স্মৃতিকথা: বাইশ রশি জমিদার বাড়ি

কাজল শাহনেওয়াজ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৯

আমার তখন ৪-৫ বছর বয়স, ১৯৬৫-৬৬ সন? গভীর অতল থেকে যে স্মৃতি মনে করা যায়, তা হচ্ছে সদরপুরের স্মৃতি। পুরানো জমিদার বাড়ি। এক অংশে তখনো ওদের প্রাক্তন জমিদার থাকেন, আরেক অংশে সরকারি অফিস ও কর্মকর্তাদের বাস।

২২ রশি বাবুদের বাড়িতে আব্বার অফিস ও আমাদের বাসস্থান। মনে হয় ১৯৬৫ সনের পর স্থানীয় জমিদারের অর্ধেক পরিত্যক্ত বাড়ি হিসাবে সরকারের দখলে আসে। সেখানে অস্থায়ী অফিস হয়। আরো কয়েকটা পরিবারের সাথে আমরা থাকতাম দোতলা সেই বাড়িতে। বাড়িটার পিছনে বড় বড় গাছঅলা বাগান।

বাড়ির পিছনে বাগান আর দুই ঘাটঅলা এক দীঘি। মেয়ে আর পুরুষের জন্য আলাদা ঘাটঅলা দীঘি আর দেখি নাই। বউঘাটলা মেয়েদের জন্য, পানিতেই তিনদেয়াল দেয়া, মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা, আবরু রক্ষার জন্য। ভিতরে কেমন ভয় ভয়। জমিদারদের বাড়ির ল্যান্ডস্কেপে সর্বদাই পুকুরের ছড়াছড়ি। বউঘাটলায় মেয়েরা স্বাচ্ছন্দে সাঁতরাইতে যায়। কত দুপুর যে আমরা মিছামিছি ঘুরে বেড়াতাম সেই বনে, কিশোরী এক গৃহকর্মীর সাথে। ঘুঘু ডাকতো। আর দূর থেকে দেখতাম বউ ঘাটলার আচ্ছাদন দেয়া ঘাটে কারা যেন গোসল করতো।

দোতলা বাড়িটার পিছনেই একটা একতলা। তাতে বাইরে থেকে একটা সিঁড়ি। ছাদে ওঠা যায়। দুপুরের পর মা যখন ঘুমাতো, গুটিগুটি পায়ে সেই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যেতাম। একটা বড় জামরুল গাছের ছায়া ছাদের একদিকে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকতো। জামরুলের কয়েকটা ডাল ছাদের উপর ঝুঁকে এসেছিল, সেখান থেকে পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচের দিকে ফেলতাম। তখন ছোট ছোট পাখি কিচির মিচির করে আমাদের সাথে খেলা শুরু করতো। বিকালটা দীর্ঘ হবার আগেই অন্ধকার নেমে আসতো। বৌ ঘাটলা থেকে শাকচুন্নি বের হয়ে আসার আগেই বাসায় ফিরে আসতাম আমরা।

রাতটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। হারিকেনের সলতে বাড়িয়েও অন্ধকার যেত না। কিছুক্ষণ মিছামিছি পড়াশোনা করে আব্বাকে ঘিরে বসতাম। মনে হতো বাবুদের বাগান থেকে গলাকাটা কবন্ধ এসে ঝাপিয়ে পড়বে। তাই আরেকটু কাছে এসে আব্বার গায়ের স্পর্শ নিতে নিতে গল্পে ঢুকে যেতাম। দোতলা বাড়িটার টয়লেট ছিল অদ্ভুত। উপরে বসার ব্যবস্থা, আর একতলায় মাটির চারি বসানো। সেখানে বর্জ্য জমা হতো। আমরা একসাথে দুই তিনজন যেতাম। তারপর দুতলা থেকে সই করে একতলায় হাগু করতাম। এই জায়গাটা ভয়ের। কখন যে পিছলে পড়ে যাই সেই ভয় ছিল।

পিঠাপিঠি ভাই থাকাতে বাসায় সর্বদাই অস্টারমিল্কের কৌটা ভর্তি থাকতো। মুঠোভরা একটু হলদে সেই গুড়া দুধ সর্বদাই টানতো। একবার সন্ধ্যায় আব্বা অনেকগুলি কৈ মাছ বাসায় নিয়ে এল। হারিকেনের আলোতে কেউ মাছগুলি কাটতে চাইল না বলে একটা পাতিলে তা জিইয়ে রাখা হল। সকালে উঠে দেখা গেল, একটা মাছও আর নাই। খোঁজ লাগাতে লাগাতে তা পাওয়া গেল রান্না ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ ভাবেনি যে, মাছগুলির এত শক্তি হবে যে, পাতিল লাফিয়ে তা বাইরে যাবে। মাছ তো আর গোনা ছিল না, তাই যে কটা পাওয়া গেল তাই কাটা হলো। পরেরদিন পানি যাবার ড্রেন বন্ধ হয়ে গেলে আব্বা খোঁচাখুঁচি করে অনেকগুলি মরা মাছের দেহাবশেষ বের করলেন। আমরা খুব উত্তেজিত হয়ে সেই মাছগুলি দেখলাম।

নিচের তলায় একটা বড় রুম সর্বদা তালা মারা থাকতো। ওখানে নাকি জমিদার বাড়ির জিনিসপত্র গুদামবন্দি ছিল। কিন্তু কেউ এসে আর তা নেয়নি। আমরা জানালার চিকন ছিদ্র দিয়ে তা দেখার চেষ্টা করতাম। দেখা যেত ছাদ থেকে ঝাড় বাতি ঝুলছে। একবার কে যেন একটা ফুটা আবিষ্কার করল। সেখান দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা থেকে অনেকগুলি কড়ি আর একটা প্রিজম বের করে আনে। আমাকে ওরা প্রিজমটা দেয়। আমি বহুদিন সেই প্রিজমটার ভিতর দিয়ে সব কিছু দেখা শুরু করি।

জমিদার বাড়ির আরেকটা অংশ ছিল। সেখানে তখনো তাদের এক হিস্যাদার বাস করতেন। খুব একটা কেউ সে অংশটায় যেত না। কাছে গেলেই ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় বলতো, ‘কে রে ওখানে?’ তবুও কখনো কখনো আমরা শিশুরা ঢুকে যেতাম। একটা বিশাল সাইজের বিড়াল ঘ্রঘ্র করে শব্দ করে রোদ পোহায়! টানা বারান্দায় পাখি ঝুলানো। দেখি, সে মানুষ দেখে বলছে: অতিথ আসছে, বসতে দাও। আমরা তো অবাক। কে কথা বলে? তখন একজন ফর্সা মহিলাকে দেখি, ভিজা চুল আচড়াতে আচড়াতে আমাদের বলছেন, ভয় পাইও না। আমাগো ময়না, কথা বলতে পারে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি সেই মহিলার দিকে। কি সুন্দর! শাদা শাড়ি লাল পাড়। উনি আমাকে ডেকে বলেন, কই থাকো খোকা? আমি পাশেই দোতলার দিকে দেখাই। উনি বললেন, ও আচ্ছা!

বাসায় এসে মাকে সেই অভিযানের কথা মহা উৎসাহে জানাই। মা কিছুটা শংকিত হয়ে বলেন: তারপর? আমি বলি, তারপর আর কিছু না। উনি নাড়ু দিলেন। বললেন, আবার আইসো। মা বললেন, আর যাইস না, বিরক্ত হৈতে পারে। উনি কামিনী। আমি কিছু বুঝলাম না। বড় হয়ে বুঝেছিলাম, উনি সেই ছোট জমিদারের উপপত্নি গোছের কেউ।

একদিন আব্বা একটা সুন্দর রুপালি চা’দানির সেট বাসায় নিয়া আসে। বলে, কিনলাম। ওদের খুব টানাটানি যাচ্ছে, লুকাইয়া লুকাইয়া বিক্রি করে। আমি আব্বার কোলে বসে দেখি, কী চকচকে জিনিস... ঝকঝক করছে সব কিছু... আসল রুপার কাপ পিরিচ...। সেসময়ই আমি আমার জীবনের প্রথম বাগান দেখি। মনে আছে একদিন বিকালে কার সাথে যেন হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই সৌখিন বাগানটাতে যাই। ততদিনে বাড়ির পিছনের এলোমেলো স্বাভাবিক জংগল দেখেছি...। হঠাৎই আমি অনুভব করি সাজানো গাছপালার উপস্থিতি। দেখি কেমন পরিপাটি করে নানা রকমের পাতা আর ফুল! এমন কিছু ঘ্রাণ পেলাম... যা আজো মনে করতে পারি। মালতিলতার ঝাড় ছিল সেখানে। সাদা রঙন ছিল। আরো অনেক কিছু ছিল। ছিল সরল জ্যামিতি। আমি দেখলাম, সরল রেখার সাথে গন্ধ যোগ হলে সেখানে একটা বৃত্ত তৈরি হয়। বেশ ত্রিভুজ, চতুর্ভূজ, বৃত্তাকার ফুলের বেড। সত্যিকার অর্থে এটাই আমার কাছ থেকে দেখা কোন জমিদার বাড়ির দৃশ্য। এর পর আর গৃহস্থগোছের বাড়ি দেখি নাই।

সদরপুর থানা সদরে আব্বার অফিসের কন্সট্রাকসন হচ্ছিল। একদিন শুনলাম তা তৈরি হয়ে গেছে। আমরা তাই বাইশরশি থেকে সদরপুরে চলে আসলাম। ছোট্ট জায়গা। সারাদিন ঘরে কাটাতে হয়। খুব মন মরা হয়ে গেলাম যেন। বাসায় বসে বানান করে বই পড়া শিখি। স্লেটে লিখি। হঠাৎ আব্বা বললেন, চল, তোকে স্কুলে ভর্তি করে আসি। আমি কিছু ভয় ভয় নিয়া আব্বার সাথে গেলাম। কিন্তু সেই স্কুলের কোন স্মৃতিই আমার নাই।

বরং ভাল করে আরেকটা জিনিস মনে আছে। আমাদের বাসার সাথেই ছিল থানা। থানা সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে ‘চোর’ শব্দটা নিয়া কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। এইটা কি রকম? প্রায়ই শুনতাম থানা থেকে বেদম মাইর দেবার শব্দ! কে যেন কাকে পিটাচ্ছে, আর লোকটা বিকট চিৎকার করছে। কাউরে জিগাইলে বলে: চোর পিটায়। আমি জিগাই, ক্যান? বলে চুরি করছে যে, এইজন্য। আমার বন্ধুরাও তেমন কিছু বলতে পারতো না। তবে বলত: দেখবি এর পরে ‘সোলেমানি সুরমা’ দিব। সোলেমানি সুরমা হৈল চোখে বোম্বাই মরিচ দেয়া। আমরা ভয়ে সিউরে উঠি!

একদিন দেখলাম চোরটাকে। কাচুমাচু রোগা দুর্বল গরিব একটা লোক। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। পুলিশ তাকে দড়ি বেঁধে কোতয়ালি নিয়ে যাচ্ছে। লোকটার দিকে তাকিয়ে আমার মনটা কাতর হয়ে গেল। এই লোকটারে এত মারছে!

সদরপুরেই আটরশি হুজুরের বাড়ি। তখন কেবল জমে উঠছে। কাঁচা রাস্তা ধরে যেতে হয়। পীরের গোয়ালে অনেকগুলি বিদেশি গরু আছে, ভেটেরিনারি ডাক্তার আব্বা এদের দেখতে মাঝে মাঝে যান। একবার আমারে নিলেন সাথে। গিয়া দেখি, ইয়া উঁচু উঁচু সাদা রংয়ের গরু। সুন্দর করে টিন সেডের নিচে সারি দিয়ে বাধা। আব্বা বললেন, পীর সাহেব গরুগুলির খুব যত্ন নেন। যদিও পরে শুনেছিলাম ঐ গরুগুলি নাকি মানুষ। পীরের বিদেশি মেহমান। দিনের বেলা গরুর রূপ নিয়া থাকে। রাত্রে তারা মনুষ্যদেহধারী হয়। অনেক রাত্রে দল বেঁধে কাতারে নামাজ পড়ে হুজুরের বাড়ির পাশে খোলা মাঠে। আমি কিছুটা অবিশ্বাস নিয়া জিগাইছিলাম, তখন লেজগুলি কি হয়? সেকথার কোনো জবাব পাই নাই।

ফেরার সময় আমরা সেই কাঁচা রাস্তার দুপাশে বাবলার ফল (তেতুলের মত) থেকে বীজ বের করে ছড়াতে ছড়াতে আসলাম। আব্বার পিয়ন সফিক খুব গাছ প্রেমিক। ও এইসব কাজের হোতা। বলল, কিছু খৈয়া বাবলা লাগাইতে হৈব। দেখবেন একদিন গাছগুলা পূরা রাস্তা জুইরা থাকব।

এক ঝড়ে সফিক ভাইর বাড়িতে খুব ক্ষতি হৈল। আব্বাকে অনেক বলে কয়ে সে আমাকে নিয়া গেল তাদের বাড়িতে। গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি বাড়িটা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। পূরা খড়ের চালটাই একদিকে পড়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। সফিক ভাইয়ের মা খুব সরমিন্দা হয়ে গেলেন, আমাকে কিছু খাইতে দিতে পারতেছেন না বলে। সফিক ভাই ডাব পেরে আনলেন আমার জন্য। তারপর নিজেই দা দিয়ে ডাবটা কেটে দিলেন। আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে ডাব কাটা দেখলাম। কেমন আড়াই কোপে নিখুত ভাবে ডাবটা কেটে গেল, না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। তবে পুরা ডাব থেকে পানি খাইতে অনেক মেহনত করতে হৈছিল। সফিক ভাইদের বাড়িতে তেমন ভাল গ্লাস ছিল না মনে হয়। তাছাড়া ডাবের পানি গ্লাসে খাওয়ার রেওয়াজ তখন ছিল না।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক