অতিরিক্ত কৌতূহল বিপদ ডেকে আনে

পর্ব ২৩

প্রকাশিত : মে ২২, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ২৩ পর্ব

৯ মে ২০২১ রোববার
আজকে ছিল মা দিবস। পশ্চিম থেকে ধেয়ে আসা অথবা ডেকে আনা এইসব দিবস এখন আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ঘরে ঘরে পালনীয় হয়ে উঠেছে কিনা সে বিষয়ে আমি এখনো সন্দিহান। তবে ফেসবুক একাউন্ট নাম দিয়ে আমরা প্রত্যেকে যে একটা নিজস্ব কামরা বানিয়ে নিয়েছি, সেখানে এসব দিবস অবশ্যপালনীয় হয়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

এ বছর লক্ষ্য করছি, ফেসবুক কামরায় মা দিবসের উদযাপন তুলনামূলক কম। গত বছর যাও বা একটু ছিল, এ বছর তা আরও কমে গেছে। গত বছর আমার হোমপেজে শতকরা ৭২ ভাগ পোস্ট ছিল মা দিবসকেন্দ্রিক। এ বছর তা নেমে এসেছে ৩৮ শতাংশের কোটায়। সন্দেহ নেই, এর পেছনে মহামারিই দায়ী। মহামারি কি মায়ের প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে দিলো?

দু’বছর আগের চিত্র ছিল ভিন্ন। ২০১৯, ১৮, ১৭ এই সময়গুলোতে মা দিবসে হোমপেজের শতকরা ৯৮ ভাগ পোস্ট থাকত মাকে নিয়ে। তখন আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মা দিবসকেন্দ্রিক আয়োজন৷ মোবাইল কোম্পানিগুলো মাকে নিয়ে চোখে অশ্রু বইয়ে দেয়ার মতো বিজ্ঞাপন বানাতো। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপত বহুজাতিক কম্পানিগুলো। আজাদ প্রোডাক্টস দিত ‘রত্মগর্ভা মা’ পুরস্কার। দু’বছর ধরে এই আয়োজন আর চোখে পড়ছে না।

মনে পড়ছে, ডেইলি স্টার একবার আয়োজন করেছিল মায়ের সাথে ছবি আর গল্প লেখা প্রতিযোগিতা। প্রথম আলো একবার আয়োজন করেছিল মায়ের কাছে লেখা চিঠি প্রতিযোগিতা। এরকম হরেক আয়োজন ছিল নানা প্রতিষ্ঠানের।

এই দু’বছরে মা দিবস ইভেন্টমুক্ত হয়েছে বলা যায়। শুধু এয়ারটেলের একটা কার্টুনচিত্র ছাড়া মাকে নিয়ে আর কোনো বিজ্ঞাপন আমার হোমপেজে আসেনি। মহামারি অন্তত ইভেন্টিকরণের উৎপাত থেকে মা দিবসকে মুক্ত করেছে, এটুকুই স্বস্তি।

আমি কাকতালীয়ভাবে ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটি আবার পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে গোর্কির ছেলেবেলা, তার মতৃজননীর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল আমার ছেলেবেলা, আমার মায়ের কথা। সবমিলিয়ে একটা পোস্ট দিলাম। ট্রেন্ডি থাকার গোপন ইচ্ছা? অবচেতন বাসনা? কি জানি! এসব ভেবে তো ফেসবুকে লিখি না। ফেসবুক একটা অভ্যাসের নাম। অভ্যাসবসতই লিখি।

বিকেলে অফিস থেকে ফিরতে আবারও যানজটে পড়লাম। ইদানীং প্রতিদিন যানজট হচ্ছে রাস্তায়। গতকালও রাস্তায় বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। আজও থাকতে হলো। অগুণতি গাড়ি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ একটা গাড়িতে আমার চোখ আটকে গেল। আমার ডান পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, একটা মালবাহী লরির মতো, তার শরীরে গ্রি এসির পোস্টার সাঁটা। পোস্টারে লেখা ‘প্রতিটি নিশ্বাসে নিন গ্রিন ইনভার্টারের নির্মল বাতাস’।

সবুজ ইনভার্টারটা কী জিনিস? আমার খুব জানার কৌতূহল হলো। এই এসি থেকে কী সবুজ সবুজ হাওয়া বের হয়? আমার জানতে ইচ্ছে করলো খুব। পরক্ষণেই মনে হলো, পৃথিবীর কত কিছুই তো জানি না। তাতে কি পৃথিবী থেমে আছে? নাকি আমার জীবন থেমে আছে? সবুজ ইনভার্টার সম্পর্কে কেন জানতে হবে আমার? কী দরকার? অতিরিক্ত কৌতূহল মোটেও ভালো না। অতিরিক্ত কৌতূহল বিপদ ডেকে আনে। আমি অন্যদিকে মন দেয়ার চেষ্টা করলাম।

আসাদ গেটে আসতে আসতে ছয়টা বেজে গেল। আমি অফিসের গাড়ি থেকে নেমে ফুটওভার ব্রিজের উপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ইফতারের সময় হতে আর আধঘণ্টার মতো বাকি আছে। ঘরফিরতি মানুষেরা ত্রস্ত হরিণীর মতো ছুটছে। তারা ঘরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতে চায়।

আমি ফুটওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছুটে চলা মানুষ দেখছিলাম। উপর থেকে জগৎ দেখার মধ্যে একটা ঐশ্বরিক আনন্দ আছে। হরেক রকমের মানুষ। লম্বা, খাটো, বেঁটে, শুকনো, চিকন, স্বাস্থ্যবান, ফর্সা, কালো, তামাটে...। একেক জনের হাঁটার ভঙ্গি একেক রকম। কেউ আলতো করে পা ফেলে হাঁটছে, কেউ থপ থপ করে পা ফেলে হাঁটছে। কেউ সোজাসুজি ধাপ ফেলছে, কেউ এলোমেলো ধাপ ফেলছে। কেউ মেয়েদের মতো কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছে, কেউ ক্যঙ্গারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। একেক জনের একেক ভঙ্গি। ছেলেদের একরকম, মেয়েদের আরেক রকম। তরুণদের একরকম, বয়ষ্কদের একরকম। শিশু কিশোরদের আবার সম্পূর্ণ অন্য রকম।

আমার হঠাৎ মনে পড়ল উস্টুঙ্গার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটা এক মানুষের কথা। এত মানুষের ভিড়ে তার মতো করে কাউকে হাঁটতে দেখলাম না। আমার চোখে সেই ফেলে আসা হাঁটাটা ভাসতে থাকল। একটু অশ্রু জমল কি?

মিনিট দশেক পর হঠাৎ চমকে উঠলাম। সর্বনাশ! ইফতারের আর বেশি দেরি নেই তো! ফুটওভার ব্রিজ থেকে দ্রুত নেমে বাসার দিকে ছুটলাম। আমার হাঁটার ভঙ্গিও কি উপর থেকে কেউ পর্যবেক্ষণ করছে? চলবে