অমিতাভ পালের গল্প ‘বোঁটকা গন্ধ’

প্রকাশিত : জুন ০৫, ২০২১

গভীর রাতে, আড়াইটার দিকে, ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল আমার। আর ঘুম ভাঙতেই চোখ, কান, মুখ, নাক—শরীরের ভিতরের দেহযন্ত্রগুলি সব একসাথে সজাগ হয়ে গেল। চোখে ঢুকে পড়লো ঘরের ক্ষীণ আলো, কান শুনলো রাতের কুকুরের চিৎকার, মুখ একটা ঢোক গিললো এবং নাক পেল একটা অদ্ভূত বোঁটকা গন্ধ। এমন বুনো, আদিম সেই গন্ধ যে, তার স্বৈরশাসনে কাহিল হয়ে পড়লো আমার ইন্দ্রিয়গুলি। দেহযন্ত্রগুলি তাদের সাথে তাল মিলিয়ে শুরু করলো অস্বাভাবিক আচরণ করতে। হৃদযন্ত্র বাড়িয়ে দিল ধুকপুকানি, ফুসফুস শুরু করলো ঘনঘন শ্বাস নিতে আর মস্তিষ্ক পেলো ভয়। মনে হলো, ঘরের জানালার বাইরে একটা বাঘ পায়চারী করছে। ওই বুনো গন্ধটা যেন তার শরীরের। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? এমনিতেই বাঘ প্রায় বিলুপ্ত, সুন্দরবনেও তাদের খুঁজে পাওয়া আজকাল কঠিন হয়ে যাচ্ছে আর এটাতো ঢাকা শহর। এখানে বাঘ মরে গেলেও আসতে চাইবে না। কিন্তু ওই বোঁটকা গন্ধটা? ওটাকে অস্বীকার করবো কিভাবে? এখনো আমার নাক ভরে আছে গন্ধে, বুকেরও প্রায় সবটা তার দখলে চলে গেছে...

এমন সময় আমার যুক্তিবাদী মন চাইলো জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে নিতে যে, বাঘটা সত্যিই ওখানে আছে কিনা। জানালাটা গ্রিল দিয়ে আটকানো বলে বাঘটা সহজে আমাকে আক্রমণ করতে পারবে না। এটা যেন চিড়িয়াখানায় পরস্পরের মুখামুখি হচ্ছি আমরা। যতই রাগ-ভয় থাকুক, গ্রিলের মধ্যস্ততায় পতাকা বৈঠকই হবে আমাদের মধ্যে। এসব ভাবনা আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে আনলো এবং দাঁড় করিয়ে দিল জানালার পাশে। উঁকি মারার পরে মনে হলো, আমি একটা আকাট মূর্খ। আমার ঘরটা যে দোতলায়, সেটা কি করে ভুলে গেলাম? দোতলা একটা ঘরের জানালার পাশে একটা বাঘ হাঁটবে কি করে? অবশ্য দোতলা যে মাটি থেকে খুব উঁচু কোনো জায়গা, এমন না। বাঘটা একতলার জানালার পাশ দিয়ে হাঁটলেও তার গন্ধের দোতলা পর্যন্ত পৌঁছাতে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না। ফলে নিজেকে মূর্খ বলে নিজের কাছেই নিজেকে ছোট করার গ্লানি থেকে কিছুটা মুক্ত হলাম। তারপর দোতলার জানালার পাশের শূন্যতার ওপর ভরসা করে ভয়হীন হৃদয়ে উঁকি দিলাম নিচের মাটিতে বাঘ খোঁজার জন্য।

কিন্তু কোথায় বাঘ? একটা বিড়াল পর্যন্ত নেই আশপাশে। ঠিক তখনি আমার মনে হলো, গন্ধটা স্মৃতি থেকে উঠে আসছে। আমার আদিম পূর্বপুরুষদের বুনো ও অশ্লীল জীবন তাদের শরীরে যে গন্ধের জন্ম দিয়েছিল, শতশত প্রজন্মের বাঁধা টপকে আজ রাতে তারা এসে হাজির হয়েছে আমার নাকে এবং আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি কোথায় ছিলাম আর কোথায় আছি। যেন এখন আমি অ্যানথ্রপোলজির ক্লাসে বসে প্রফেসরের বক্তৃতা শুনছি এবং নিজেকে একটু একটু করে খুঁজে পাচ্ছি।

ভাবনার বিষয় হিসাবে এ ধরনের চিন্তা যে বেশ ভালো, সেটা ভাবতে ভাবতেই আবার গন্ধটা ঝাঁপটা মারলো আমার নাকে। এবার আরো উৎকট, আরো তীব্র গন্ধের কারণে দম বন্ধ হয়ে গেল আমার। বমি করতে ইচ্ছা করলো এবং অ্যানথ্রপোলজির সুচিন্তা পালিয়ে গেল তার সব তথ্যপ্রমাণ নিয়ে। ভাবলাম, আমার ঘরটাই এই গন্ধের উৎস এবং সেটাকে এখনি খুঁজে বের করতে হবে। নইলে বাকি রাত আর ঘুমাতে পারবো না।

এবার সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে সবগুলি সুইচ টিপে সারাটা বাড়ি আলোর চিৎকারে ভরিয়ে দিলাম। চারপাশের গভীর কালো অন্ধকারের মধ্যে বাসাটা যেন রাতের মাঝসমুদ্রে সব আলো জ্বালানো একটা জাহাজের মতো ঝলমল করে উঠলো। তারপর শুরু হলো আমার গন্ধের উৎস খোঁজার অভিযান।

ভোরের ঠিক আগে আগে দিগন্ত যখন কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যখন মেটাফিজিক্সের বিদায় নেবার মূহূর্ত প্রায় চূড়ান্ত, সেসময় আলমারির নিচ থেকে বেরিয়ে এলো প্রায় গলে যাওয়া এবং পোকায় ধরা একটা ইঁদুরের মৃতদেহ। আর ভোরের প্রথম পাখির ডাকের মতো জানালার কাছে এসে অ্যানথ্রপোলজি জানিয়ে গেল, আমাদের সবার শরীরেই বোঁটকা গন্ধ আছে। মৃত্যু সেটাকে প্রকাশ করে দেয়।