অমিতাভ পালের সহজ গল্প

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০২১

বিকাল। অফিসগুলির ছুটি হয়ে গেছে। লোকজন বাসাভাঙা পিঁপড়ার মতো বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। আমিও এখন বাসায় যাচ্ছি অফিসের গাড়িতে চড়ে। জ্যামে আটকে থাকা আমার গাড়ির চারপাশের কাঁচ তোলা। জুন মাসের গরম পৃথিবীকে দূরে সরিয়ে দিয়ে গাড়ির ভিতরে বইছে মিহি ঠাণ্ডা বাতাস। আর আমি সেই আরামদায়ক বাতাস উপভোগ করতে করতে সিটে গা এলিয়ে ফুটপাথে হাঁটতে থাকা মানুষের দুর্দশা দেখছি এবং গাড়ির রেডিওতে বাজতে থাকা সুরে রঙিন সব গান শুনছি।

ঠিক তখনি আমার চোখ পড়লো ঘামে জামাকাপড় ভেজা এক অফিস ফেরতার দিকে। একটু স্থূলদেহী লোকটা গরমে ঠিক হাঁসফাঁস না করলেও খুব যে স্বস্তিতে নেই এটা বোঝা যাচ্ছে। পা চালাচ্ছে একটু টেনে টেনে। সারারাত ঘুমানোর পর সকালে তরতাজা হয়ে অফিসে যাবার সময় এরকমভাবে নিশ্চয়ই হাঁটতো না সে। এখন সারাদিনের অফিসের চাপ, জুনের গরম- সব একেবারে জাপটে ধরে হয়রান করে দিয়েছে তাকে।

লোকটা যখন আমার গাড়ির পাশে এসেছে, তখনি দেখলাম তিন চারটা হিজরা উল্টাদিক থেকে লোকটার সামনে এলো এবং একজন তার দিকে বাড়িয়ে ধরলো একটা ঠাণ্ডা জলের বোতল। জলীয় বাষ্প জমে ঘোলাটে হয়ে যাওয়া সেই বোতলটা দেখলে যেকোন তৃষ্ণার্ত ও পরিশ্রান্ত লোক বিনা দ্বিধায় সেটা হাতে তুলে নেবে। লোকটাও তাই করলো এবং আমি গাড়ির ভিতর থেকে আর্তনাদ করে উঠলাম। আমার মন চ্যাঁচাতে লাগলো- সর্বনাশ, ওটা নিয়ো না। ওতে কি মেশানো আছে কে জানে? জল খাবার সাথেসাথে হয়তো কিছু হবে না কিন্তু তারপর কয়েক পা সামনে গেলেই তোমার মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করবে এবং তুমি লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। আর তখন ওই হিজরাগুলি এসে ছিনিয়ে নেবে তোমার সবকিছু। তিনদিন পরে যখন হাসপাতালে তোমার জ্ঞান ফিরবে, তখন তুমি হয়তো হারিয়ে ফেলবে আজই পাওয়া তোমার বেতনের সমস্ত টাকা, মোবাইল ফোন, অফিসের আইডি, এবং দরকারী আরো অনেক কিছুই। আমিতো এইসব হিজরাগুলিকে চিনি। স্বাস্থ্যবান, সবল এই ক্লীবেরা বিভিন্ন সিগনালে আমার গাড়ির জানালার পাশে এসে কাঁচে টোকা দেয় আর ভিক্ষা চায়। ভিক্ষা করায় যে কি সুখ! আর রাস্তায় অচেনা মানুষের দেয়া ডাব, পান- এসব খেয়ে কত মানুষ যে সর্বস্বান্ত হয়েছে, তার খবর কমবেশি সবাই আমরা জানি। এই হিজরাগুলিই যে সেরকম কিছু করছে না, তার গ্যারান্টি কি?

কিন্তু আমার মনের চিৎকার মনের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় থিতিয়ে নিরব হয়ে গেল। আর আমি চোখ বড় বড় করে দেখলাম লোকটা বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে বেশ খানিকটা জল খেয়ে সেটা ফিরিয়ে দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো আর হিজরারাও লোকটাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে হাঁটতে থাকলো উল্টাদিকে। এবার আমি মনোযোগ দিয়ে লোকটাকে দেখতে শুরু করলাম। তার পদক্ষেপে কোন অসামঞ্জস্য ফুটে ওঠে কিনা, কিংবা তার মধ্যে ঢলে পড়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় কিনা, এসব দেখতে দেখতে একবার পিছন ফিরে হিজরাগুলির দিকেও তাকালাম। ওরা হনহন করে হেঁটে অনেকটা দূরে চলে গেছে। গল্প করছে নিজেদের সঙ্গে। পিছনে জল খাইয়ে ফেলে আসা লোকটার কথা যেন মনেই নেই তাদের। ব্যাপারটা আমাকে আরো সন্দিহান করে তুললো। আমি নিশ্চিত, ওরা ভান করছে। জলে যে ওষুধটা মেশানো হয়েছে, সেটা কতক্ষণ পরে কাজ শুরু করবে- সেটা নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবে জানে ওরা। জ্যাম ছোটার পর আর কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়িগুলি যখন ছুটতে শুরু করবে, তখনই শুরু হবে ওদের অ্যাকশন। সামনের মোড়ের ট্রাফিক সার্জেন্টকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখলে কেমন হয়? এতে হয়তো লোকটার বেতনের টাকাগুলি বেঁচে যাবে, মোবাইল হারানোর ধকল পোহাতে হবে না, আইডি হারানোর জিডি করতেও যেতে হবে না থানায়।

লোকটার কথা মনে পড়তেই আবার সামনের দিকে তাকালাম আমি। ফুটপাথের ভিড়ে এখন আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। তাকে ঘিরে কি কোন জটলা তৈরি হবে, নাকি সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত পথচারীরা ব্যাপারটাকে কোন গুরুত্বই দেবে না। স্বার্থান্ধ, নিষ্ঠুর, প্রতিযোগিতায় বেসামাল আর দুর্জন এই ঢাকা শহর আমাদের সবাইকেইতো পাথর বানিয়ে ফেলেছে। আমাদের সময় কই অন্যের দিকে তাকাবার? আমি অবশ্য পুলিশে খবর দেবার কাজটা অন্তত করবো। নাগরিক হিসাবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না?

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখলাম, জ্যাম ছুটে গেছে এবং আমার গাড়িসহ বাকি গাড়িগুলি ছুটতে শুরু করেছে। লোকটার হেঁটে যাওয়ার দিকেই যেহেতু যাচ্ছি আমি তাই ভালো করে নজর দিলাম ফুটপাথের দিকে। কিন্তু কোন জটলার দেখা পেলাম না কোথাও। কাউকে পড়েও থাকতে দেখলাম না মাটিতে। তবে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম জল খাওয়া লোকটা বেশ চনমনে ভাবে হেঁটে যাচ্ছে। খাওয়া জলটুকুই যেন এই চনমনে ভাবটা এনে দিয়েছে তাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম হিজরারাও সবকিছু লুণ্ঠনের জন্য তেড়ে আসছে না।

আমার গাড়িটা এখন আমাকে নিয়ে ছুটছে অবিশ্বাস, সন্দেহ, লোভ আর একাকিত্বে ভরা এক কৃত্রিম ঢাকার দিকে।