স্বপ্ন এবং স্বপ্ন পূরণের কিস্‌সা

ওমর সাঈদ

প্রকাশিত : জুন ১৪, ২০১৮

সাহিত্যের ছোটপত্রিকা করার লোভটা জন্মেছিল অনেক আগেই, এরপর বিড জেনারেশন কিম্বা হাংরি জেনারেশনসহ দেশ-বিদেশের ছোটকাগজগুলোর ইতিহাস শুনি, সাহিত্যের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ি, তখন থেকে উৎসাহটা আরও বাড়তে থাকে। সেই আগ্রহ থেকে একবার বই মেলায় লিটলম্যাগ কর্নারে একটা পত্রিকার স্টলে চাকরিও জুটিয়ে ফেলেছিলাম। সেইখানে কাজ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম, সাহিত্য পত্রিকাগুলোর ভিতরকার দৃশ্য। যা দেখে আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়ি।

এরপর বন্ধু রূপম ও সালাহউদ্দিন  মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, কিছুটা পড়া এবং লেখালেখি অভ্যাসটা যেহেতু আছে তাই আমরাও ছোটকাগজ বের করবো। নাম ঠিক করেছিলাম, বেয়োনেট। আমাদের সাথে আরো কয়েকজন বন্ধু যোগ দিল। সবকিছু ঠিকঠাক ই চলছিল... আমরা সবাই তখন বেকার। এরপরও যার যতটুকু সম্ভব ঘর থেকে এনে মোবাইল বেচে আমরা শুরু করেছিলাম। আমাদের প্রথম সম্পাদনা এবং প্রকাশিত লেখা, একটা উন্মাদনা কাজ করছিলো আমাদের মধ্যে। আমার মনে আছে, বেয়োনেট প্রিন্টে গিয়েছিল। সবশেষে একরাশ হতাশা আর দারিদ্যের ধোঁয়ায় আমাদের তরী তীরেই ডুবিয়ে দিয়েছিল। জানলে অবাক হবেন, বিশ্বাস করবেন না হয়তো অনেকেই... ২০১৫ সালে মাত্র দু’হাজার টাকার জন্য আমরা প্রেস থেকে আমাদের পত্রিকাটা রিলিজ করতে পারিনি। অনেকে তা জেনে দাঁত কেলিয়েছিল। যাই হোক, আমরা এখনো স্বপ্ন দেখি, বেয়োনেট বের হবে।

‘ছাড়পত্র’ একটি অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা। এর মূল শ্লোগান, প্রথা ভেঙে টুকরো করে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের গাড়লমার্কা প্রচলিত নিয়ম-নীতি ভেঙে নতুন কিছু প্রকাশ করে মানুষের মাঝে তুলে ধরার প্রয়াস থেকেই এর সৃষ্টি। বেয়োনেট- এ আমরা যারা ছিলাম তার মধ্যে রূপম ছাড়পত্রে প্রথম থেকেই রয়েছে। আমি যোগ দিলাম জানুয়ারিতে। ছাড়পত্র পরিবারে রয়েছে সুন্দর এবং মেধাবী কিছু কর্মী। পরিবারের সদস্যরা হলেন, মারিয়া সালাম, আবু তাহের সরফরাজ, রিফাত বিন সালাম রূপম, রিফাহ সানজিদা, সৈয়দ রিয়াদ হোসেন আকাশ, নাঈমুল হাসান হিমেল আর আমি। বলা চলে, মারিয়া আপা ও সরফরাজ ভাই ছাড়া আমরা সবাই আসলে শিক্ষানবীশ। এরপরও আমাদের চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। আমাদের  সকলের সম্মিলিত চিন্তা-ভাবনায় ধীরে ধীরে এগুচ্ছে ছাড়পত্র। এ যাত্রাপথে হঠাৎ করেই যুক্ত হলো নতুন চিন্তা।

মারিয়া আপা একটা পুরনো ভূত এনে চাপিয়ে দিলেন আমাদের মাথায়। ছাড়পত্রের প্রিন্ট ভার্সন বের করতে হবে। যা ধরা যাবে ছোঁয়া যাবে। কারো পড়ার টেবিলের কিছুটা জায়গা দখল করে নেবে। তো বৈশাখী সংখ্যায় সবাই মিলে কাজে লেগে পড়লাম। বেয়োনেট প্রকাশ করতে গিয়ে এবং ছাড়পত্রে যোগ দেয়ার আগে কিছুদিন একটা প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি করেছিলাম। ফলে কিছুটা অভিজ্ঞতা আমার ছিল। একটা বই অথবা পত্রিকা কী করে কয় ধাপ পেরিয়ে ধরা ছোঁয়া এবং স্থান দখলের উপযুক্ত হয়, তা জানা ছিল। কিন্তু ছাড়পত্রের প্রিন্ট ভার্সনের কাজ করতে যেয়ে বুঝলাম, এখনো অনেকটাই অনভিজ্ঞ রয়ে গেছি। এই অনভিজ্ঞতা এবং সময় স্বল্পতার কারণে আমরা ছাড়পত্রের বৈশাখী সংখ্যা বের করতে পারলাম না। হায় ব্যর্থতা! কিন্তু হতাশ হলাম না। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, যেভাবেই হোক ঈদ সংখ্যা র করতেই হবে। ইমতিয়াজ আহমেদ আসিফ ভাই, আমি আর রূপম মিলে টানা আট-দশদিন এবং তিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ডিজাইনিংয়ের কাজ শেষ করলাম। এরপর যা ঘটলো তা দেখে হার্ট স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পালা আমার আর রূপমের।

ফর্মা সাজাতে গিয়ে দেখি, টেকনিক্যাল প্রব্লেমের কারণে সব ওলট-পালট। অইদিকে ডিজাইনার আসিফ ভাই ঈদ উপলক্ষে চলে গেছে রংপুর। একবার মনে হয়েছিল, এ যাত্রায়ও আমরা ফেইল। মান ইজ্জত আর কিছুই রইলো না... ঠিক এ সময় সবচেয়ে বড় সাহায্য করেছে রিপন ভাই এবং রুহুল মামা। তারা তিন-চার ঘণ্টায় সব ঠিকঠাক করে দিলেন। ভাগ্য ভালো যে, আমরা ইন্ডিজাইন নামক সফটওয়্যারে ডিজাইনটা করেছিলাম। নইলে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই রাতেই প্রেসে দিয়েও শান্তি পাচ্ছিলাম না। অবশেষে ১২ জুন রাতে আমরা হাতে পেলাম আমাদের প্রথম প্রকাশিত ধরা যায় ছোঁয়া যায় স্থান দখল করে এমন একটা জলজ্যান্ত আট ফর্মার ম্যাগাজিন। কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই একটা কপি বাইন্ডিং এবং কাটিং করে আমাদের হাতে দিয়ে চিন্তামুক্ত করেছিল প্রেস মালিক সোলেমান ভাই।

আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। শেষের কয়েকদিন আমি ও রূপম ঘুমিয়েছি সর্বোচ্চ দু’তিন ঘণ্টা। এর মধ্যে একদিন ঢাকা মেডিকেলে ব্লাড দিয়ে ফেরার পথে রাস্তায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। আমি জানি না, কপিটা হাতে পাওয়ার পরে রূপমের অনুভূতি কি। তবে তার চোখেমুখে আনন্দ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতোই লাগছিল। আর আমার যত ক্লান্তি হঠাৎ করেই উড়ে গেল।

ছাড়পত্র পরিবারের সকলের সহযোগিতায় এটা আমার প্রথম সফল সম্পাদনা। রূপম ভাই না থাকলে হয়তো এটা সম্ভব ছিল না। এতকিছু একা পারতাম না। রূপম যদিও একটু আলসে প্রকৃতির, আর সারাদিন খালি ফোন টেপে। তবে এই কাজটাতে সময় দিতে একটু কার্পণ্য করেনি। সবসময়ে পরামর্শ-নির্দেশনা এবং যে কোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিয়েছেন সম্পাদক মারিয়া আপা। প্রকাশনার কাজে সার্বিক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমানুল্লাহ্‌ খান স্যারের প্রতি। আজকের সময়ের মানুষ হয়েও যিনি অতিশয় সজ্জন একজন ব্যক্তি।

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা রইলো। ছাড়পত্র ঈদ সংখ্যা এখন বাজারে। কপির জন্য যোগাযোগ করুন ছাড়পত্রের ঠিকানায়।