স্টিফেন হকিংয়ের শ্রাদ্ধ ও অকৃতজ্ঞ জাতি

জাহিদুর রহিম

প্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০১৮

পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুতে আমার পুরনো দুঃখ আবার উথলে উঠল। আবারও মনে পড়ে গেল, এই মাটিতে জন্মানো শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কথা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ত্ববিদ। বাংলাদেশের জন্য গর্ব উদ্রেককারী এই ক্ষণজন্মা আসন পেতে আছেন বিশ্বময় অনেকের হৃদয়েই। তার সম্পর্কে জানা উচিৎ প্রত্যেক বাংলাদেশির।

স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুতে সামাজিক মিডিয়ায় যেই ঝড় সেখানে তার বিজ্ঞানের অবদানের চেয়ে রাজনৈতিক আর মিডিয়ার প্রভাব কম নয়। আজ পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মিডিয়ার প্রচারণায় হকিংস বিজ্ঞানের আইকনে পরিণত হয়েছেন। হলিউডি সংস্কৃতির প্রভাবে এই বিজ্ঞান ও জ্ঞান চর্চা বিমুখ দেশের লোকজনও হকিংয়ের নাম অন্তত জানে। তার শারীরিক প্রতিবদ্ধকতা এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তাকে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করেছে। করেছে সেই আধুনিকতাবাদী দর্শন যেখানে নাস্তিকতাকে পুঁজিবাদ প্রমট করে। তাই সংশয়বাদী হকিংকে নাস্তিকতার বৈজ্ঞানিক মুখপাত্র করার চেষ্টাও কম হয়নি। আসল কথায় আসি।

হকিংয়ের কেম্ব্রিজের রুমমেট ও তার চেয়ে গবেষণায় এগিয়ে থাকা আমার দেশের সেরা বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের মতো মহান বিজ্ঞানী ও ব্যক্তিত্বের কথা এ দেশের মানুষ ভুলে গেছে। হকিংস যখন ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইম’ লেখেন, এর অনেক আগে জামাল স্যার ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অফ ইউনিভার্স’ লিখেছিলেন। বাংলাদেশের নাম হকিংসসহ পশ্চিমা বিজ্ঞান মহল জানত জামাল নজরুল ইসলামের দেশ হিসেবে। বিজ্ঞানের জগতে জামাল নজরুল ইসলামের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী ড. আব্দুস সালামের কথায়ই বোঝা যায়। তিনি বলেছিলেন, এশিয়ার মধ্যে আমার পরে যদি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নোবেল পুরস্কার পায়, তবে সে হবে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম।

কতজন পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল জয়ী নোবেল বক্তব্যে তার কথা স্মরণ করেছে, তা কি আমরা জানি? প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফ্রিম্যান ডাইসন লিখেছিলেন, আমার ব্যক্তিগত গবেষণার উপর তার লেখা পেপার এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যতের উপর লেখা বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে। বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্যকে আমি বিশেষ প্রশংসার চোখে দেখি। যার কারণে বিশ্বের অনেক লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে তিনি নিজ জন্মভূমিতে ফিরেছেন। এবং তার দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এমন গুণীদের কথা বলে শেষ করতে পারব না।

ড. ইসলাম পঞ্চাশটিরও বেশি গবেষণাপত্র এবং বই লিখে গেছেন। যার অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত জার্নালসমূহে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কেমব্রিজ প্রেস থেকে প্রকাশিত “দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স”। ১৯৮৩ সালে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে হৈ চৈ পড়ে যায়। মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কি হতে পারে, তার ওপর লেখা এই বইটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ, সার্বোক্রোয়েটসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। দ্বিতীয় বই রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি প্রকাশিত হয় কেমব্রিজ প্রেস থেকে ১৯৮৫ সালে। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২), ক্লাসিকাল জেনারেল রিলেটিভিটি। তার লেখা বইগুলো কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন, হার্ভার্ডের মতো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি), ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডনের কিংস কলেজ ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়), সিটি ইউনিভার্সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ টাকা বেতনের লোভনীয় চাকরি, গবেষণার অফুরন্ত সুযোগ, আর নিশ্চিত নিপাট জীবন সব ছেড়েছুড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিধ্যালয়ে তিন হাজার টাকার প্রফেসর পদে এসে যোগ দিলেন। দেশে ফিরে এসে জামাল নজরুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন রিচার্স সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস)। যার মূল লক্ষ্য, মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার জন্য বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা। এ সংস্থাটির আয়োজনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্টিত হয়েছে। যেখানে বেশ কয়েকজন নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীসহ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরা এসেছেন।

কেন ফিরে এসেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে একবার তিনি বলেছিলেন, আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমি এখান থেকে নিতে আসিনি। দিতে এসেছি।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেই দেশে গুণী জন্মায় না। কত দুই আনার লোককে এই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয়। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম অন্য কোনও দেশে জন্মালে রাস্তার মোড়ে তার ভাস্কর্য নির্মাণ করে রাখতো। অথচ এই দেশে অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি, তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাও তার নাম জানে না। কী অকৃতজ্ঞ জাতি!