অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

হেলিকপ্টার

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৮

কীসের যেন শব্দ হচ্ছে। দূর থেকে ধীরে-ধীরে কাছাকাছি এগিয়ে আসছে শব্দটা। পাশ ফিরলাম আমি। মনে হলো, মেঘের ভেতর থেকে যেন ছুটে আসছে এই শব্দ। ভেসে-ভেসে আসছে। আমিও ভেসে-ভেসে শব্দের কাছাকাছি যেতে থাকি। তারপর ঘুম ভেঙে যায় আমার।
কান পেতে শুনতে চেষ্টা করি। হ্যাঁ, মেঘের মতো গুরু গুরু শব্দ হচ্ছে। কিন্তু আমি জানি, মেঘ নয়, হেলিকপ্টার। বুকের ভেতর একটার পর একটা আনন্দের ঢেউ ওঠে আর ভেঙে পড়তে থাকে। আম্মার মুখের দিকে তাকাই। আম্মা ঘুমোচ্ছেন। গভীর ঘুমে ডুবে আছেন তিনি। একটু-একটু নাক ডাকছে। জানলার পরদা নামানো। ঘরের ভেতর তাই অল্প-অল্প আলো। ধীর পায়ে খাট থেকে নেমে এলাম। তারপর এক ছুটে বাইরে।
বড়-বড় দুটো ডানা হাওয়ায় মেলে দিয়ে হেলিকপ্টার যাচ্ছে। না-না, আসছে। সকালেই তো দাঁত ব্রাশ করতে-করতে দেখেছিলাম যাচ্ছে। নিশ্চয়ই দরকারি কোনও কাজে গেছিল। সরকারি লোকজন তো ওই হেলিকপ্টারে। কত রকমের কাজই তো থাকতে পারে সরকারের। সে রকম কোনও কাজেই হয়তো গেছিল।
ওপরে দুহাত তুলে আমি ডাক দিলাম, এই... এই...
ওপর থেকে কিছু পড়ল না। কাউকে দেখলামও না যে, উঁকি দিয়ে তাকালো নিচের দিকে। হয়তো শুনতে পায় নি আমার ডাক। যা শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাবেই বা কী করে? আমি এবার উঠোন ঘুরে লাফিয়ে-লাফিয়ে ডাকতে লাগলাম, এই... এই... এই যে... আমি এখানে... এই... এই যে নিচের দিকে...   
এরপরও শুনতে কেন পাচ্ছে না? ওপর থেকে কিছুই তো পড়ল না। কেউ উঁকিও দিল না। নাকি দিয়েছে, লাফাতে লাফাতে আমিই দেখতে পাই নি। উঁকি দিল তো কিছু ফেলল না কেন? আমাকে চিনতেই হয়তো পারে নি। অত উঁচু থেকে কী আর কাউকে চেনা যায়?
চলে গেল হেলিকপ্টার। ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। খুব, খুব মন খারাপ। চোখ ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু আমি কাঁদলাম না। আমি কী আর ছোট আছি যে, কেঁদে ফেলব?
কেঁদে না ফেললেও টের পেলাম, কী রকম যেন হাহাকার আমার বুকের ভেতর। আমাকে চিনল না তো, ঠিকাছে... সরকারকে চিঠি লিখে আমি নালিশ করব লোকগুলোর নামে। তখন তো চিনতে পারবে, কে আমি?
আম্মা এসে দাঁড়ালেন দরজায়। বিরক্ত গলায় বললেন, কী হলো তোমার, অত চেঁচাচ্ছিলে কেন? একটু ঘুমোতেও দেবে না, নাকি?
কাঁদো-কাঁদো স্বরে আমি বললাম, আমার হেলিকপ্টার।
মুহূর্তে বিরক্ত ভাব কেটে গেল আম্মার। হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, ও মা, কাঁদতে আছে এর জন্যে। এসো, ঘুমোবে এসো। তোমার হেলিকপ্টার তোমারই থাকবে। তার জন্যে অত চেঁচামেচি কান্নাকাটির কী দরকার। চলো, আম্মা আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন।
কড়া শাসন আম্মার। দুপুরে খাবারের পর বাইরে ঘোরাঘুরি চলবে না। টিভি দেখা চলবে না। চলবে কেবল ঘুম। তিনি ঘুমোবেন। তার সঙ্গে আমাকেও। কিন্তু আমার আর ঘুম এলো না। কী যেন এক অভিমানে ভিজে গেল চোখ। আম্মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগলাম, সরকারকে কী কী লিখে চিঠি দেয়া যায়। আব্বাই তো আমাকে বলেছিলেন, এই হেলিকপ্টার তোমার। সরকার এখন  নিয়ে গেছে। বড় হয়ে তুমি যখন চালাতে শিখবে তখন আবার ফেরত দেবে।
আমি জিগেশ করেছিলাম, সরকার কে আব্বা?
আব্বা বলেছিলেন, সরকার হচ্ছে আমাদের এই দেশের রাজা। যার কথা সব মানুষ মেনে চলে। দেশ চালাতে গেলে রাজাকে তো অনেক রকম কাজ করতে হয়। এজন্যে তোমার হেলিকপ্টার রাজা নিয়ে গেছে। নিজে একটা কিনে তারপর তোমারটা তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।
আমি জিগেশ করেছিলাম, রাজা কবে কিনবে আব্বা হেলিকপ্টার?
আব্বা বলেছিলেন, কিনবে, খুব তাড়াতাড়িই হয়তো কিনবে।
আমি আবারও জিগেশ করেছিলাম, এখন কিনছে না কেন?
আব্বা বলেছিলেন, এখন তো রাজার কাছে টাকা-পয়সা নেই। টিভিতে প্রতিদিন দেখছ না, বন্যায় কী রকমভাবে ডুবে যাচ্ছে সারা দেশ। ঘরবাড়ি ডুবে যাচ্ছে মানুষের। না-খেতে পেয়ে কত মানুষ মারাও যাচ্ছে।
ঘাড় নেড়ে আমি বলেছিলাম, হুঁ, দেখেছি তো।
তবেই বলো, আব্বা বলেছিলেন, সরকার এই সময় দেশের মানুষকে বাঁচাবে, নাকি হেলিকপ্টার কিনবে?
আমি বলেছিলাম, ঠিকই তো, হেলিকপ্টার এখন না হলেও সরকারের চলবে। আমারটা তো তার কাছে রয়েছেই।
হাসতে-হাসতে আব্বা বলেছিলেন, তবেই বোঝো। আর হেলিকপ্টার তোমাকে এখন ফিরিয়ে দিলেই বা কী। তুমি চালাতে তো আর পারতে না। শুধু-শুধু পড়ে থেকে মরচে পড়ে যেত।
ঠিকই তো আছে, আমি ভেবেছিলাম। অত সুন্দর একটা হেলিকপ্টার আমার কাছে পড়ে থেকে শুধু-শুধু মরচে ধরে যেত। আমি তো আর চালাতে পারতাম না। আর কে না জানে যে, হেলিকপ্টার লোহা দিয়ে বানানো। লোহার সব কিছুতে মরিচা তো ধরবেই। এরচে ভালোই, সরকার নিয়ে গেছে। না-খেতে পাওয়া মানুষজনের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে আমার হেলিকপ্টারে করে।
রোজ-রোজ আব্বা-আম্মার সঙ্গে বসে টিভিতে দেখি, আমার হেলিকপ্টার নিয়ে সরকারি লোকেরা বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া মানুষদের চালডাল দিচ্ছে। কী যে আনন্দ হয় আমার তখন। কী যে আনন্দ। চোখ বড়-বড় করে আমি চেয়ে দেখি আমার হেলিকপ্টার। বিশাল ডানা দুটো দুদিকে মেলে ধরে কোনও উঁচু ডাঙায় এসে দাঁড়ায় আমার হেলিকপ্টার। আর তার পেটের ভেতর থেকে নেমে এসে সরকারি লোকগুলো চালডাল দেয় হেলিকপ্টার ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে। মানুষগুলোর মধ্যে তখন হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।     
এসব দেখতে-দেখতে খুব আনন্দ হয় আমার। আর বেশ একটু অহংকার। আমার হেলিকপ্টার যে, অহংকার তো হবেই। বড় হয়ে যখন চালাতে শিখব, তখন এই হেলিকপ্টারই তো আমি চালাবো। মানুষজন, ঘরবাড়ি, গাছপালা আর নদীর ওপর দিয়ে আমি তখন উড়ে-উড়ে বেড়াবো। সবাই বলবে, কে যায় রে হেলিকপ্টারে চড়ে? আমি তো আর তখন শুনতে পাব না তাদের কথা। হেলিকপ্টারের ডানার বোঁ বোঁ শব্দ শুনতে পাব কেবল। আর জানলা দিয়ে নিচের দিকে চেয়ে দেখব, মানুষজন কী রকম হাঁ হয়ে চেয়ে-চেয়ে দেখছে আমার হেলিকপ্টার।
কোনও কোনও দিন টিভি দেখতে-দেখতে আব্বা বলেন, এই হেলিকপ্টারটা যেন কার?
আমি চেঁচিয়ে বলি, আমার... আমার...।
আব্বা হাসেন। আম্মাও হাসেন মিটমিট করে। আমার চোখ তখন চকচক করে, আনন্দে আর অহংকারে।
রোজ-রোজ এই রকমভাবে আমি আমার হেলিকপ্টার দেখি।
কিন্তু এটা কেমন কথা যে, সরকারি লোকগুলো আমার হেলিকপ্টার নিয়ে আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে গেলেও কিছুই আমাকে জানিয়ে যায় না। একটা চিঠিও ফেলে যায় না। সরকার তার লোকগুলোকে তো বলে দিলেই পারত আমার কথা। বলে দিতে পারত যে, এই ছেলেটা হেলিকপ্টারের আসল মালিক। কখনও তার বাড়ির ওপর দিয়ে গেলে হেলিকপ্টারের খবরাখবর জানিয়ে তার কাছে যেন চিঠি ফেলে দেয়া হয়।
তা তো দেয় না আমাকে সরকারি লোকগুলো। হেলিকপ্টারের কোথাও কিছু ভাঙল কীনা, কোথাও কিছু মচকালো কীনা, এসব বুঝি আর জানতে আমার ইচ্ছে করে না?
আমি ঠিক করলাম, চিঠি একটা লিখতেই হবে সরকারকে।
বিকেলবেলা খেলতে গেলাম আমবাগানে। বিকেলের হলুদ রোদে আমগাছের ছায়া বিছিয়ে রয়েছে বাগানে। সেই ছায়ায় আমরা দৌড়ঝাপ করছি। খেলছি নানা রকম খেলা। হঠাৎ দেখি, আমগাছের ঝুলে পড়া একটা ডালে দু’পা পেঁচিয়ে ধরে মাথা নিচের দিকে দিয়ে  ঝুলে রয়েছে কুটু। অবাক হয়ে যাই আমি। ওরকম ভাবে ঝুলে আছে কেন কুটু? খেলা ফেলে আমি এগিয়ে যাই ওর দিকে।
কাছাকাছি গিয়ে জিগেশ করি, কী করছিস রে কুটু?
আমার দিকে না চেয়েই কুটু বলল, ঝুলন খেলছি।
আমি বললাম, এভাবে কেউ বুঝি ঝুলন খেলে?
কুটু বলল, কেউ না খেলুক, আমি খেলছি।
আমি বললাম, পায়ে ব্যথা করছে না তোর?
কুটু বলল, করছে।
আমি বললাম, তারপরও যে ঝুলছিস?
এবার আমার দিকে মুখ ফেরালো কুটু। মাথা দোলাতে-দোলাতে বলল, এভাবে ঝুলন খেতে খুব মজা। ঝুলবি তুই?
দুদিকে মাথা নেড়ে আমি বললাম, না। তারপর জিগেশ করলাম, কীভাবে পারিস রে তুই এভাবে ঝুলতে?
কুটু বলল, একটু-একটু করে শিখেছি।
আমি বললাম, কই, কখনও দেখি নি তো?
কুটু হাসল। বলল, আমাদের উঠোনের পেয়ারাগাছে ঝুললে তুই দেখবি কী করে? এটা অনেক কঠিন খেলা। তোরা পারবি না। তোরা শুধু খেলবি ওই গোল্লাছুট।
আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি কুটুর ঝুলে থাকা দেহের দিকে। ঠিক যে, আমার চেয়ে মাথায় কুটু অনেকটা লম্বা। বয়েসও একটু বেশি। তাই বলে এইভাবে ঝুলন খেলতে পারে সে?
মাথা দোলাতে-দোলাতে কুটু গুনগুন করে কী যেন একটা গান গাইতে লাগল। ফিরেও দেখল না আর আমাকে।
আমি ডাকলাম, এই কুটু শোন।
গানের মাঝখানে কুটু বলে উঠল, বল।
আমি বললাম, তোর সাথে আমার একটা কথা আছে।
কুটু বলল, বল না। শুনছি তো। বলেই ফের গুনগুন করতে লাগল।
আমি আবার ডাকলাম, এই কুটু?
গুনগুন থামিয়ে মুখ ফেরালো কুটু। বলল, কী বলবি বল না, শুনছি তো।
আমি বললাম, নেমে আয় তারপর বলব।
কুটু বলল, এখানেই বল না।
আমি বললাম, না, তুই আগে নেমে আয়।
নেমে এলো কুটু। দুদিকে ঘাড় মটকাতে-মটকাতে বলল, বল এবার।
খেলতে থাকা ছেলেদের দিকে চেয়ে আমি বললাম, এখানে না, ওই ওদিকে চল।
হাঁটতে হাঁটতে বাগানের একদিকে চলে এলাম আমরা। কুটুর একটা হাত ধরে বললাম, ওদের কাউকে বলবি না তো?
কুটু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, কী বলব না তাই আগে বল।
আমি বললাম, বল যে বলবি না।
কুটু বলল, আচ্ছা যা বলব না। এখন বল কী কথা।
আমি বললাম, জানিস, আমার একটা হেলিকপ্টার আছে।
কুটু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে জিগেশ করল, কী আছে?
আমি বললাম, হেলিকপ্টার।
হোহো করে হেসে উঠল কুটু। তার দিকে চেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি জানতাম, কেউ বিশ্বাস করবে না আমার কথা। আর তাই কাউকে কখনও বলি নি যে, আমার একটা হেলিকপ্টার আছে। শুনলে সবাই ঠিক এরকম ভাবেই হাসত। কেন যে আজ কুটুকে হঠাৎ বলতে ইচ্ছে হলো। এখন তো কুটু হাসছে। তারমানে, আমার যে একটা হেলিকপ্টার আছে কথাটা কুটুর বিশ্বাস হয় নি।
মন খারাপের গলায় আমি বললাম, তোর বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না?
দুদিকে মাথা নেড়ে কুটু বলল, না, হচ্ছে না।
আমি বললাম, কিন্তু সত্যি-সত্যি আমার যে একটা হেলিকপ্টার আছে।
হাসতে-হাসতে কুটু বলল, তুই বুঝি ঘুমের ভেতর হেলিকপ্টার দেখিস?
আমি দুদিকে মাথা নেড়ে বললাম, না-না, আমার একটা হেলিকপ্টার আছে। তুই বিশ্বাস কর। আর হেলিকপ্টার বুঝি মানুষের থাকে না? না থাকলে আকাশ দিয়ে উড়ে যায় কেন?
হাসি থামিয়ে কী যেন ভাবল কুটু। আমার মনে হলো, সে বুঝি এইবার একটু-একটু বিশ্বাস করতে শুরু করেছে আমার কথা। কুটু বলল, তোর যদি হেলিকপ্টার থাকেই তাহলে তোর কাছে নেই কেন? কোথায় সেই হেলিকপ্টার?
আমি বললাম, সরকার নিয়ে গেছে। বড় হয়ে যখন চালাতে শিখব তখন ফিরিয়ে দেবে। কী, এইবার বিশ্বাস করলি তো যে, আমার একটা হেলিকপ্টার আছে?
কুটু বলল, বিশ্বাস না করলে কী?
আমি বললাম, কিছুই না। কিন্তু আমার একটা হেলিকপ্টার আছে, এটা মিথ্যে না।
কুটু বলল, আচ্ছা ধর, যদি আমি বিশ্বাস করি তোর কথা তাহলে তোর হেলিকপ্টারে আমাকে চড়াবি তো?
আমি বললাম, বিশ্বাস করলে চড়াব।
কুটু বলল, বিশ্বাস করলাম তো।
কী যে আনন্দ হলো আমার। হেসে ফেললাম আমি। আমার দেখাদেখি কুটুও হাসল। হাসতে-হাসতে আমি বললাম, তাহলে চড়াব।
কুটু বলল, জানিস, আমার খুব ইচ্ছে একদিন হেলিকপ্টারে চড়ে ঘুরব। মেঘের ভেতর দিয়ে বিশাল একটা পাখির মতো কী রকম উড়ে-উড়ে বেড়ায়। কী যে মজা তখন। বলতে বলতে শেষ বিকেলের আকাশের দিকে তাকালো কুটু।
আমি চেয়ে রইলাম কুটুর মুখের দিকে। আর ভাবতে লাগলাম, সরকার আমার হেলিকপ্টার যেদিন ফিরিয়ে দিয়ে যাবে, সেদিনই কুটুকে হেলিকপ্টারে চড়িয়ে মেঘের দেশ ঘুরিয়ে নিয়ে আসব।

একটা হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাড়ির সামনে।
হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। বুক কাঁপতে লাগল দুরু দুরু করে। ভুল দেখছি না তো? ভুল কোথায়, ওই তো একটা হেলিকপ্টার ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে দেখা যাচ্ছে। বিরাট-বিরাট দুটো ডানা হেলিকপ্টারের। বিস্ময়ে আমার চোখ দুটো বড়-বড় হয়ে গেল। টলোমলো পায়ে আস্তে-ধীরে হেঁটে এসে আমি দাঁড়ালাম হেলিকপ্টারের পাশে। খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম, রাজার মতো দেখতে একজন ভেতরে বসে চেয়ে আছেন আমার দিকে। রাজার মতোই তার গায়ের পোশাক। মাথায় মুকুট। মুকুটে একটা পাখির পালক বসানো।
রাজা বললেন, এই বাড়ি কি তোমাদের?
মাথা নাড়লাম আমি, হ্যাঁ।
রাজা বললেন, এই বাড়িতে একটি ছোট্ট ছেলে থাকে, তাকে একটু ডেকে দাও।
আমি বললাম, আমিই তো সেই ছেলে।
আমার কথা শুনে রাজা নেমে এলেন। বললেন, আমি নতুন একটা হেলিকপ্টার কিনেছি। তাই তোমার হেলিকপ্টার তোমাকে ফিরিয়ে দিতে এলাম।
আনন্দে আর উত্তেজনায় আমি কেঁপে উঠলাম। একবার রাজার মুখের দিকে, আরেকবার হেলিকপ্টারের দিকে তাকাতে লাগলাম। হাত ধরে রাজা আমাকে তুলে দিলেন হেলিকপ্টারে। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে তিনি মিলিয়ে গেলেন আমবাগানের ভেতর। হেলিকপ্টার আমাকে নিয়ে ওপরে উঠে এলো। আমাদের গ্রাম যখন ছেড়ে যাচ্ছি, জানলা দিয়ে নিচের দিকে চেয়ে দেখতে পেলাম, উঠোনে পেয়ারাগাছের ডালে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলে রয়েছে কুটু। আমি হাত নেড়ে ডাক দিলাম, এই কুটু, এই দ্যাখ আমার হেলিকপ্টার।
আমাকে দেখতে পেয়ে কুটু গাছ থেকে নেমে ছুটতে আরম্ভ করল। ছুটছে আর ওপরদিকে হাত তুলে খুব চেচাচ্ছে। বলছে, এই মুন্না... এই মুন্না... আমাকে চড়াবি বলেছিলি, চড়াবি না?
আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে একটা মাঠের মধ্যে আমি হেলিকপ্টার নামালাম। ছুটতে-ছুটতে এলো কুটু। কুটুকে তুলে নিয়ে আমি আবারও উড়ে চললাম। মেঘের ভেতর দিয়ে ভেসে-ভেসে যাচ্ছে আমার হেলিকপ্টার। নীল-নীল মেঘ। কোথাও আবার কাশফুলের মতো শাদা। হেলিকপ্টারের ডানায় মেঘ কেটে-কেটে যাচ্ছে। আমি আর কুটু দেখছি এইসব, আর আনন্দ উপচে পড়ছে আমাদের চোখমুখে। জানলা ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। হাত বাড়িয়ে আমরা ছুঁয়ে দিলাম সেই মেঘ। মেঘের রং লেগে আমাদের হাতও নীল হয়ে গেল।
কুটু বলল, আয় নিচের দিকে দেখি।
আমরা নিচে তাকালাম। কেবল সবুজ আর সবুজ। মাঠে-মাঠে ফসলের ক্ষেত। কোথাও গাছপালায় ঘেরা গ্রাম। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ে গ্রামের ছোট-ছোট ঘরবাড়ি। মানুষগুলোকে দেখাচ্ছে এই এতটুকু। একটা নদীর ওপর চলে এলাম আমরা। নদীর পানিতে রোদ পড়ে চিকচিক করছে। মাছধরা ভেসাল পাতা রয়েছে নদীতে। ঘাটে গোছল করছে ছোট-ছোট সব মানুষ। পানিতে ভেসে থাকা শ্যাওলা এতই সবুজ যে, আমার মনে হলো, নদীর ওপর বিছিয়ে রয়েছে সবুজ ঘাসের বন।
হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আমরা দেখলাম, কালো মেঘের ভেতর ঢুকে পড়েছে হেলিকপ্টার। চারদিক কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভয় খাওয়া গলায় কুটু বলল, এই রে এখন কী হবে?
আমিও বুঝতে পারছি না এখন কী হবে। তবে বুঝতে পারছি বিপদ সামনে। বুঝতে কেবল দেরি, বিপদ আসতে দেরি হলো না। আমাদের বাড়ির রামছাগলের মতো দেখতে একটা মানুষ জানলার কাছে এসে খ্যাকখ্যাক হাসতে আরম্ভ করে দিল। তার চোখের ভেতর দাউদাউ আগুন জ্বলছে। ভয়ে তো আমাদের গায়ে কাঁটা। সিঁটিয়ে রইলাম দুজন। কাঁপতে-কাঁপতে কুটু ফিসফিস করে বলল, হেলিকপ্টার নামিয়ে ফেল।
আমি বললাম, আমি তো হেলিকপ্টার চালাতে পারি না।
বিরক্ত হলো কুটু। বলল, তখন যে হেলিকপ্টার নামিয়ে আমাকে তুলে নিলি। কে নামালো তখন?
অপরাধীর মতো মুখ করে আমি বললাম, তা তো জানি না।
কুটু বলল, এতক্ষণ তাহলে কে চালাচ্ছিল?
আমিও ভাবলাম, তাই তো, কে চালাচ্ছিল এতক্ষণ হেলিকপ্টার? আমি তো আর চালাতে পারি না। কিছুই বুঝতে পারলাম না। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম কুটুর দিকে। গলার ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ তুলে কুটু বলল, কী রে তুই, না চালাতে শিখেই হেলিকপ্টার নিয়ে চলে এলি? তোর হেলিকপ্টারে চড়াই আমার ভুল হয়েছে। এখন তো আর রক্ষে নেই।
মটমট মটমট শব্দ হচ্ছে।
চমকে উঠলাম আমরা। চেয়ে দেখলাম, হেলিকপ্টারের একটা ডানা ভেঙে ফেলছে রামছাগল মানুষটা। ভয়ানক দুলছে হেলিকপ্টার। দুলছি আমরা। দুলতে-দুলতে হঠাৎ হেলিকপ্টার উল্টেপাল্টে পড়ে যেতে লাগল নিচের দিকে। ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেছে। ঠকঠক করে কাঁপছে হাতপা। কাকে যেন ডাকতে গেলাম। গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হলো না। মনে হলো, বাতাস আটকে গেছে বুকের মধ্যে। নিশ্বাস নিতেও আর পারছি না। হঠাৎ চিৎকার করে আমি কেঁদে উঠলাম।
উঠে বসলাম। চারদিক অন্ধকার। কেবল হালকা নীলরঙের আলো ছড়িয়ে রয়েছে। ছুটে এলেন আম্মা। ছুটে এলেন আব্বা। আমি কেঁদে উঠলাম, আমার হেলিকপ্টার... আমার হেলিকপ্টার...
আম্মা জড়িয়ে ধরে আমাকে বুকের ভেতর নিয়ে আদর করতে লাগলেন। আব্বা বললেন, কী হয়েছে... কী হয়েছে...
কাঁদতে কাঁদতে আমি বললাম, আমার হেলিকপ্টার...
আব্বা বললেন, কী হয়েছে তোমার হেলিকপ্টারের?
আমি বললাম, ভেঙে ফেলেছে। রামছাগলটা ভেঙে ফেলেছে।
আম্মা বললেন, সব স্বপ্ন খোকা। কেউ তোমার হেলিকপ্টার ভাঙে নি। তোমার  হেলিকপ্টার তো সরকারের কাছে আছে।
মাথা নেড়ে আমি বললাম, নেই। সরকার এসে তো আমার হেলিকপ্টার আমাকে দিয়ে গেছে। কুটুকেও তো আমি চড়ালাম হেলিকপ্টারে ।
আব্বা বললেন, সে তো স্বপ্নের মধ্যে।
আম্মা আমার মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, হ্যাঁরে মনি, তুই স্বপ্ন দেখছিলি।
আমি তাকালাম আম্মার দিকে। তাকালাম আব্বার দিকে। হতেও তো পারে স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। কাল টিভিতে দেখলেই বোঝা যাবে। আমার হেলিকপ্টার ঠিকই আমি চিনতে পারব।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে, কাপড় না বদলেই আমি বসে পড়লাম টিভির সামনে।
আম্মা বললেন, কাপড় বদলে আগে হাতমুখ ধুয়ে নাও। তারপর বসো।  
আমি বললাম, আমার হেলিকপ্টার দেখব।
একটু হেসে আম্মা চলে গেলেন। টিভি ছেড়ে দিয়ে আমি বসে রইলাম। কিছু সময় পর খবর আরম্ভ হলো। থমকে গেলাম। মনে হলো, কেঁপে উঠল যেন সারা ঘর। কেঁপে উঠলাম আমি। আর কাঁপতে-কাঁপতে দেখলাম, দাউদাউ আগুনে জ্বলছে একটা হেলিকপ্টার। তাকে ঘিরে চিৎকার চেঁচামেছি করছে কিছু মানুষ। খবরের মহিলা তখন বলে যাচ্ছেন, বন্যার পনের-ষোলো দিন পেরিয়ে গেলেও সেখানে কোনও ত্রাণসামগ্রি পৌঁছায়নি। জেলার কয়েকশো মানুষ গত কয়েকদিনে মারা গেছে না-খেতে পেয়ে। স্থানীয় সংসদ সদস্য নিয়ামুল বাসার ত্রাণসামগ্রি নিয়ে আজ সকালে হেলিকপ্টার যোগে জিলা স্কুলের মাঠে নামতেই হাজার-হাজার বন্যাদুর্গত মানুষ তাকে ঘিরে ফেলে। সংসদ সদস্যের সাথে এসময় স্থানীয়দের কথা কাটাকাটি হয়। পুলিশ এসে ভিড় সরিয়ে দিতে গেলে বিক্ষুব্ধ জনতা হেলিকপ্টারটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।