স্বজ্ঞা

রাজশ্রী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮

মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কতগুলি যুগান্তকারী ঘটনা চোখে পড়ে। হঠাৎ একটা কিছু আবিষ্কার হলো এবং এর ফলে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। চাকা আবিষ্কারের কথাই ধরা যাক। ওই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের একটা মোড় ফিরে গেল। গোড়ার দিকে ঠিক কীভাবে এসব আবিষ্কার সম্ভব হয়েছিল, তা আজও অজ্ঞাত।

কিন্তু ওই প্রাথমিক আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে বড় বড় জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে এবং আবিষ্কারক হিসাবে বহু মানুষ বিখ্যাত হয়েছেন। আমরা অনেকেই গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখেছি। আপেল পাকলে মাটিতে পড়ে যায়, এটি অতি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সামান্য এ ঘটনাই কেন নিউটনের চোখে অসাধারণ বলে প্রতিভাত হলো?

তিনি মনে মনে নিজেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন, আপেল মাটিতে পড়ে কেন? কিছু কি তাদের নিচের দিকে টানে বা আকর্ষণ করে? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনের মধ্যে উত্তরটি বিদ্যুতের মতো খেলে গেল। মনের মধ্যে এরকম হঠাৎ আলোর ঝলকানিকেই বলে Intuition বা স্বজ্ঞা।

অধিকাংশ আবিষ্কারই সম্ভব হয়েছে এ জাতীয় স্বজ্ঞার মাধ্যমে। স্বজ্ঞা কি? না, স্বজ্ঞা আর পাণ্ডিত্য এক জিনিস নয়। পাণ্ডিত্য দরকার ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে দরকার আরও কিছুর। মনের গভীর থেকে সত্য যখন আপনা-আপনিই ভেসে ওঠে তখন তাকে স্বজ্ঞা বলে। প্রশ্নের উত্তর প্রথম থেকেই ব্যক্তির মনের গভীরে প্রোথিত থাকে। কিন্তু তা আমাদের নজরে পড়ে না।

স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজজী বলেছেন, ‘মনকে যেই ধ্যানের দ্বারা একমুখি করা হলো, অমনি উত্তরটি চেতনার স্তরে ভেসে উঠল।’ আসলে আপন শুদ্ধ মনই আমাদের বন্ধু। কারণ যা কিছু শুদ্ধ, পবিত্র সৎমুখি/একমুখী তাতেই ব্রহ্মশক্তি স্বয়ং প্রকাশ হয়ে ওঠেন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো। তাই সাধনার দ্বারা আপন মনকে, বুদ্ধিকে পরিশীলিত ও শুদ্ধ করে তুলতে হবে। ডুব মারতে হবে, ঝাপ দিতে হবে বিবেক-বৈরাগ্য হলদি মেখে। যেমন গানে বলা হয়ছে:

ডুব ডুব রূপ সাগরে আমার মন
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবিরে প্রেম রত্নধন।

হ্যাঁ,  একাগ্র হয়ে ডুব মারলেই সকল প্রশ্নের সমাধান অন্তর থেকেই উঠে আসবে এবং আসে, তাকেই বলে স্বধ্যা বা intuition। তাই তো ঠাকুর বলেছেন, যা কিছু শুদ্ধ, যা কিছু পবিত্র তাই ভগবান কারণ ভগবান ভিন্ন অন্য কিছু শুদ্ধ নাই। আর শুদ্ধ মনে যা উঠবে সেটা তাঁরই বাণী। শুদ্ধ মনও যা শুদ্ধ বুদ্ধিও তা, শুদ্ধ আত্মাও তা। কেননা তিনি ছাড়া শুদ্ধ আর কিছুই নেই। তাই ধ্যানের গভীরে শুদ্ধ মনে ব্রহ্মশক্তির স্বয়ং প্রকাশই হলো হঠাৎ আলোর ঝলকানির তীব্র নির্ঘোষ ‘স্বজ্ঞা’।

যারা ঋষি তারাই সত্যের দ্রষ্টা বা আবিষ্কারক এবং তাদের ওই একাগ্র যোগযুক্ত মনের মধ্য দিয়াই intuition রূপে যা প্রতিভাত হয় তা ব্রহ্মবাণী, যা বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা করে কল্যাণকারী মন্ত্র। তাই মন আমার গভীরে যা, উপরে উপরে ভাসিস না, সেখানেই আছে সকল সমস্যার সমাধান। পরম শান্তি।