সুমন প্রবাহন ও তার সুফি কবিতা

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০১৭

যে রাতে সুমন প্রবাহন আত্মহত্যা করল, সেদিন সন্ধেয় আমাকে কল করল। আমি তখন শাহবাগে, আড্ডা দিচ্ছি। ও বলল, ‘তোরে খুব দেখতে ইচ্ছে হইতেছে, বাসায় আয়।’ ও থাকত জোয়ার-সাহারা রোডে। এই জ্যাম ডিঙিয়ে ওখানে যাওয়া মানে... তাই, গেলাম না।
পরদিন সকালে আজিজ মার্কেটের দোতলায় ‘লোক’ এর সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি, সুমনের ছবি সাঁটা। সঙ্গে ওর আত্মহত্যার সংবাদটি। মৃত্যুটি চমকে দিল আমাকে। সে-ই এক সময় ছিল, আজিজ মার্কেট ঘিরে আমাদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি পেরিয়ে যাওয়া। শঠতা আর প্রতারণার জাল প্রতিটা সিঁড়িতে জড়ানো। কেউ কেউ তরতর করে উঠে গেছে সিঁড়ির পর সিঁড়ি। কিন্তু কয়েকজন, জড়োসড়ো হয়ে গেছে। এরা কারা? এরা হয়তো ওইসব হতভাগ্য, যারা তাদের আত্মার চেহারাটা দেখতে পেত। আর বুঝতে পারত, নিজেকে ঠকিয়ে জগৎ-সংসারে খেয়েপরে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় গ্লানি আর নেই।
২০০০ সালের কোনও এক বিকেল আমি আর সুমন কাটাই ফরিদপুরের কোনও এক বিস্তৃত ধানখেতের মাঝখানে, টঙে। বালিশের নিচে এক বাণ্ডিল বিড়ি ছিল। আমরা সে বিড়ি ধ্বংস করি, আর সুমন আমাকে বলতে থাকে, শোন সরফরাজ, বাতাস কী যেন কইতেছে। কত কত শব্দ পৃথিবীতে। পারবি, প্রত্যেকটা শব্দকে আলাদা আলাদা করে ভাগ করতে?
এই ঘোর নিয়েই সুমন ছিল। ওর ছোটভাই তসলিম একদিন আমারে কইল, ভাই, ওরে কোনও দৈনিকে লাগায়া দ্যান। এমনে কাজ করুক। বেতন-টেতন দরকার নাই। কাজ করতে পারলে ও ভালো থাকবে। তো, আমি এক দৈনিকের ফিচার এডিটররে ব্যাপারটা কইলাম। ছাপার জন্যে দিলাম সুমনের কিছু লেখা। সঙ্গে সুমনও ছিল। কিন্তু জনাব সম্পাদক পাশ কাটিয়ে গেলেন। মাসের পর মাস গেল, সুমনের লেখা ছাপা হলো না।
সুমনের মৃত্যুর সপ্তায় দেশের প্রায় বেশিরভাগ দৈনিকের শুক্রবারের একটা আইটেম ছিল সুমন প্রবাহন। মজা যে, জনাব সম্পাদকও এই ফাঁকে সুমনের ওই লেখাগুলো ছেপে দিলেন। বলা চলে, সুমন সংখ্যা। সকলে বেশ প্রশংসা-ট্রশংসা করল।
সুমনের মৃত্যুর পর ‘সুমন প্রবাহন স্মরণ প্রয়াস’ থেকে বের হয় ওর কবিতার বই, পতন ও প্রার্থনা। পাণ্ডুলিপি সুমনই তৈরি করে রেখেছিল। পাণ্ডুলিপি কম্পোজ করতে যেদিন ও আজিজে এলো, ওদিন কম্পোজের টাকা দিয়ে আমরা ‘পিকক’ এ বসে মদ খেয়ে ফেললাম। সুমন বলল, এইডা ভালো হইছে। চল পাগলা, এইবার আমার বাসায়। সারারাত তুই আমার কবিতা বাইছা দিবি।...
মোহতারাম পাঠক, ‘পতন ও প্রার্থনা’র প্রবেশক কবিতাটি আপনার উদ্দেশে...

কেউ নই শূন্য মাতাল

প্রশ্নহীন আমি, পকেটে অসংখ্য ছায়াপথ
চোখে চাঁদের আকাশ, পায়ে তপ্ত কাঁচের কণা, ধূলিস্তর
এখানে ডানা মেলেছে উঁচু-নিচু বধির প্রান্তর
এখানে ছিঁড়ে গেছে বাতাসের কণ্ঠনালী
দূরে- শিলাকঠিন পাহাড়
শুকনো সাগর
অনাহারী ঝর্ণা!

কলঙ্ক! তবু রাজটীকা

ওই যে পৃথিবী নীল গ্রহ আমার
সূর্য! দেখি তোমাকেও
কখনও কন্যা রাশিতে কখনও তুলা, বৃষ-মেঘ-বৃশ্চিকে
দেখি গ্রহণের অক্টোপাসে, তবু
প্রশ্নহীন, পকেটে অসংখ্য ছায়াপথ

ভেসে যাই ছুটে ছুটে
যেন ধূমকেতু-আন্তঃনাক্ষত্রিক।
ক্রমপ্রসারমান ছায়াপথ থেকে
ছায়াপথে। বেড়াই। সাদা কিংবা কালো-
গুহা গহ্বরে,

সে আমার পর্যটন নয়, ধ্যান।
সাদা পাত্রে ধরা আত্মা আমার যেন সবুজ আপেল
ঝলসানো ব্লেডে কেটে দু’ভাগ
দ্বিধা থরো থরো, ভিতরে তবুও
হাজার বছর লাঠিতে ভর সলোমন
কমলা পিরানে প্রাচীন গাছের নিচে মুদ্রিত চোখে-
বিলীন হয়েছে, হবে
জন্মের পর নিরানব্বই ভাগ বীজ
টিকে আছে তার ওপারের একজন।

ভাবি, শূন্য হয়ে এক থেকে আজ ওই সাত-
খণ্ড।
নিজেরই তৈরি যে নরক-ক্লোন, গ্যাসচেম্বার
হাইরাইজ কুঠুরিতে ফেরো
-ক্লান্ত ফাইল তুমি
তোমার গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচে খুঁজে পাই ডাইনোসরের পা, পায়ের ছাপ
নিঃশ্বাস
শীৎকার
শিলাস্তরে কেঁপে ওঠা রণের দামামা।

রেডিওর দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে
এই যে ছুটছি, ছুটে যাচ্ছি আলোর গতিতে গোপন কোয়াসার।
আমাকে পাওনি, পেয়েছে নূরের কণা
অথচ এত অহং দাবানল!
পুড়ে যাচ্ছে মাইল মাইল জনমনভূমি
ধসে পড়ছে পাহাড়, জনপদ

কোনও খোঁজ ব্যর্থ নয়
চোখে রেখো ওই ভস্ম
হে বোধি, বৃক্ষ আমার!
হে প্রকৃত রণ!
ফিরে আসব সংকোচনে
পাটি গোটাতে গোটাতে ছায়াপথে পথে কালো গহ্বর নিয়ে হাতে
ঘূর্ণিপাকে উড়ে উড়ে যাবে বইয়ের খইয়ের পাতা।
তৈরি থেকো শেষ বারুদকাঠি
তৈরি থেকো হে বিরাট ধস!

পাঠক, খেয়াল করুন, আত্মস্থ স্বরূপ কী চমৎকারভাবে সুমন খুলে ধরছে ওর কবিতায়। যা আসলে সুফি কবিতারই ধর্ম। আত্মার মুখোমুখি বসে থাকা ছাড়া, যে অনুভূতি মানুষ অর্জন করতে পারে না। এভাবে বসে থাকতে থাকতে বেঁচে থাকার কোনও মানে সুমন হয়তো আর খুঁজে পায়নি। আর তাই, আত্মহনন করেই সে চেয়েছে নিজেকে মহাশূন্যে লীন করে দিতে। ও বুঝতে পারেনি, পৃথিবীতে জীবনের মানে হচ্ছে, হাসতে হাসতে রক্তাক্ত হও, আর রক্তাক্ত হতে হতে হাসতে থাকো। কিম্বা, সবকিছুর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে বেঁচে থাকা। এ-ও তো সুফি ঘরানার আরেকটি দিক।