স্ত্রী প্রডিউসার, ঋত্বিক বানালেন শেষ ছবি

শেষ পর্ব

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০১৮

১১ জানুয়ারি ২০১৭ তে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে সাক্ষাৎকার দেন ৮৪ বছর বয়সী সুরমা ঘটক। কথা বলতে বলতে তিনি যেন উইন্ডমিলের মতো স্মৃতির বাতাসে অতীতে ভেসে গেলেন। ধীরে ধীরে ধুলো সরে গিয়ে সিপিয়ার রিল থেকে রঙিন হয়ে উঠতে লাগল এক শিল্পীর জীবন্ত প্রতিকৃতি। আজ প্রকাশ হচ্ছে শেষ পর্ব। বাঙ্লায়ন করেছেন রিফাহ সানজিদা

 

ডাক্তারদের মতে তিনি  Dual personality syndrome এ ভুগছিলেন?
সুরমা: তিনি খুব বাচ্চামি করতেন। তার বয়স যখন ৬৯, তখন তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তিনি এক মাসের মধ্যে ভালো হয়ে গ্যালেন। একেবারে সুস্থ। এটা সত্যি যে, তাকে একবারই শক থেরাপি দেয়া হয়েছিল। তবে ওটা ওই একবারই। সে খবর আবার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে (কোলকাতা) পৌঁছলে এ থেরাপি বন্ধ করতে সাথে সাথে ওখান থেকে নির্দেশ আসে। এসাইলামে থাকাকালীন উনি একটা নাটক লিখেছিলেন, সেটা সেখানে মঞ্চস্থও করেন। ওখান থেকে বের হবার পর উনি একের পর এক তিনটে ডকুমেন্টারি বানান।
তখন আমার চাকরি হয় সাইথিতে। বাচ্চাদের সাথে নিয়ে আমি সেখানে গেলাম। সেখানে আমি চিঠি পেলাম, তার সাথে বিশ্বজিৎয়ের সখ্য হয়েছে। দুর্বার গতি পদ্মা ডকুমেন্টারিটা তখন বানানো হয়। এরপর দ্রুতই তিনি যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো নিয়ে কাজ শুরু করেন। আমাকে তিনি এ ছবিটার প্রডিউসার বানান। তিনি আমাকে প্রায়ই দেখতে আসতেন। প্রায় একই সময়ে তিতাস একটি নদীর নাম ছবিটার কাজ তার মাথায় আসে। একবার এখানে এসে বললেন, তিনি খুব অসুস্থ থাকেন। বললেন, ‘টিউমার হয়েছে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গ্যাছে।’ শরীরের ওরকম অবস্থায়ও তিনি সবগুলো ছবির কাজ শেষ করতে চাইছিলেন।

আলাদা থাকার সিদ্ধান্তটা নিশ্চয়ই খুব কঠিন ছিল?
সুরমা: আসলে ঋত্বিকের একটা স্থায়ী চাকরি না করার বিষয়টা আমাকে কখনো কষ্ট দেয়নি। আমি কখনোই এ বিষয়ে তাকে কিছু বলিনি। তিনি যখনই রোজগার করতেন, টাকাগুলো আমাকে দিতেন। আমার গয়নাগাটি কখনো ছুঁয়েও দেখেননি। মদপানের বিষয়টাও তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু একটা ঘটনা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। তার ভাই, লোকেশ ঘটক একেবারে আসক্ত ছিলেন অ্যালকোহলে। তিনি বাসায় আসতেন বন্ধুদের নিয়ে মদ খেতে। বাইরের ঘরে আড্ডা চলতো। এসব নিয়ে আমার ঘোর আপত্তি ছিল, কারণ তার শরীরটা একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল। মদপানই ভাঙনের একটা কারণ। তাই আমি সাইথিয়া চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিই।

তিনি মদ কেনার পয়সা চেয়েছেন কখনো?
সুরমা: কখনোই না। তার এত টাকা-পয়সা কখনো না থাকলেও আমাদের ঋণে ডুবতে হয়নি। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, মানিক বন্দোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া আর মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো তিনি যৌবনেই মৃত্যুবরণ করতে চান। আমি চুপ ছিলাম সেকথা শুনে। আমার বাবা একবার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিলে তিনি বললেন, ‘এবার হসপিটাল থেকে বেরোতে পেরেছি। পরেরবার আর বেরোতে পারবো না। একটা পটলের ক্ষেত দেখে পটল তুলবো।’

শেষ দেখা কখন ছিল?
সুরমা: ১৯৭৬ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি সাইথিয়াতে এলেন দেখা করতে। রিতাবনকে সেবার গান শোনাতে বললেন। আমাদের ছেলের কণ্ঠে গান তিনি খুব ভালোবাসতেন। পরদিন সকালে রিতাবনকে আবারও গাইতে বললেন। আমাকে বললেন, ‘লক্ষ্মী, তোমার ছেলে আমাকেও পেরিয়ে যাবে।’ এরপর কিছু টাকা চাইলেন, আমি দিলাম। ফেব্রুয়ারির দিকে আমার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেসময় আমি শুনতে পেলাম, আমার স্বামীও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে হসপিটালে নেয়া হলো। কিন্তু আমার অত দুশ্চিন্তা হলো না। কারণ আমি ভেবেছি উনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে ফিরবেন। ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে সরস্বতী পুজো ছিল। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে আমি বাসায় বসে সেলাই করছিলাম। আর তখন মৃণাল সেন এই ভয়ংকর খবরটা দিলেন যে, ঋত্বিক আর নেই। এতসব স্মৃতি পেছনে ফেলে তিনি চলে গ্যালেন। এক জীবনের জন্য সেসব অনেক অনেক ছিল।