হঠাৎ এলোমেলো এক সন্ধেয়

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মে ২৪, ২০১৮

সন্ধে ঝুলে পড়েছে।
জয়নাল বয়াতি পর পর দুবার কাশলেন। মরণপণ কাশি। প্রায় অন্ধকারে ফুটপাতে তার পাশে বসে গুড্ডু ভাই চেয়ে আছেন তার দিকে। আজ দুপুর থেকেই তিনি আছেন বয়াতির সঙ্গে। মানুষটা খুব হিসেব করে সন্দেহ নিয়ে তার কথার দু’চারটে জবাব দিয়েছে মিলাদ শরীফ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। তাও বিরক্ত মুখে। মুখ ফুটে চলে যেতে এখনও বলেননি, কিন্তু ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। গুড্ডু ভাই নড়েননি। ঠায় বসে আছেন। একবার জিগেশ করেছিলেন, গুরু পরিবারের অবস্থা কি? মানুষটা সে কথার জবাব না দিয়ে এমন তেরছা চোখে চেয়েছিল যেন সে মুখে বললে হয়তো বলতো, মতলব কী মিয়া, পরিবারের খবর ন্যাও।

বয়াতির সামনে একটা কুমারখালী মার্কা গামছা পাতা। তাতে অনেকগুলো একটাকা পাঁচ টাকার কয়েন আর বেশির ভাগ দু’টাকার নোট। জয়নাল বয়াতি এখন দু’টাকার নোটগুলো একসঙ্গে করে গুনছেন। এরমধ্যে আবার কাশি উঠলো। সেই মরণপণ কাশি। গুড্ডু ভাই হাত বাড়িয়ে আন্তরিক গলায় বললেন, গুরু আমার কাছে দ্যান। আমি গুইনা দেই। জয়নাল বয়াতি সন্দেহের চোখে তাকালেন তার দিকে। একটু আহত হয়ে গুড্ডু ভাই করুণ মুখে চেয়ে রইলেন তার দিকে। লোকটাকে বোঝানো মুশকিল গুড্ডু মিয়া চোর-বাটপার না। সে জয়নাল বয়াতিকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু মানুষটাকে এসব বোঝানো যাচ্ছে না। দুপুর থেকে এ পর্যন্ত তার সঙ্গে থেকে গুড্ডু ভাই বুঝতে পেরেছেন, মানুষটার ভেতরে কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা সাংঘাতিক কমে গেছে।

টাকাগুলো গুনে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে একগাদা কয়েনসহ গামছাটা পুঁটলি করে বেঁধে ফেললেন জয়নাল বয়াতি। তাকালেন একবার গুড্ডু ভাইয়ের দিকে। তারপর উঠে হাঁটতে আরম্ভ করলেন।

গুরু উঠলেন নাকি?
জ্বে। কিছু বলবেন? দাঁড়ালেন জয়নাল বয়াতি।
গুড্ডু ভাইও উঠে দাঁড়ালেন, আমিও যাই। আপনার আবাসটা দেইখা আসি।
না। দৃঢ় গলায় বললেন জয়নাল বয়াতি। তারপর হাঁটা ধরলেন। সেদিকে চেয়ে রইলেন গুড্ডু ভাই। একটুক্ষণ চেয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। একজন পরাজিত মানুষের হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি তার চোখ সহ্য করতে পারে না। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন গুড্ডু ভাই। একটা সিগারেট ধরালেন। মনে হলো, মানুষটার পিছু নেয়া যেতে পারতো। দেখে আসা যেত দূর থেকে কোথায় থাকেন তিনি।

রাত নেমে এসেছে। ফুটপাতের ওপরই একটা চায়ের দোকানে এসে বসলেন তিনি। কড়া করে একটা লাল চায়ের অর্ডার দিলেন। চাঅলা মাঝ বয়েসি। দেখতে বেশ গোলগাল। মুখে ছোট সাইজের একটা টিউমার। ডান গালের দিকটা বিচ্ছিরি রকমের দেখতে হয়ে আছে। চা খেতে খেতে তিনি বললেন, ভাই, আপনার মুখের অবস্থা তো বেগতিক। ডাক্তার দেখান নাই?
দ্যাখাইছি। টাকা-পয়সার তো একটা ব্যাপার আছে। কাটাকাটির মামলা।
অপারেশনে তো আপনার খুব বেশি টাকা লাগার কথা না। সরকারি হাসপাতালে কম টাকার ভেতর এসব অপারেশন হয়ে যায়।
তা হয়তো হয়। আমার যে ভাইজান ওই কম টাকাও নাই। কোনও রকমে টিইকা আছি এই শহরে।

চা শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরালেন গুড্ডু ভাই। তারপর বললেন, ভাই, ওই যে ওইখানে এক বুড়ো মতো লোক বসে ভিক্ষা করে, খেয়াল করছেন কখনও?
কার কথা কন?
ওই যে ওই জায়গাটায় বসে, কাশির ব্যারাম আছে। আঙুল তুলে দেখালেন গুড্ডু ভাই।
ফকির-ফাকরা কেডা কহন আসে-যায় আমি খিয়াল রাখব ক্যামনে ভাই। তারপর চোখমুখে একটু সন্দেহ নিয়ে জিগেশ করে, কি হইছে ভাই? আপনে কি পুলিশের লোক?
না এমনি, আমি একজনকে খুঁজছি তো।

উঠলেন গুড্ডু ভাই। দাম মিটিয়ে রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে লাগলেন ফুটপাত ধরে। মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে একটু। হাঁটতে হাঁটতে হাইকোর্টের মাজারের সামনে চলে এলেন। সাড়ে আটটা বেজে গেছে। ভিখিরিদের জটলার ভেতর দাঁড়িয়ে রইলেন খানিক সময়। আলাদা রকমের একটা প্রাণ আছে এই জায়গাটার। যখনই এ এলাকায় এসছেন মিশে গেছেন এই মানুষগুলোর জীবন-যাপনের সঙ্গে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রীতিমতো সংসার সাজিয়ে বসেছে এরা খোলা আকাশের নিচে।

চারপাশে তাকালেন তিনি। খিকখিক করে হাসছে একটি মেয়ে। মেয়েটি বসে আছে ফুটপাতে, পায়ের ওপর পা তুলে। তাকে ঘিরে আছে তিন-চারটে লোক। কী যেন বলছে মেয়েটি লোকগুলোকে আর হাসছে খুব। সোডিয়াম আলোয় মেয়েটিকে ভীষণ অহংকারী বলে মনে হলো গুড্ডু ভাইয়ের। মনে হলো মেয়েটি এই মুহূর্তে কোনও রাজকন্যা আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো রাজকন্যার কৃপাপ্রার্থী।

বাচ্চা কেঁদে উঠল কোথাও। কোত্থেকে এক পাগলী দৌড়ে এলো গেটের কাছে বড় গাছটার নিচে। নাচতে আরম্ভ করল থেই থেই। গায়ে কাপড় বলতে কেবল শায়া। ওপরের দিকটা একদম খালি। বেয়ারিঙের ঠেলাগাড়িতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা এক ঠ্যাংকাটা ভিখিরি ধমকে উঠল, ওই বেডি যা ভাগ... যা এইখান থেইকা... ভেগে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে গাগলীর আচরণে দেখা গেল না। এবার সে চেঁচিয়ে গান ধরল, যদি সুন্দর একটা মুখ পাইতাম, সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম... তারপরই দৌড় দিল একটা। কার্জন হলের দিকে চলে গেল রাস্তা পেরিয়ে।

চেয়ে ছিলেন গুড্ডু ভাই এতক্ষণ। এবার ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে মাজারের ভেতর ঢুকলেন। নিচের দিকে হামলে পড়া কড়োই গাছটার নিচেই পাওয়া গেল ইয়াসিন মোল্লাকে। মা কালীর মতো দেখতে বেটে-খাটো সঙ্গিনীকে পাশে নিয়ে কলকে সাজাচ্ছেন। মুখ না তুলেই ইয়াসিন মোল্লা বললেন, বসেন ভাই, অনেকদিন পর আইলেন।
কেমন আছেন ইয়াসিন ভাই?
সাঁইজির সংসারে ভালো থাকাই নিয়ম। আমিও ভালো আছি।
কলকে সেজে কপালে ঠেকিয়ে দম দিলেন ইয়াছিন মোল্লা। তারপর ধরিয়ে দিলেন সঙ্গিনীর হাতে। কপালে ছুঁয়ে সঙ্গিনীও দুটান মেরে বাড়িয়ে ধরলেন গুড্ডু ভাইয়ের দিকে। কলকে হাতে নিয়ে সেই মহিলার পায়ের কাছে উঁবু হয়ে বসে পড়লেন গুড্ডু ভাই। বুকের ভেতর অনেক জ্বালা। হাবিয়া দোজখের মতো আগুন ধরে আছে দিনরাত সব সময়। টানতে লাগলেন গুড্ডু ভাই... দীর্ঘ দমে... পাগলের মতো... হাতবদল আর করছেন না।

ইয়াসিন মোল্লা আর তার সঙ্গিনী চেয়ে আছেন গুড্ডু ভাইয়ের মুখের দিকে। মাজারের আলোয় মানুষটাকে ভুতুরে মনে হতে লাগলো তাদের। ইয়াসিন মোল্লা থমথমে গলায় বললেন, ভাই, পেরেশানির কী আছে। আস্তে-ধীরে দম দেন।

চোখ তুলে গুড্ডু ভাই তাকালেন ইয়াসিন মোল্লার মুখের দিকে। তিরতির করে কাঁপছে তার চোখের তারা, চোখের পাতা বুজে আসতে চাইছে। আর তারপরই কাশতে আরম্ভ করলেন, জয়নাল বয়াতির মতো মরণপণ কাশি।
ইয়াসিন মোল্লা থ।