সেলিম আল দীনের ৬৯তম জন্মদিন আজ

স্মরণ

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০১৮

নাট্যকার সেলিম আল দীন রোজ এক প্যাকেট সিগারেট ফুঁকতেন। কখনোবা দেড় প্যাকেট। বেনসন। তখন বেনসনের দাম ছিল সম্ভত সত্তুর টাকা প্যাকেট। আশি টাকাও হতে পারে। ভুলে গেছি। তিনি আমার কাছে টাকা জমা রাখতেন। কখনো দশ হাজার, কখনো কুড়ি হাজার, কখনো তিরিশ হাজার বা তারও বেশি। আমার কাছে টাকা জমা রাখার কথা প্রায়ই ভুলে যেতেন। টাকার জন্য যখন ব্যাংকে বা পোস্ট অফিসে রওনা হতেন, তখন আমাকেই মনে করিয়ে দিতে হতো। রোজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট থেকে সিগারেট আমাকেই কিনতে হতো। এজন্য তিনি আমাকে একশো টাকার একটা নোট দিতেন। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে বাকি টাকা কখনো আমি তাকে ফেরত দিতাম, কখনো নিজের কাছে রেখে দিতাম।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে প্রান্তিক গেটে গেলাম। একটা টুলে পায়ের উপর পা তুলে তিনি সিঙারা খেতে বসলেন। যথারীতি আমাকে একশো টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, ‘যা, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।’ টাকাটা নিয়ে দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে তার হাতে দিলাম। তিনি একটা ধরালেন। টেনে শেষ করে বাসার উদ্দেশে হাঁটা ধরলেন। সুবোধ বালকের মতো আমি তার পিছে পিছে। পথে আমার সঙ্গে একটা কথাও বললেন না। আমি কী একটা বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি উত্তর দিলেন না।

বাসায় পৌঁছে সোফায় বসলেন। আমাকে ডাকলেন। আরেকটি সোফায় আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। আমার চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন, ‘তোকে সিগারেট কেনার জন্য কত টাকা দিয়েছিলাম?’ আমি বললাম, ‘একশো টাকা স্যার।’ বললেন, ‘বাকি টাকা ফেরত দিলি না যে?’ আমি আকাশ থেকে পড়ে পকেট থেকে দ্রুত টাকাটা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। তিনি বললেন, ‘এটা উচিত না। বাকি টাকা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফেরত দেয়া উচিত ছিল তোর।’ আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘স্যার, পরশুদিন গাড়ির তেল কেনার সময় আপনি আমাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পনেরশো টাকা কিন্তু আমি এখনো ফেরত দেইনি।’ এবার তিনি হেসে দিলেন। সেই স্বভাবসুলভ অট্টহাসি। হাসতে হাসতে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘রাগ করিস না বেটা। যা, কাজ কর।’ আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘শুধু তাই নয় স্যার, আপনার দশ হাজার টাকা আমার কাছে জমা আছে।’ চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে তিনি বললেন, ‘বলিস কী!’ আমি আর দাঁড়ালাম না। রুমে ঢুকে কম্পিউটারটা অন করে ‘ধাবমান’-এর প্রুফ দেখা শুরু করলাম।

খানিক পর তিনি পেছনে এসে দাঁড়ালেন। আমি ভুলেও তার দিকে তাকাই না। তিনি বুঝতে পেরেছেন তার আচরণে আমি যে কষ্ট পেয়েছি। খাটের উপর বসলেন তিনি। বললেন, ‘আচ্ছা, বল তো বাংলা সাহিত্যে কোন লেখকের বেতনধারী পিএস ছিল?’ আমি বুঝতে পারি, তিনি এখন যা যা বলবেন, সবই আমার মনের কষ্টটা দূর করার জন্য। বললাম, ‘আমি ঠিক জানি না স্যার।’ বললেন, ‘দূর বোকা! রবীন্দ্রনাথের পিএস ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। আরও একজন লেখকের পিএস আছে, তার নাম বল?’ আমি বললাম, ‘জানি না স্যার।’ বললেন, রবীন্দ্রনাথের অমিয়চ চক্রবর্তী আর সেলিম আল দীনের তুই। হা হা হা।’ তার হাসি দেখে আমিও হাসলাম। তবে আমার হাসি খানিকটা ম্লান। আমার হাসির ম্লানতা তার চোখ এড়াল না। বললেন, ‘শোন, তোর কাছে কত টাকা আছে বললি?’ বললাম, ‘সর্বমোট সাড়ে এগারো হাজার।’ বললেন, ‘দেড় হাজার টাকা তোর। চল, কাল আমরা গাড়ি নিয়ে নয়ারহাট যাই। বাকি টাকা দিয়ে মাছ কিনব। তোর বাসার জন্য একটা ইলিশ কিংবা ছোটখাটো একটা বোয়াল। কী বলিস?’ আমি বললাম, ‘জি আচ্ছা।’

তিনি উঠে তার কাজে চলে গেলেন। প্রায়ই আমাকে রাত ন’টা পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকতে হয়। কাজ না থাকলেও থাকতে হয়। তাকে সঙ্গ দেয়াটাও একটা কাজ বৈকি। রাত ন’টা বাজল। আমার বাসা রেডিও কলোনিতে। আমি বাসায় ফেরার জন্য তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তিনি ফ্রিজ খুলে বিশাল সাইজের দুই টুকরো বোয়াল মাছ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোর বউয়ের জন্য। যা, নিয়ে যা।’ আমি বললাম, ‘কাল তো আমাকে মাছ কিনে দেবেন, এখন তো আর দরকার নেই স্যার। রাত হয়ে গেছে। রান্না করতে ঝামেলা।’ তিনি বললেন, ‘কাল তো কিনবই, আজ এটা নিয়ে যা। কাল ভোর সাড়ে পাঁচটায় চলে আসবি কিন্তু। একদম দেরি করবি না। সকাল সকাল না গেলে বাজারে ভালো মাছ পাওয়া যাবে না।’ আমি বললাম, ‘জি আচ্ছা, চলে আসব স্যার।’

সকাল হলো। আমি ঠিক সাড়ে পাঁচটায় তার বাসায় হাজির। ড্রাইভারও। আমরা রওনা হয়ে গেলাম নয়ারহাটের উদ্দেশে। তিনি মাছ কিনলেন। কয়েকটা বড় বোয়াল মাছের দাম সর্বোচ্চ দু-হাজার টাকা। মাছওয়ালা তাকে দেখেই লম্বা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার জন্য মাত্র তিন হাজার টাকা।’ তিনি দ্বিতীয় কথাটি না বলে মাছগুলো নিয়ে নিলেন। কিনতে কিনতে আট-নয় হাজার টাকার মাছ কিনে ফেললেন। আমি মনে মনে ভাবছি, আমাকে তিনি কোন মাছটা দেবেন সেই কথা। কাল রাতে তো বলেছেন একটা ইলিশ কিংবা একটা বোয়াল কিনে দেবেন। মাছ কেনা শেষ হলো। কিন্তু আমার মাছটি কেনা হলো না। সব মাছ গাড়িতে তুলে বাসার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। ড্রাইভার সব মাছ বুয়ার হাতে তুলে দিল। আমাকে মাছ দেবেন বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বেমালুম ভুলে গেলেন। আমি মনে মনে হাসি। কারণ, আমি জানি, তিনি এমনই। যা দেবেন বলবেন তা দেবেন না। আবার হঠাৎ এমন কিছু দিয়ে বসবেন, যা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।

দুই.
সিগারেট বিষয়ক আরেকটি গল্প। আমি তখন নেভি সিগারেট খাই। আমি যে সিগারেট খাই তিনি জানেন না। বাসায় থাকলে আমি বাথরুমে গিয়ে খাই অথবা নিচে নেমে খাই। একদিন তিনি হঠাৎ বললেন, ‘তুই সিগারেট খাস?’ আমি বললাম, ‘না না স্যার, আমি কখনো সিগারেট খাইনি।’ বললেন, ‘তোর শার্টের পকেটে ওটা কী?’ লেখাবাহুল্য, আমার শার্টের পকেটে নেভি সিগারেটের প্যাকেট। আমি পকেটটা চেপে ধরে বললাম, ‘ওটা নোট বই স্যার। আপনার দৈনন্দিন কাজকর্ম ওটাতে টুকে রাখি।’ বললেন, ‘দেখি, বের কর।’ কী করি! ধরা তো খেয়ে গেলাম। কাঁপা হাতে প্যাকেটটা বের করলাম। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে তিনি বললেন, ‘এটা কী সিগারেট, নেভি? তুই এত স্বস্তা সিগারেট খাস! যক্ষ্মা হয়ে তো মরবি বেটা।’ তিনি চলে গেলেন ভেতরের রুমে। পাঁচশো টাকার একটা নোট এনে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘সেলিম আল দীনের পিএস নেভি সিগারেট খাবে, এটা কোনো কথা! ছিঃ! ছিঃ! ছি! তুই আজ থেকে গোল্ডলিফ খাবি। ওটার প্যাকেট কত যেন? যাই হোক, ওটা খাবি। এই টাকা শেষ হয়ে গেলে আবার আমার কাছ থেকে চেয়ে নিবি।’

সম্ভবত সেদিনই আমি পলমল সিগারেট খাওয়া ধরেছিলাম। নাকি বেনসন? ঠিক মনে নেই। হয়তো কিছুদিন পলমল খেয়েছি। তারপর বেনসন শুরু করি। গুরুর আদেশ বলে কথা! তার দেয়া পাঁচশো টাকা কবেই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সিগারেটের কথা বলে তার কাছে টাকা চাইতে পারি না। চাওয়া কি যায়? এটা কি হতে পারে? শিষ্য সিগারেটের জন্য গুরুর কাছে টাকা চাইবে, গুরু যতই বলুন না কেন, এটা কি আদৌ সম্ভব?

একদিন সকাল ন’টা। স্যার ঘুম থেকে উঠলেন। ঘুম থেকে উঠেই খালি পেটে তিনি সিগারেট খান। কিন্তু সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে পাচ্ছেন না। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কোথাও নেই। ধরলেন কাজের বুয়া আম্বিয়াকে, ‘এই আম্বিয়া, আমার সিগারেট কোথায় গেল রে?’ আম্বিয়া বলল, ‘আমি কী জানি? আমি কি সিগারেট খাই?’ স্যার বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুই সিগারেট খাস। তুই আমার সিগারেট নিয়েছিস। দে, বের কর।’ আম্বিয়া তো কেঁদেকেটে অস্থির। তার কান্নাকাটি দেখে স্যার এবার ধরলেন আমাকে, ‘নিশ্চয়ই তুই নিয়েছিস। তোকে তো আমি গোল্ডলিফ খেতে বলেছিলাম, তুই বেনসন শুরু করলি? তোর সিগারেট শেষ হয়ে গেলে দোকান থেকে কিনে আন। আমার সিগারেট ধরলি কেন?’

আমি যথারীতি আকাশ থেকে পড়ে হন্তদন্ত হয়ে তার সিগারেটের প্যাকেটা খুঁজতে থাকি। ড্রয়ার, টেবিল, সোফা, বারান্দা, খাটের তলা, কোণাকাঞ্চি কিছুই বাদ রাখি না। কোত্থাও নেই। স্যার তার খাটে শুয়ে আছেন আর সিগারেট খেতে না পারার রাগে ফুঁসছেন। আমি বললাম, ‘স্যার, একটু নামুন।’ বললেন, ‘আমি নামব কেন?’ বললাম, ‘কাজ আছে, নামুন প্লিজ।’ বললেন, ‘বেয়াদবি করছিস, না?’ আমি বললাম, ‘বেয়াদবি করলে মাফ করে দেবেন, একটু নামুন প্লিজ।’ তিনি খাট থেকে নেমে দাঁড়ালেন। আমি তার কম্বলটা হাতে নিয়ে ঝাড়া দিলাম। অমনি সিগারেটের প্যাকেটটা মেঝেতে আছড়ে পড়ল। তিনি একটা অট্টহাসি দিয়ে দ্রুত একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। বললেন, ‘বুঝলি, কালরাতে ভূত এসেছিল। প্যাকেটটা ওখানে ভূতে লুকিয়ে রেখেছে। হা হা হা।’ আমার মুখে হাসি নেই। আমি যতটা সম্ভব আরো গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘কিন্তু দোষটা যে আমার উপর চাপালেন, আমি আপনার সিগারেট চুরি করেছি, তার কী হবে স্যার?’ তিনি দ্বিগুণ শব্দে অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘তুই তো আমার বেটা। কী হবে? কিচ্ছু হবে না। হা হা হা।’

এরকম হাজারো স্মৃতি তার সঙ্গে। অনেক স্মৃতি ভুলে গেছি। ভুলে যাচ্ছি। কোনো কোনো স্মৃতি মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। বুদ্বুদের মতো ভেসে ওঠে। ১৮ অগাস্ট তার জন্মদিন। এদিন উপলক্ষে কী লিখব, ভাবছিলাম। মনে পড়ে গেল এ দুটি স্মৃতির কথা। তাই টুকে রাখলাম। এভাবে টুকতে টুকতে একদিন হয়তো একটা বই হয়ে যাবে। হয়তো সেই বইটির নাম রাখব ‘সেলিম আল দীনের সঙ্গে’। ১৮ অগাস্ট তার ৬৯তম জন্মদিন। তিনি নেই। আছে তার স্মৃতি। আমৃত্যু বয়ে বেড়াব এসব স্মৃতি। স্মৃতির স্মরণে কাঁদব। হাসব। হাসি-কান্নার মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমার হৃদয়ে, আমাদের হৃদয়ে। আমৃত্যু।

টুকে রাখা কথামালা
১৮.০৮.২০১৮