনের মূল কথা, আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। সূরা বাকারায় আছে, আল্লাহ তার রূহ আদমের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। এরপরই আদম প্রাণ লাভ করল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, মানুষের আত্মা আল্লাহর আত্মার অংশ। আল্লাহ পরমাত্মা। বিশ্বের সবকিছুই এই পরমাত্মার কাছে ফিরে যাবে। এটা যে শুধু ধর্মের কথা তা নয়, বিজ্ঞানও এটা সমর্থন করে।

সুফিদের মতে, আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। এ সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় আবার একজন মুর্শিদের প্রয়োজন হয়। সেই পথই হলো ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী, সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন এবং অজস্র কারামত প্রদর্শনের অধিকারী হন ।

এ সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার সুফি-দরবেশ এবং কবি-সাহিত্যিকরা তাদের বিভিন্ন কাব্য ও পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে ওলিদের (আল্লাহর বন্ধু) অবলম্বন করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে চারটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে:

এক. বড়পির আব্দুল কাদির জিলানী প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা।
দুই. খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতি প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা।
তিন. খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং
চার. শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানী সারহিন্দী প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।

এছাড়া সুহ্‌রাওয়ার্দিয়া, মাদারীয়া, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়াসহ আরো কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে।

বাংলায় সুফিবাদের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এদেশে সুফিবাদের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফিরা এসে বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রচার করেন। তাদের মৃত্যুর পর কিছু অতিভক্তরা প্রচার করে যে, তারা বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। লেখা হয় নানা রকম গাঁজাখুরি কিস্‌সাকাহিনি, যা ইসলামের সাথে সরাসরি বিরোধপূর্ণ। তারা নাকি আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) এবং সাহাবাদের (রা.) থেকেও বেশি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, এসব কথা লেখা হয়েছে তাদের বইগুলোতে এবং তাতে স্পষ্ট শিরক ও কুফর লক্ষ্য করা যায়।

সুফিদের চালচলন, মানবপ্রেমের ইত্যাদির কারণে এদেশের সাধারণ কিছু মানুষ সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবে ক্রমশ বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রসার লাভ করে। ১২০৪-৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলাদেশ বিজিত হলে ইসলামের শরীআত ও মারিফত উভয় ধারার প্রচার ও প্রসার তীব্রতর হয়। শাসকশ্রেণির সঙ্গে বহু পির-দরবেশ এদেশে আগমন করে নিজস্ব তরিকায় ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।

এরা নিজ রচিত সুফিবাদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব চমৎকারভাবে তুলে ধরে সাধারণ কিছু মূর্খ মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেন, ফলে বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এই মতবাদ প্রসার লাভ করে। সুফিগণ নিজেদের রচিত বিভিন্ন তরিকা এবং মানুষের মাঝে প্রেম-ভ্রাতৃত্ব-সাম্যের মধুর বাণী প্রচার করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের কিছু সাধারণ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হন । এদের মধ্যে কেউ কেউ লোকমুখে কিংবদন্তি-পুরুষে পরিণত হয়েছেন। এদের অনেকের মাযার তৈরি হয়েছে, যেগুলোকে পবিত্র ও পুণ্য স্থান বিবেচনা করা হয়। এমন কি কেউ কেউ নিয়মিত জিয়ারত করে ও পার্থিব কামনা-বাসনায় মানত করে, মাজারে টাকা পয়সা, ফুল , মোমবাতি , আগরবাতি ইত্যাদি দেয়াকে ছওয়াব মনে করে।

এ সুফিবাদ দ্বারা পরবর্তীতে বৈষ্ণবধর্ম, লৌকিক মরমিবাদ, বাউল ধর্মমত ও অন্যান্য ভক্তিবাদও কমবেশি প্রভাবিত হয়। কিছু সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও সুফিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন নদী ও সমুদ্রপথে যাতায়াতের সময় কিছু মাঝিরা বদর পিরের নাম স্মরণ করে। শুধু তাই নয়, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শহরের কিছু যানবাহনে পর্যন্ত বিভিন্ন পির-আউলিয়ার নাম লেখা থাকে। লৌকিক ধারার মুর্শিদি-মারফতি গান, গাজীর গান, গাজীকালু-চম্পাবতী কাব্য ও অন্যান্য মরমীসাহিত্য, মাদার পির ও সোনা পিরের মাগনের গান ইত্যাদি বিভিন্ন পির-দরবেশকে কেন্দ্র করে রচিত।

এভাবে বাংলায় কিছু মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক জীবনের নানা ক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাব দেখা যায় । কিন্তু এই সুফিবাদের সাথে না আছে কোরআনের কোনো সম্পর্ক, না আছে হযরত রাসুলে কারিমের (স.) ৬৩ বছরের জীবনযাত্রার সম্পর্ক, আর না আছে নবির অনুসারীদের জীবনযাত্রার সম্পর্ক।

এ দেশে ইসলামের দাওয়াত প্রথমেই আল্লাহর কিতাব থেকে হইনি, হয়েছে সুফি দরবেশদের আমল-আখলাক, বেশভুষা, সুন্দর ব্যবহার, মাধুর্যমণ্ডিত কাব্যকথা ইত্যাদির মাধ্যমে। সুতরাং এসব বাহ্যিক দিকগুলোয় আকৃষ্ট ও প্রভাবিত হয়ে সাধারণ কিছু মানুষ ক্রমান্বয়ে সুফিবাদে বিশ্বাসী ও ভক্ত হয়ে ওঠে এবং সেটা অন্ধ বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। এরা বিভিন্ন তরিকায় বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং আল কোরআনের শিক্ষা তাদের কাছে গৌণ হয়ে যায়। তাই এসব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ কোরআন আঁকড়ে ধরা এবং রাসুলের (স.) কোরআন বাস্তবায়ন পদ্ধতি দ্বারা জীবনকে গড়ে তোলা।