সেই স্বপ্ন, যেখানে মানুষের মৃত্যু ঘটে

চঞ্চল আশরাফ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৯

তারপর সে পেছনে সরে দাঁড়ালো। আমার চোখজোড়া মাথার পেছনে নিয়ে তাকে বললাম, ‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।’ ‘অসম্ভব। আমাকে দেখতেই পাচ্ছ না তুমি।’ সে বললো। একটা চেয়ারে আমি বসে ছিলাম, টেবিলের উপর ঝুঁকে, বরফমেশানো মদভর্তি গ্লাস-ধরা ছিল আমার একটা হাত, অন্য হাতে টেবিলের উপর ছড়ানো জলবিন্দুর পরস্পর সংযোগরেখা আঁকছিলাম আমি; যদিও জানতাম সে-সব শুকিয়ে যাবে। এতক্ষণ সে আমার মুখোমুখি বসেছিল; টেবিল থেকে হাত পাঁচেক দূরে, এলোমেলো চুল নিয়ে উন্মাদের মতো প্রগলভ, রাগী আর অসহায়— এমন কি, আমাকে হতচকিত করে সে কখনো-কখনো হয়ে উঠেছিল চিৎকার আর অট্টহাসিপ্রবণ; কাঁধ ঝাঁকিয়ে, বসা থেকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল সে, বারবার; মনে হচ্ছিল ছাদ ছিদ্র করে সে উড়ে যাবে। আমার সামনে ছিল একটা আয়না, গোলাকার, সেদিকে আঙুল উঁচিয়ে তাকে বললাম, ‘ওই যে! এখানেও তো। অবশ্য আমি আছি। তোমার সঙ্গে।’ ‘ওটা তুমি নও। আমিও না। আমার মনে হচ্ছে আয়নার পেছন থেকে কেউ আমাদের দেখে ফেলছে।’ ‘হ্যাঁ।’ শেষ শব্দটা বেশ প্রলম্বিত ছিল, অথবা তার আগেই সে হাসিতে ফেটে পড়ল, পেছন থেকে ধাক্কা দিলো আমাকে, নড়ে উঠল টেবিলে রাখা বোতল ও গ্লাস। আয়নার দিকে তাকিয়ে তার হাসির চাইতেও তীব্র একটা শব্দে মেঝেতে জুতার আঘাত করে বললাম, ‘চুপ!’

তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, মুখের দু’পাশে হাত রেখে সে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ছে মেঝেয়। অল্প আলোতেও চিকচিক করে উঠেছে নাকের ডগায় জমে-ওঠা বিন্দু-বিন্দু ঘাম। আমি চেয়ার থেকে উঠে তার কাছে সরে এলাম। বসে দু’হাতে তাকে ধরে বললাম, ‘এখানে এসেছ কেন?’ ‘তুমি কেন ভুলে গেছ যে, তুমি বলেছিলে আমার জন্যে তোমার দরজা সব সময় খোলা থাকবে।’ এক নিঃশ্বাসে সে বললো। ‘নিঃসঙ্গ মানুষের দরজা সবার জন্যে সব সময় খোলা থাকে।’ আমি বললাম। আমার দু’হাতে ধরা ছিল তার বাহু, ঠাণ্ডা ছিল তার শরীর। উপরের ঠোঁট যেন একটু নড়ল, স্ফীত হলো। বলল, ‘জানো, আমি বেঁচে আছি। আমি যে বেঁচে আছি, এটা আমি জানতামই না। তুমি বেঁচে আছ তো!’ ‘কী-সব যা-তা বলছ। কোনোদিন মরবো না আমি। অবশ্য যদি তুমি আমাকে না খোঁজো।’ আমি বললাম। ‘কালই আমি চলে যাব,’ বলে উঠে দাঁড়ালো সে। আচমকা খুলতে শুরু করলো তার শাড়ির প্যাঁচগুলি, শব্দ করে উঠলো একটা টিকটিকি। নগ্নপ্রায় সে বলল, ‘এখন দেখতে পাচ্ছ? এই হচ্ছি আমি। আরও কিছু বাকি আছে,’ বলে সে কোনো বস্ত্রই আর রাখলো না তার শরীরে। তারপর চেয়ারে-বসা আমার মুখের ওপর এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এবার নিশ্চয়ই আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ না!’ তারপর আত্মরক্ষার কোনো সুযোগ না-দিয়ে আমাকে কিলঘুষি মারতে শুরু করল সে।

চেয়ারে বসে আমি সহ্য করলাম সব, ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখলাম রক্ত, গ্লাসের ভেতর থেকে গলতে-থাকা বরফের টুকরা তুলে ছোঁয়ালাম ঠোঁটে। জ্বলছিল। এরই মধ্যে সে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে কার্পেটের উপর উপুড় হয়ে, প্রশ্বাসে ওঠানামা করছিল তার প্রায়-শাদা পিঠ; আর মাথার কাছে ছড়িয়ে ছিল শাড়ি, সায়া ও ব্লাউজ। চেয়ার থেকে উঠে আমি সেসব একত্র করে তুলে রাখলাম দেয়ালের পাশের চেয়ারটিতে; যাতে সে উঠে দেখতে পায় তার পোশাক, আর বুঝতে পারে যে, সে উলঙ্গ। ভৌতিক আলোয় দেয়াল থেকে দেয়ালে কিছুক্ষণ পায়চারী করে বসে পড়লাম সেই চেয়ারে, গ্লাস তুলে দেখতে থাকলাম অর্ধেক-খাওয়া মদ, তারপর এক ঢোঁকে শূন্য করলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারের বাঁ-পাশে তাকালাম, শুয়ে আছে সে, ফর্সা পিঠের ওঠানামা কমেছে কিছুটা, বেশ শান্ত-সমাহিত মনে হলো তাকে। মনে হলো, বহু আগে কোনো স্বপ্নে ওর মতো কেউ ঠিক এইভাবে শুয়েছিল, আর স্বপ্নের ভেতরই তো এসব সম্ভব! ধোঁয়া উড়ে মিশে যাচ্ছিল শূন্যে, আমার চোখের ওপর দিয়ে, নীলাভ-ধূসর কুণ্ডলি ও রেখায়, যেন আমিও উড়ে যাচ্ছি সেই সঙ্গে, আর মাথাটা বেশ হালকা লাগছিল। চেয়ারে শরীরের সবটুকু ভার রেখে চোখ বুঁজলাম আমি, আর সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম তার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ— মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্যে ঈষৎ আর্তনাদের মতো তা সারা ঘরে প্রবাহিত হলো, আমি তার দিকে তাকালাম না; তাকালাম সেখানে, যেখানে দেখতে পাচ্ছি এক দুপুরে সে মেলে ধরেছে তার ফর্শা পিঠ, তাতে সতেরোটি কালো-কালো গভীর দাগ; দেখে দু’হাতে চোখ ঢেকে বলছি, ‘জামা পরো, প্লিজ!’

তার পিঠের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে, স্থির ছাদপাখায় কিছুক্ষণ চোখ রেখে বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।’ হামাগুড়ি দেবে, এমন ভঙ্গি থেকে সে হঠাৎ আমার কাছে সরে এলো। তার নিঃশ্বাস আমার বুকে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল তখন; আমার দু’হাত ধরে ঝাঁকিয়ে সে উচ্চারণ করল, ‘আমাকে ভালোবেসেছিলে তুমি? আআমাকে; ভাআলোবেসেছিলেএএ; তুউমিই; কেন!’ কেঁদে ফেললো সে, বসে পড়ল, তাকালো আমার চোখের দিকে, তাকিয়ে রইলো—  আমি তার কাছে ছুটে গিয়ে দু’হাতে তার মুখ ধরলাম। সে চোখ বুঁজল, চুমু খেলাম তাকে, ঠোঁটের উপর গড়েয়ে-পড়া তার অশ্রু আমার জিভে লাগলো; ধোঁয়া উড়ছে আমার মুখের ওপর, চোখের ওপর দিয়ে, তখনো; অ্যাশট্রেতে সিগারেট গুঁজে আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম, তাকিয়ে রইলাম তার ফর্শা পিঠের দিকে। মনে হলো, তার পিঠের দাগগুলো জেগে উঠছে, যা সে মুছে ফেলার জন্যে পরম যত্নে ব্যবহার করেছে স্পট কিওর ক্রিম আর ভেষজ বাসান। যেন জেগে না-ওঠে, এমনভাবে আমি হাত রাখলাম মেঝেয় ছড়িয়ে-পড়া তার চুলে; আসলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম চুলের কোনো সাড়াক্ষমতা নেই। পিঠের উপর জড়ো করলাম তার চুলরাশি, যেন ওই জায়গাটুকু দেখতে না-পাই, যেখান থেকে জেগে উঠেছিল সেই দাগগুলি। সেই চেয়ারটায় ফের বসলাম আমি, দুললাম পেছনের পায়া দুটিতে ভর করে।

ওই গোলাকার আয়নায় আমার চোখ পড়ল এক সময়, দেখলাম আমি হাসছি যখন আমার হাসার কথা নয়। একা থাকলেই আমার হাসি পায়। আসলে একাই ছিলাম আমি, ওই প্রতিবিম্বকে আমার সঙ্গী ভেবে মনে হচ্ছিল যে আমার হাসা ঠিক হচ্ছে না! চেয়ারে দুলতে দুলতে আমার মনে হলো প্রতিদিনই তো এমনটি ঘটে, ঠিক এই ঘরটায়, কোনো না কোনো নারী এসে এই আয়নার দিকে পিঠ রেখে আমার মুখোমুখি বসে, বকে যায় আমি শুনি বা না-শুনি; বলে যায় তার স্বপ্নে-পাওয়া হারানো কথাগুলো। অনেক প্রগলভতা, ক্ষোভ, অসহায়তা আর অট্টহাসির পর সে আমার পেছনে সরে আসে, দাঁড়ায়— তখন তাকে আমি দেখতে পাই আমার সঙ্গে, দেয়ালে ঝোলানো আমার সম্মুখের আয়নায় আর বলি, ‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।’ এবং একই উত্তর ভেসে আসে আমার পেছন থেকে, ‘অসম্ভব। আমাকে দেখতেই পাচ্ছ না তুমি।’ মদভর্তি একটা গ্লাস ধরে থাকে আমার হাত, অন্য হাতে টেবিলের উপর ছড়ানো জলবিন্দুর পরম্পর সংযোগরেখা আঁকতে থাকি আমি। চেয়ারে দুলতে দুলতে ভাবলাম, প্রতিদিনকার এই দমবন্ধ-করা স্বপ্ন থেকে মুক্তি দরকার। সেজন্যেই কাল সকাল থেকে নতুন একটা ঘরের খোঁজে পেতে হবে আমাকে। কিন্তু পৃথিবীর সব ঘর তো একই রকম, দেয়াল মাত্র একটাই, আমরা তাকে ভেঙে ভেঙে জোড়া দিই, তাতে কিছু কোণ তৈরি হয়ে যায়। আর আমরা তো কোণ ভালোবাসি; আমাদের অসংখ্য কোণের দরকার, আমাদের একেকটা বাড়ি আসলে অসংখ্য কোণের সমষ্টি। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় অতিশয় তুচ্ছ, নগণ্য। আমাদের শহরে যার বাড়ির যত বেশি কোণ থাকে, সে তত বেশি ভাগ্যবান ও গর্বের যোগ্য। এখানে যারা দুঃখিত ও হতাশাগ্রস্ত, তাদের বেশির ভাগই মনে করে যে কোণশূন্যতাই তাদের দুঃখ ও হতাশার কারণ। এরা যদি কখনো মৃত্যুর কথা ভেবে বসে, তখনই তাকে প্রতিরোধ করার জন্যে কোণের স্বপ্নকে সামনে নিয়ে আসে; এবং তা এতই তীব্র যে, অনেকেই ডোবা পর্যন্ত কিনে ফেলতে চায়, যা  মশা, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদির বাসস্থান বৈ কিছু নয়। তবু কাল সকালে জেগে উঠেই আমার কাজ হবে এমন একটি ঘর খোঁজা— যার কোনো কোণই নেই। ঠিকই খুঁজে পাব আমি। কারণ, এই ঘর ক্রমে ভরে উঠছে এক অসহ্য অনতিক্রমা স্বপ্নে, যার দমবন্ধ-করা ভৌতিক আলোয় পতঙ্গের মতো দেয়াল থেকে দেয়ালে আছড়াতে আছড়াতে গুঁড়, পা ও পাখা হারিয়ে মরতে হবে আমাকে। এর আগে অবশ্য একবার মরেছিলাম আমি, সেই মৃত্যুর জন্যে দায়ী ছিল সেই নারী যাকে প্রথমবারের মতো ভালোবেসেছিলাম, যে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই স্বপ্নে, যেখানে মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেও এসেছিল এক মৃত্যুর কবল থেকে। তার স্বামী তাকে ধর্ষণ করেছিল বাসর রাতেই, বংশ রক্ষার সাধ সে উপেক্ষা করেছিল বলে তার পিঠে চেপে ধরা হয়েছিল জ্বলন্ত সিগারেট।

অসম্ভব সুন্দর ছিল সে; তার মুখের দিকে তাকালে সে বলতো, ‘আমার পিঠের দিকেও এইভাবে তাকাতে হবে তোমাকে। পারবে?’ আমি পারতাম না, কিন্তু আমাকে তাকাতে হতো। তার মুখ স্পর্শ করলে সে বলতো, ‘ঠিক এইভাবে ছুঁতে হবে আমার পিঠ, পারবে না?’ পারতাম না, অথচ ছুঁতে হতো আমাকে। যতবার ছুঁতে গেছি, ততবারই মনে হয়েছে আমার আঙুলের শীর্ষে ও হাতের তালুতে উঠে আসছে সেই ঝলসানো, ফোসকা-পড়া চামড়ার পাতলা আবরণ, পচনের পুঁজ, গন্ধ আর দাগ। আঃ ভালোবাসা! এইসব সহ্য হয়ে এলো ক্রমে, এবং তা পরিণত হলো অভ্যাসে। হঠাৎ একদিন কবরের উপর দাঁড়িয়ে-থাকা আকাশছোঁয়া ইউক্যালিপটাসের লাবণ্য ও স্বাধীনতা দেখে মনে হলো, আমি নেই, কেউ নেই, আমি মরে গেছি। পৃথিবীর প্রান্ত থেকে প্রান্তে আমি খুঁজে বেড়ালাম নিজেকে, সব পথে, মোড়ে, গলিতে ও ঘরে আমি দেখতে পেলাম আমার লাশ; জীবিত আমাকে খুঁজে পেতে, শেষে একটা শূন্য ঘরে প্রবেশ করলাম আমি— এই এখন যেখানে বসে একটা চেয়ারে দুলছি পেছনের পায়ায় ভর করে। আসলে এটা একটা কবর, আর প্রতিরাতেই সে আমার কাছে আসে। কেননা, সে চিনে ফেলেছে আমার ঘর। বুঝতে পারি নি, সেই হত্যাকাণ্ডের পর পলায়নের সময় সে আমার পিছু নিয়েছিল। অথচ আমি নিজেই তাকে কত খুঁজে ফিরেছি, মনে করতে চেয়েছি তার ফোস্কা-পড়া, দাগভরা পিঠ— যার জন্যে স্পট কিউর ক্রিম আর ভেষজ সাবান ব্যবহার করেছে সে।

চোখ বুঁজে চেয়ারে দুলছিলাম আমি। হঠাৎ তার কণ্ঠ শুনতে পেলাম, আমার নাম ধরে ডাকছে সে, একবার, দু’বার, তিনবার— আমার নামটা তার স্বরের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে, যেন উচ্চারণ ও আমার শ্রুতির মাঝখানে বিশাল এক জলাশয় স্থির করে রেখেছে বাতাসকে। সেই উচ্চারণের উৎসের দিকে দেখলাম, সে শুয়ে আছে, ঘুমাচ্ছে, অথবা সে দেখছে তার স্বপ্ন, হয়তো স্বপ্নের ভেতর থেকেই ডেকেছে আমাকে। দুলতে দুলতে, ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম এই ঘুম, এই স্বপ্নের মধ্যে তাকে রেখেই খুব ভোরে, ঝাপসা আলোর ভেতর আমাকে পালাতে হবে, খুঁজতে  হবে এমন একটা ঘর যেখানে কেউ খুঁজেই পাবে না আমাকে। ঠিক তখনই খুব জোরে প্রবাহিত বাতাসের শব্দ শোনা গেল, তীব্র এক শব্দে বন্ধ হয়ে ফের খুলে গেল জানালার পাল্লা দুটি, জেগে উঠলো সে; চেয়ারের দোলা শেষ ক’রে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, বন্ধ করলাম। বৃষ্টি ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। আর সে উঠে দাঁড়িয়ে সেই চেয়ার থেকে তার শরীরে দ্রুততার সঙ্গে তুলে নিয়েছে কাপড়। দেয়াল থেকে দেয়ালে পায়চারি করছিলাম আমি। ঘুমের মধ্যে মানুষ যেভাবে হাঁটে, ঠিক সেরকম পদক্ষেপে সে আমার চেয়ারের কাছে সরে এলো, আর তাকিয়ে রইল স্থবিরস্তব্ধ ছাদপাখার দিকে, নিস্পৃহ ঠাণ্ডা চোখে। বাইরে তখন বাতাসের অমঙ্গলময় শব্দ।
তার সামনে এসে, দাঁড়িয়ে প্যাকেট থেকে ঠোঁটে তুলে নিলাম শেষ সিগারেট— অগ্নিসংযোগের মুহূর্তে সে চাইলো সেটি; ধরিয়ে, একগাল নীলভ-ধূসর ধোঁয়া ছেড়ে তাকে সিগারেটটি দিয়ে বললাম, ‘আসলে আমরা কেউ কাউকে খুঁজেই পাই নি। অথচ আমার প্রতিরাতেই মনে হয়, আমরা মিলিত হচ্ছি।’ নিদ্রায় ফুলে-ওঠা মুখ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে ছাদের দিকে উড়ে যাচ্ছে, আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত অসম্ভব, তাই না?’ স্ফীত হলো তার ঠোঁট, ফাঁক হলো, বলল সে, ‘আমি তো তোমার কাছেই আসছি। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ।’ এমন স্বাভাবিক তার গলা, যেন ঘুম থেকে উঠে সে বসেছে প্রাতঃরাশের টেবিলে; ধোঁয়া উড়ছে, বাইরে বৃষ্টি আর বাতাসের মাতন— ভৌতিক আলোয় আমি দেখলাম তাকে, চোখে সন্দেহ নিয়ে যে সে বুঝে ফেলেছে আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার স্বপ্ন। এতক্ষণ টেবিলে দু’হাত রেখে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ তার পাশে সরে এলাম টেবিল ঘেঁষে, বললাম, ‘আমি তোমাকে ছুঁতে চাই। হ্যাঁ। তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে চাই।’ চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকালো সে। এবার তার চোখ দুটি জ্বলছে, কপালে জেগে উঠেছে ভীতিকর ও লুব্ধক সেই রেখা, বললাম আবার, ‘তোমাকে ছুঁতে চাই আমি।’ তারপর তার স্বর উঠে এলো, ‘কী ছুঁতে চাও আমার পিঠ?’ প্রায় ছিটকে পড়ছিলাম আমি, তবু সামলে নিয়ে তার পেছনে সরে দাঁড়ালাম।

সে বলল, ‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘অসম্ভব। আমাকে দেখতেই পাচ্ছ না তুমি।’ সামনের দেয়ালে ঝোলানো সেই গোলাকার আয়নার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘তুমি কিন্তু আমার পিঠের সামনেই দাঁড়িয়েছ। হ্যাঁ। তোমার সামনে আমার পিঠ।’ অ্যাশট্রেতে সিগারেট গুঁজে সে বলেই চলল, ‘যদি ভালোবেসে, হ্যাঁ ভালোবেসে আমার সারা পিঠে যদি চুমু খেতে পারো, আমরা সেখানেই যেতে পারবো।’ আমি বললাম, ‘কোথায়?’ ‘যেখান থেকে শুরু হয় জীবনের সবকিছু।’ বললো সে। আমার মনে হলো, এই সেই স্বপ্ন, যেখানে মানুষের মৃত্যু ঘটে। তার কাছ থেকে সরে আমি দাঁড়ালাম। ঘুরে, তার দিকে না-তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোত্থেকে এসেছ তুমি?’ আমার পেছন থেকে তার স্বর ভেসে এলো, ‘তুমি জানো।’ আচমকা টেবিলের কাছে এসে আমি তুলে নিলাম শূন্য বোতাল, ছুঁড়ে মারলাম সেই আয়নায়— ভেঙে, ছিটকে পড়ল সব প্রতিবিম্ব, দেয়াল, ঘর, ঝনঝন শব্দে। তারপর কিছুই নেই; বৃষ্টি ও বাতাসের মাতন থেমে গেছে। আর, নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না আমি।