অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

সৈকত হাবিবের গুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০১৮

হত্যার আগে

হত্যাকারীরা যখন এলো, আমি ‘রোদ রোদ’ বলে চিৎকার করছিলাম।
প্রকৃত প্রস্তাবে, তখন রাত ছিল না; ছিল দিন, রোদও ছিল, বলল
অন্যরা। কিন্তু আমি শুধু দেখছিলাম অন্ধকার; মগ্ন আঁধারে ছেয়ে
আছে আমাদের বিশ্বগ্রাম। তীব্র চেঁচাচ্ছিলাম আমি, ফেটে যাচ্ছিল
আমার হৃৎপিণ্ড। চারপাশে ভিড় করে এলো মানুষ। তারা ‘পাগল পাগল’
বলে তুলল শোরগোল, কেউ কেউ দিলো সুড়সুড়ি। তাতে নিস্পৃহ
আমি, কেবলই চেঁচাচ্ছি। তিতিবিরক্ত হয়ে অতঃপর এলেন যখন
ভদ্র কতিপয়, শান্ত করতে আমাকে, তাদের বললাম, ‘আমাকে হত্যা
করার আগে আমার অনুভবকে হত্যা করা হোক।’

সঙ্গে সঙ্গে তারা পাথরবৎ স্থির হয়ে গেল।

বাসনামধু

কী সেই বাসনামধু, যা তোমাকে বলে, কবিতাবতী হও মেয়ে,
পাঠ করো কবির হৃদয় আর তোমার ভেতর ফলাও কাব্যবীজ,
তাকে করো বিস্তীর্ণ বৃক্ষ, যেন তা ছড়ায় মাটির ভেতর থেকে
নক্ষত্রের দিকে আর প্রবাহিত হয় অগণন হৃদয়ের ভিতর দিয়ে
দূর কোনো নিখিলে!

হায় এ কেমন দিন, কবিতার বিরুদ্ধে কিংবা কবিতাহীন, আমরা
তবু কবিতার কাছেই চাই পরমশুশ্রুষা, চাই অগ্নিতাড়ানিয়া জল।
মেয়ে, এত আহ্বান দিকে দিকে, এত লোভ বাসনাদরোজা,
তবু সকল দুয়ার রুদ্ধ করে, কেন আমরা শুধু কবিতার কাছেই
ফিরে ফিরে যাই...

 

চে, আশ্চর্য রোদ

আশ্চর্য রোদ আসে মাঝে মাঝে পৃথিবীতে
তুমি সেই রোদ, চে
তোমার অপেক্ষায় পৃথিবী জেগে জেগে থাকে

মৃত্যু স্বপ্নহীন, কিন্তু স্বপ্ন মৃত্যুহীন, তাই
পৃথিবী আজও তোমার স্বপ্নের দিকে হাঁটে

একদিন আসবেই তিমিরবিনাশী দিন
যারা এই স্বপ্ন গেঁথে চলে দিকে-দিগন্তরে

তারা নিহত হয়, অনাহারে-অবিচারে মরে
সে তো কেবলই শরীর, নশ্বর, মেশে
                               ছাই ও ধুলোয়


যতই নিহত হোক চে, তোমার শরীর
পুঁজির প্যান্টির ভেতরেও তোমার স্বপ্ন জাগে
                                            অন্তহীন।

যদিও এখন আঁধার দিকে দিকে ক্রমপ্রসারমাণ
আমাদের বিকেলগুলি তবু স্বপ্ন বয়ে চলে
আমাদের রক্তে আজও তোমার ঘ্রাণ বয়ে চলি

আজ কিংবা আগামীকাল অথবা পরশু
আঁধারহনন হবে কোনো না কোনো একদিন

তাই অনেক-অগণন চের জন্ম হয়
                                    প্রতিদিন

 

কথা বলো, হৃদয়

কথা বলো আমার হৃদয়
তোমার অব্যক্ত গভীর থেকে
কথা বলো কবিতায়
    মানুষের আদিতম ভাষায়
          মন্ত্রসম ছুঁয়ে থাক
               চিরমানবের হৃদয়               

কথা বলো
    গাঢ় সঙ্গীতের ধ্বনি থেকে
যে সুর আসে হৃদয়রক্ত থেকে
  আর ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে

কথা বলো
অশ্রুত ধ্বনি আর শব্দে
বহু যুগের ওপার হতে
সবচে প্রাচীন অথচ
               নবীনতম স্বরে
যেন জাগে মানবহৃদয়
অন্তরের সুরে অন্তরতম
আর তোমার স্বর থেকে
জীবনের প্রাচীন
                নৃত্য জাগে

ক্লান্ত সামাজিক

খুব ক্লান্ত সামাজিক আমি এক

এত আয়োজন দিকে দিকে
               এত করতালি
               শুভেচ্ছা-সৌজন্য
              এত এত করমর্দন
আমি      বড় বেশি সামাজিক আর সমাজমানবিক...

সমাজের কি ক্লান্তি নেই,
কেবলি সে বাড়িয়ে রাখে তার অক্লান্ত হাত
   দিনে ও রাতে             ভোরে ও সন্ধ্যায়
  মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দেয়       স্বর ও কথা
  তারে ও বেতারে
                    শূন্যে ও মহাশূন্যে

তোমাকে সে বলে, ‘এসো, খুব সামাজিক হও,
                   সমাজের ভেতর স্নাত হও, আর...’

কিন্তু আমি তো ক্লান্ত এক সামাজিক, প্রতিদিন
  ব্যক্তিমাত্র হয়ে চাই তোমার স্পর্শনির্জন,
                সমাজকোলাহল থেকে দূরে
   আর থাক মেঘবিকেল, ঘাসবাতাস
 
হায়, আমাদের দুজনসমাজ বড়ো বেশি দূরে দূ  রে থাকে...