স্বকৃত নোমান প্রকৃতই একজন ঔপন্যাসিক

মহসিন আলী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮

আমি ওনার রাজনটী আখ্যানটি শেষ করলাম। পড়তে বেশি সময় লাগেনি। আখ্যানটির পরিব্যাপ্তি সুদীর্ঘ; তবে ক্লান্ত হইনি সহসা। খেই হারাইনি, বরং তাড়না ছিল শেষ করার। যেহেতু নিজে লেখালিখি করি, তাই সব পুস্তক পরিতৃপ্তি দেয় না। নোমানের বইয়ের পাশাপাশি শেষ করলাম কহলিল জিবরানের দ্য প্রফেট। অবিচ্ছেদ্য লাগেনি বরং একসাথে চলেছি।

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাস সর্বাধুনিক এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শাখা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে প্রথম আধুনিক উপন্যাস রচিত হয়। সম্ভবত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাসের প্রবর্তন হয়। ইংরেজি ভাষায় ড্যানিয়েল ডিফো ও বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস ধারার প্রথম সার্থক রূপকার।

স্বকৃত নোমানের আখ্যানটির সময় আমার কাছে মনে হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে। তবে রচিত হয়েছে একুশ শতকের একটু আগে, সে জন্য এটি একটি স্বার্থক উপন্যাস। লেখক বিচক্ষণ এবং সাহসী লেখনির অধিকর্তা। গল্পের নায়িকার নাম নূরজাহান, বাস্তবে। তবে আখ্যানে নায়িকার নাম গুলনাহার, এখানে লেখক যথেষ্ট মেধার পরিচয় দিয়েছেন।

শওকত আলী যেমন প্রাকৃতজনের কথা বলেছেন, জহির রায়হান বলেছেন ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে অবহেলিত মানবের কথা, অদ্বৈত বলেছেন তিতাসের পাড়ের কথা; মানিক বলেছেন পদ্মাপাড়ের কথা, স্বকৃত নোমান বলতে চেয়েছেন তেমনই কথা।

গুলনাহার রাজদরবার হতে বিতাড়িত, সে আশ্রয় খুঁজছে। পথ চলতে চলতে রাত গভীর হলে সে একটা মন্দিরে আশ্রয় নেয়। তবুও তার ভয়, যদি পুরোহিত তার সব কেড়ে নেয়। সে ভাবে, তার কি আছে? চরিত্রের পবিত্রতা নোমান এখানে দেখিয়ে দিলেন, পাশাপাশি ধর্মের খেলাটাও।

বর্ণনা সাবলীল, মাঠ পেরোতেই দ্বিতীয় প্রহরে গড়াল রাত। দূরে চাঁদের আলোয় বালুচর চিকচিক করে। সুধাবতীর জল প্রবাহের মৃদু শব্দ শোনা যায়। অমরপুর কি তারও পুবে? পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে... এই নদী সমুদ্র কন্যা মেঘনায় মিশেছে।

কিছু কিছু জায়গায় লেখক গুলনাহারের কষ্টের গান গেয়েছেন:
কাঁদিয় রজনী পোহায়
আঁখিজলে হৃদ ভেসে যায়
মনের আগুন তবু নিভে না যে তার।

গুলনাহারের মা শিশু বয়সে অভাবের তাড়নায় তাকে বিক্রি করে দেয়। সে হতে কয়েক ধাপে হাতবদল হয়ে রাজদরবারে রাজনটী রূপে ঠিকানা হয়। তার রূপের বর্ণনা লেখক সামান্য দিয়েছেন এভাবে,  নাচাওয়ালির মোহময়ী চোখ, ক্ষীণ কটি, প্রমত্ত বুক। একসময় সামান্য ভুলের কারণে রাজদরবার হতে সে বিতাড়িত হয়। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে নিজের জন্মভিটায় গিয়ে পৌঁছায়।

লেখক বলেছেন, শরীরে যৌবন আছে বটে কিন্তু তা তো অতি ব্যবহারে জীর্ণ। বসতভিটায় কেউ নেই। ভাবে, ফিরে যাবে। আবার ভাবে, গিয়ে কি করবে, কার কাছে গিয়ে বিক্রি করবে এই শরীর? গুলনাহার অনেক কষ্টে বাড়ির উঠোনে আসে। পরিত্যক্ত বাড়িটি কি কেউ দখল করল? আরও অনেক প্রশ্ন... খুব কান্না পায় গুলনাহারের। মরাগাছের গুড়িতে বসে অনেকক্ষণ কাঁদে। এভাবে আখ্যান এগোতে থাকে...

জীবনের সকল পাপ হতে মোচনের জন্য গুলনাহার নিজ খরচে একটা মসজিদ নির্মাণ করে। মহল্লার লোক যখন জানতে পারে সে একজন রাজনটী তখন তাকে বিতাড়িত করা হয় গ্রাম হতে। আখ্যানের শেষে গুলনাহারের খারাপ অবস্থার কথা লেখক বলেছেন এভাবে, জোয়ার-ভাটায় সকাল-বিকাল যে নদীতে পাড় ধসে, ভয়াল বন্যাকে তার কী ভয়! নিজ জন্মভূমি হতে বিতাড়িত হয়ে গুলনাহার অজানায় পাড়ি দেয়।

লেখকের বর্ণনা: উত্তাল স্রোতে ঝুরঝুর শব্দে ভেঙে পড়বে সুধাবতীর বাঁধ। ভেঙে ভেঙে ভাঙন হয়তো মসজিদ পর্যন্ত যাবে। মসজিদ হয়তো স্রোতে তোড়ে ভেসে যাবে। গুলনাহার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে হাঁটতে শুরু করে। কোথায় যাবে সে? মনের আয়নার উঁকি দেয় পানামা শহর, সে যে বহু দূরের পথ। একজন রাজনটীর জীবন নিয়ে আখ্যানটি রচিত। প্রথমত আমি একজন পাঠক হিসেবে বইটি শুধুই পড়িনি, অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। বইটি পড়তে গিয়ে বারবার নোমানকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। একজন পাঠক যখন কোনও লেখকের বই পড়ে পুলকিত হয়, শিহরিত হয়, তখন সে লেখককে হৃদয়পটে স্থান দেয়। স্বকৃত নোমান আসলেই হৃদয়পটে স্থান পাওয়ার যোগ্য।

একুশে বইমেলা ২০১৮