আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল

আত্মজীবনী ২

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০২০

১৯৮৯ সালের অক্টোবরের ২তারিখে আমি কাপাসিয়া কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন ফজলুল হক স্যার। খোলা দক্ষিণের দীঘির দিকে মুখ করা ঐতিহ্যবাহী ভবনটিতে অধ্যক্ষের দপ্তরটি সত্যি সুন্দর। আর চেয়ারে যিনি বসে আছেন তিনি ফজলুল হক স্যার। এত সুন্দর মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। দুধে-আলতায় রং যাকে বলে তাঁর গায়ের রং ঠিক তেমনি। তার উপর পরেছেন ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। মনে হচ্ছিল আলো হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। তিনি আমার কাগজপত্র নিলেন এবং কুশল বিনিময় করলেন। আমাকে প্রশংসাও করলেন। সম্ভবত ওই দিনই যোগদান করেছেন আমজাদ ভাই, আইয়ুব ভাই এবং উপাধ্যক্ষ হিসেবে আলী হোসেন স্যার।

ভাইভার দিনই আমার সঙ্গে পরিচয় হয় আইয়ুব ভাইয়ের। পরিচয় থেকেই এই মানুষটিকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। তাঁর হাত দুটি ছোট। অর্থাৎ কনুইয়ের সঙ্গে কব্জি লাগানো। এবং আঙ্গুলগুলোও সুগঠিত নয়। এই মানুষটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন। এরকম শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে অধিকাংশ মানুষ তেমন কিছু করতে পারে না। আর যদি হতদরিদ্র পরিবারের লোক হয়, তা হলে ভিক্ষার পথ বেছে নেয়। কিন্তু আইয়ুব ভাই অসাধারণ যোগ্য মানুষ। নিজের প্রতি তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই প্রথম পরিচয়েই তাঁর কথা বলার ভঙ্গি, আড্ডার মেজাহ, মানুষের সঙ্গে পরিশীলিত আচরণ, রুচিবোধ ও আন্তরিকতা দেখে আমার মনে হয়েছিল এ ধরনের মানুষকেই আমি খুঁজি। এবং আমি নিশ্চিত হলাম যে, আরও একজন বন্ধু পাওয়া গেল। এই জন্য বলছি যে, জীবনের পথ পেরুতে পেরুতে অনেকের সঙ্গেই আমাদের পরিচয় হয়। সেই পরিচয় কখনো কখনো এক জীবন থাকে। কিন্তু পরিচিত সবাই বন্ধু হয় না। আমজাদ ভাই, আয়ুব ভাই পরিচয়ের সীমা পেরিয়ে এক জীবন আমার বন্ধু হয়ে থাকলেন।

একজন সাধারণ উচ্চতার মানুষ ব্লাক বোর্ডের যতটা উচ্চতা পর্যন্ত লিখতে পারেন আয়ুব ভাই সেটা পারতেন না। কিন্তু হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে তাঁকে প্রচুর লিখতে হতো। এবং তিনি প্রচুর লিখতেন। কিন্তু তিনি খুব স্বচ্ছন্ধেই লিখতেন। কোনো একটি জটিল বিষয় তিনি খুব মজা করে উপস্থাপন করতেন। ওই বিষয়ের পটভূমিতে তিনি কৌতুক বলতেন, গল্প বলতেন এবং এমনকি জোক্স বলতেন। অনেক সময় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে বিষয়টিকে বেশ রসঘন করে তুলতেন। ফলে অতি অল্প সময়ে তিনি জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে ওঠেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ ছাড়া তিনি চমৎকার আবৃত্তি করতেন। কোনো রকম সংকোচ না করে তিনি ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের আবৃত্তি করে শোনাতেন। অবিশ্বাস্য ভরাট কণ্ঠস্বরে তাঁর আবৃত্তি শুনে শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হতো। এখনো মনে পড়ে ‘বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে ...’, ‘আমি কি চেয়েছি এত রক্তের দামে...’, ‘খুনের দোহাই লাগে ...’, ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই ...’ উচ্চ কণ্ঠে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লহর এইসব কবিতা আবৃত্তি করতেন আইয়ুব ভাই। পরে দেখেছি, অনেক শিক্ষার্থী তাঁর কাছে আসত আবৃত্তি শেখার জন্য। এভাবে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। কিন্তু তিনি শিক্ষকতার পেশায় থাকেননি। একটি জমাট আনন্দিত পেশা ছেড়ে তিনি চলে যান ব্যাংকিং পেশায়। আমি তাঁকে বারণ করেছিলাম। শুনেছি পরিবারে চাপ ছিল এবং তিনি নিজেও সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ছিলেন। যাই হোক, ব্যাংকেও তিনি ভালো করেছেন। তবে আমার বিশ্বাস তিনি শিক্ষকতার পেশায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে পারতেন।

আয়ুব ভাইয়ের বদৌলতে গাজিপুরে আমাদের একটি আড্ডার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। জোড়পুকুর, দক্ষিণ ছায়াবিথী, উত্তর ছায়বিথী এবং আরও কত জয়গায় যে আড্ডা দিতাম তার কোনো হিসাব ছিলনা। মধুর সেই দিনগুলোর কথা কখনোই ভোলার নয়। দক্ষিণ ছায়বিথী থেকে মেঠো পথ চলে গেছে গ্রামের দিকে, বিলের দিকে, জলাশয়ের দিকে। ওই পথগুলোকে আমার মনে হতো প্রকৃতির অনন্ত ঐশ্বর্যের দিকে কিংবা কোনো এক রহস্যময় আনন্দিত জগতে গিয়ে অনন্তকাল চলছ।

হাসিমুখে মানুষকে জারি দেওয়ার অসাধারণ ভাষা জানা আছে তাঁর। কিন্তু উলটো তাঁকে কখনোই জারি খেতে দেখিনি। কারণ তাঁর জারি দেওয়ার মধ্যেও একটি মিষ্টি সম্পর্কের পরিবেশ বিরাজমান থাকতে দেখেছি।
আইয়ুব ভাই কাপাসিয়া কলেজের পাঠ চুকিয়েছেন অনেক আগে। সম্ভবত তিনি বছর দুয়েক শিক্ষকতা করেছেন। তারপর উত্তরা ব্যাংক এবং বর্তমানে এনসিসি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। মাঝে তিরিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু সম্পর্কটা কখনোই ফিকে হয়নি। আয়ুব ভাই যখন উত্তরা ব্যাংকে চাকরি করেন তখন মগবাজার মোড়ে তিনি একটি ম্যাচে থাকতেন। ঢাকায় আমার তখন থাকার জায়গা ছিল না। কখনো কখনো আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকতে হতো। বিশেষ করে আমি আজিমপুর এক আত্মীয়ের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও কাপাসিয়া কলেজের চাকরি জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি। ওই বাসাটি নিজেদের বাসা বলেই জ্ঞান করতাম। কিন্তু তবুও বন্ধুদের সঙ্গে থাকার আনন্দ মুক্তির আস্বাদ পাইয়ে দেয়। সুতরাং তারপর কাপাসিয়া থেকে ঢাকা এলেই আইয়ুব ভাইয়ের সঙ্গে তার ম্যাচে থাকাতাম এবং তাজ বা যমুনায় হোটেলে গিয়ে খেতাম।

কাপাসিয়া কলেজে আমার থাকা ও খাওয়ায় একদিনের জন্যও কোনো সমস্যা হয়নি। যেদিন ওখানে যোগদান করলাম সে দিন থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করি। আর এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেন তাজউদ্দী ভাই এবং আমজাদ ভাই। আইয়ুব ভাইয়ের পৈত্রিক বাড়ি গাজীপুর শহরে, জোড়পুকুর সংলগ্ন। তিনি প্রতিদিন গাজীপুর থেকে কলেজ করতেন। আর আমজাদ ভাই তো কাপাসিয়ার মানুষ। সুতরাং তাদের খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা নেই। এবং সুখের বিষয় হলো, আমারও খাওয়া-দাওয়ার কোনো চিন্তা ছিল না। আয়ুব ভাই দুপুরে আমাদের সঙ্গে খেতেন এবং মাঝেমধ্যে আমজাদ ভাইও ভাগ বসাতেন।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে জমিদারদের আবাসন-সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে যে ভবনটির কথা ইতোমধ্যে বলেছি, তার পূর্ব পাশে ছোট স্কুল ঘরের মতো একটি ঘর ছিল। তিন-চারটি রুমের এই টিনের ঘরটিতে বিবাহিত ও অবিবাহিত মিলে আমারা ছয়-সাত জন ব্যাচেলর থাকতাম। এর সামনেই পূর্ব পাশে ছিল রসুইঘর। মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না কিংবা বিকল্প হিসেবে ছিল ইলেকট্রিক চুলা। খাওয়ার জন্য একটি টেবিলও ছিল। রান্না করত নূরজাহান। একটু মোটাসোটা মানুষ। মুখের গড়নে সুখিসুখি ভাব। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সারাক্ষণ হাসিখুশি। কিছুতেই না নেই। যে যা হুকুম করবেন নূরজাহান তাই করত। ওর হাতে জাদু ছিল। যা ছুঁয়ে দেবে তাই অমৃত। শাক, ভর্তা, ডাল, ঝোল, মাছ, তরিতরকারি যা সে রান্না করত সবই মজা হতো।
বাজার করার উস্তাদ ছিলেন তাজউদ্দিন ভাই। সঙ্গে যেতেন কাদের ভাই, চঞ্চল দা, অখিল ভাই এবং আলম ভাই। কিন্তু আমার ডাক পড়েছে এমন ঘটনা বিরল। তারা ধরেই নিয়েছিলেন, “এই লোক সংসারের কিছু বোঝে না। জীবনে হাটবাজার কখনো করেনি । একে নেওয়ার চেয়ে না-নেওয়াই মঙ্গল।” অবশ্য কখনো কখনো আমি ইচ্ছা করেই তাদের সঙ্গে হাঁটা দিতাম। কারণ হলো তাজউদ্দিন ভায়ের সঙ্গ পাওয়া। এই মজার মানুষটি বাজার করতে গিয়ে দোকানিদের সঙ্গে কী করে তা দেখার জন্যই ছিল আমার যাওয়া।
প্রথম দিন তাজউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে বাজারে গিয়ে আমি খুবই অবাক হয়েছি। সবাই তাঁকে চিনে। সবার সঙ্গেই মজার সম্পর্ক। সবাই তাঁকে সমীহ করে। কিন্তু তাজউদ্দিন ভাই ঠাট্টা করতে ছাড়েন না। মাছের দোকানে গিয়ে বলছেন, “কি ছবুর, মাছ তো বালাই, তয় মাথা যে ছোড ছোড লাগতেছে। বিষয় কী?”
ছবুর বুঝতে পারছে না কী বলবে। সে কেবল হাসে। তাপপর বলল, “কী যে কন স্যার, মাছের মাতা আবার ছোড অয়নি?”
“হ হ, ছোডই। এহন কও, ছোড মাথার মাছের দাম কত?”
আমি কিছুতেই হাসি থামিয়ে রাখতে পারছিলাম না। পেট ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু তাজউদ্দিন ভাই সিরিয়াস। মুখে হাসির চিহ্নও নেই। আমাকে কেবল চিমটি দেন। মানে হলো, “হাইসেন না, দাম কিন্তু কমায়লাইছি।”
চিংড়ি মাছের দোকানে গিয়ে বড় বড় চিংড়ির একটি হাতে নিয়ে কী যেন পরখ করলেন। তারপর দোকানিকে বললেন, “ইচা মাছ তো বড়ই, তয় শইল পাও কম কিলিগা? পাও তো কম।”
“স্যারে কী যে কন! ইচা মাচের শইল পাও আবার কম থায়েনি?”
থায়ে থায়ে। মাইনসের শইল দেহেন নাই, বুইড়া আঙ্গুলের পাশ দিয়া আরেকটা ছোড আঙ্গুল অয়। মাছের ওই রহম। কমও বালা না, বেশিও বালা না।” তারপর কাদের ভাইকে ডেকে বলছেন, “অই কাদের ভাই, ইচা মাছের শইল পাও কম। নিমু?”
কাদের ভাই কী বলবেন, হাসতে হাসতে কুটি কুটি। জীবনে এমন কথা শোনেননি যে, চিংড়ি মাছের শরীরে পা কম হয়।
আমি অবাক হয়ে দেখতাম, সত্যি হাসিখুশির মধ্যে, ইয়ারকি-ফাজলামির মধ্যে মাছের দাম কমে গেছে। জীবনের এই পাঠ কোনো দিন ভুলিনি। সম্পর্কে হার্দিকতা পণ্যের মূল্যে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে, প্রথম তার সঙ্গে পরিচিত হলাম। এর উলটো দিকও যে নেই, তা নয়। তবে সেটা সম্পর্ক নয়, স্বার্থ। আত্মীয় পরিবেষ্টিত ওই মফস্বল শহরে দেখেছি, সম্পর্ক খুব মূল্যবান ব্যপার। ঝগড়া আছে, বিবাদ আছে, মারামারি আছে, এমনকি কাটাকাটিও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক টিকে থাকে। শত শত বছর ধরে সম্পর্কের বিপুল বিস্তারকে আশ্রয় করে মানুষগুলো পরিচয়ের ধ্বজা উচিয়ে চলছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলি।
বছর দুয়েক আগের কথা। কোরবানির জন্য আমার ছেলে গোরু কিনতে গিয়েছে আফতাব নগরে। গোরু পছন্দ হয়েছে, কিন্তু টাকায় কুলোচ্ছে না। বললাম গোরুসহ লোকটিকে নিয়ে চলে এসো। তাই হলো। যুবকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি কোথায়। বলল, “কাপাইস্যা”। বললাম, “আমি তো কাপাইস্যা কলেজের প্রফেসার ছিলাম।” লোকটি বলল, “কনকি স্যার, আমার মামা তো কাপাইস্যা কলেজের পরফেসর ছিল। নাম তাইজুদ্দিন।” আমি বললাম, “এখন টোক কলেজের প্রিন্সিপল। তাই না?”
“হ স্যার, আমার মামা।”
সঙ্গে সঙ্গে আমি তাজউদ্দিন ভাইকে ফোন করে ভাগ্নের তথ্যাদি জানালাম। তিনি দূর সম্পর্কের ওই ভাগ্নেকে নির্দেশ দিয়ে দিলেন, প্রত্যেকবার যেন আমার বাসায় গোরু পৌঁছে দেয়। সুতরাং সম্পর্কের ব্যাপারে কে গোরুর বেপারি, আর কে অধ্যক্ষ তার কোনো ইতরবিশেষ নেই। সম্পর্কের ধ্বজা সবার উপরে।
খেতে বসে শুরু হতো তুমুল আড্ডা। আর সেই আড্ডার শিরোমণি তাজউদ্দিন ভাই। তবে কারো চেয়ে কেউ কম পোংটা ছিলেন না।
মোটাসোটা ফর্সা অখিল কুমার সাহা। সহজ-সরল মানুষ। অখিল ভাই কথা বলার আগে হাসতে শুরু করতেন।
তাজউদ্দী ভাই বলতেন, “অখিল বাবু, আমনে আগে হাইসা শেষ কইরা লন। তার পরে কথা কইয়েন।”
তাজউদ্দী ভাইয়ের এই খোঁচায় অখিল বাবুর হাসা থেমে যেত না। এবং এত হাসাহাসির পরে তিনি যা বলতেন সেটা হাসির কথা হতো না। অতি মামুলি কথা। এমন সাধারণ কথা বলতে গিয়ে মানুষ এত হাসতে পারে, এটা ভেবে হাসতে হাসতে আমাদের পেট ফেটে যাওয়ার অবস্থা হতো। এতে অখিল ভাইকে কখনো বিব্রত হতে দেখিনি। তিনি মজাই পেতেন।
খাটোখুটো শ্যামলা ছালাম ভাই, সারাক্ষণ আনন্দে থাকতেন। মনে হতো চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সারাক্ষণ কী নিয়ে যেন হাসতেন। মাঝেমধ্যে তার দুএকটি বের হয়ে আসত। আর হাসতে হাসতে আমাদের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। চিকনচাকুন লম্বা কাদের ভাই চিকন বুদ্ধির ওস্তাদ ছিলেন। ম্যাচে যতক্ষণ আছেন, কাঁধে একটি গামছা তাকে রাখতেই হতো। ওটা দিয়ে অযথাই হাত মুছবেন, মুখ মুছবেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তার বাড়াবাড়ি আমরা বেশ উপভোগ করতাম।
কলেজের পাশে মোহর আলী স্যারের বাসা। ভাবীর সঙ্গে ছিল কাদের ভাইয়ে সত্যিকারের দেবরের সম্পর্ক। বড় মেয়ে ডলি ছিল সরাসরি তাঁর বিএসসি ক্লাসের ছাত্রী। একটি মেয়ে পড়ত এইচএসসিতে। নিজের মেয়ের মতো ওদের যত্ন নিতেন কাদের ভাই। ডলি, বিএসসি-তে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিল। এখন ওই মেয়ে আমার বন্ধুপত্নী। ছাত্রগতপ্রাণ এই মানুষটিকে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের অনেক সময় দিতে। বিশাল দেহী হিসাব বিজ্ঞানের রেজাউল সাহেব খুব সমস্যায় থাকতেন। কী বলতে কী বলে ফেলবেন, বলাটা ঠিক হবে কি না- ইত্যাদি ভেবেচিন্তে তিনি যে কথাটা বলতেন, অধিকাংশ সময় তা সুখকর হতো না। সবার চেয়ে ভালো এবং সবার চেয়ে বুদ্ধিমানের মতো কিছু একটা বলতে হবে, এসব ভাবতে ভাবতে তিনি বেশ অসুবিধায় থাকতেন।
নিরঞ্জন বাবু বলতেন, “রেজা ভাই, এত চিন্তা করার কী আছে! কী কইবেন কইয়া ফেলেন। আমরা কেউই কিছু মনে করতাম না।”
এই খোঁচাটা আবার তিনি ভালোই বুঝতেন এবং মন খারাপ করে রুমে চলে যেতেন। মেধাবী এবং সুদর্শন চঞ্চল ভাই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে। আমার শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার্থীদের এত সময় দিতে আর কাউকে দেখিনি। আর গুরুমুখী শিক্ষার যে ঐতিহ্য আমদের জাতিগত ইতিহাসের মূলমন্ত্র, চঞ্চল দার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ছিল ওই রকম সম্পর্ক। তাঁর এই যত্নে প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী বিএসসিতে প্রথম শ্রেণি পেত। তাঁকে উচকে দেওয়ার জন্য ক্রিকেটের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই চলত। তিনি ক্রিকেট খেলার কি যে ভক্ত ছিলেন! শিশুদের মতো তিনি নিজেও বেট-বল নিয়ে নেমে পড়তেন। এই প্রাণবন্ত মানুষটি বহুদিন ধরে পার্কিন্সনে আক্রান্ত।

ছাদেক সাহেব ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। আমার সব সময়ই মনে হতো এ এক রহস্যময় মানুষ। কলেজ শেষে কোথয় যায়, কোথায় থাকে, কারা তার বন্ধু, কাদের সঙ্গে বিচিত্র প্রয়োজন তা কিছুই জানতাম না আমরা। বলা যায়, সহকর্মীদের তিনি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতেন। অনেক দিন পরে তার সম্পর্কে যা জানা গেল সেটা সুখকর নয়।
প্রতিদিনই আমজাদ ভাই আসতেন আড্ডা দিতে। কথা মানে হাসি, হাসি মানে কথা-এই হলেন আমজাদ ভাই। দুধে-আলতায় রং বলে একটি কথা আছে, আগেই বলেছি। আমজাদ ভাইয়ের গায়ের রংও ঠিক তেমনি। না হেসে তিনি কথা বলেছেন, এমনটা কেউ কখনো দেখেনি। সত্য কথা সোজা করে বলার অপ্রীতিকর স্বভাবও তাঁর আছে। এর জন্য বহুবার তাঁকে খেশারত দিতে হয়েছে।
আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে বহু বছর দরে আমার যে এত গভীর সম্পর্ক তার পরেও নারী সম্পর্কিত কোনো কথা, নারীর দেহ, প্রেম, যৌনতা- এসব নিয়ে কোনো কথা কখনোই হতো না। আমার মনে হতো এই লোকটির মধ্যে প্রেমের কোনো বালাই নেই, কোনো রকম রোম্যান্টিকতার লেশমাত্রও নেই। নারী বিষয়ক এক মায়ার জগৎ থেকে তিনি সম্পূর্ণ নির্বাসিত। আসলে তাঁর সঙ্গে ভব্যতার ওই জায়গাটুকু সব সময়ই রক্ষা করা হয়েছে। ওই সীমাটুকু কখনোই অতিক্রম করা হয়নি। কিন্তু একদিন জানতে পারলাম, ডুবে ডুবে অনেক জল তিনি খেয়েছেন। আমার তখন ভিরমি খাওয়ার দশা। খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে, কোন মহীয়সী নারী এই পাষাণের বুকে ফুল ফুটিয়েছেন। একদিন তাকে দেখলাম। তিনি আমারই বিএ ক্লাসের ছাত্রী সরকার ওয়াহিদা জাহান রোজি। সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে বিনয়ী এবং সবচেয়ে ভিতরবুদ্ধির এই মেয়েটির প্রেমে পড়েছেন আমজাদ ভাই। একেই বলে, ‘রতনে রতন চিনে’।
এখন তাদের কথা বলার নিরাপদ জায়গা আমার রুমটি। গবেষণার কাজে ক্লাসরুম সংলগ্ন ওই রুমটি আমাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তারা এলে আমাকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে হতো না। কেননা এই যুগল নিজেদের অবস্থা, অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে খুবই সংবেদনশীল। একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যে ভাষায় কথা বলে, আমজাদ ভাই ও রোজি সে ভাষায়ই কথা বলে এবং রোজি যত না কথা বলে আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে, তার চেয়ে বেশি বলে আমার সঙ্গে। জমাট এই আড্ডার সময় অনেক শিক্ষার্থী আমার রুমে আসে-যায়, তাতে আমাদের কারোরই কোনো সমস্যা হয় না। এবং খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো, ছাত্রী-শিক্ষকের দীর্ঘ দিনের এই প্রণয়ের বিষয়টি কোনো দিন কেউ জানতে পারেনি এবং এমন অবস্থাতেই একদিন তাদের বিয়ে হয়ে গেল। আমি তখন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষক। বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল কি না এখন আর মনে ইে। সুতরাং আমজাদ ভাইকে ফোনে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে এবং আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিলাম। ঘটনাটি আমার জন্য বেশি তাৎপর্যময় ছিল বলেই সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলাম। রোজি এখন সরকারি স্কুলের শিক্ষক এবং তাঁর বড় কন্যা এমবিবিএস পড়ছে। হায় অস্থিরমতি সময়!
আমজাদ ভাই আমাকে কতটা ভালোবসতেন তার একটি প্রমাণ দিই। কোনো একটি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমি কি যেন কি ছিলাম। সুতরাং শিক্ষকদের উদ্দেশে একটি নোটিশ লিখে আমি স্টাফ রুমে রেখে দিই। উদ্দেশ্য হলো শিক্ষকগণ অবহিত হয়ে স্বাক্ষর করবেন। আমি তখন একটি ক্লাসে ছিলাম। আমাদের বিদগ্ধ সিনিয়র শিক্ষকগণ ওই নোটিশটি নিয়ে বেশ হাসি-তামাশা শুরু করেন। এর কিছু বানানের নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দিচ্ছিলেন এবং আমার পড়াশোনার নাজুক অবস্থা নিয়ে ঠাট্টায় মেতে উঠেন। আমজাদ ভাই তখন ওখানে বসা ছিলেন। আমাকে এতটা অপমান ও অপদস্ত করছে তা তিনি সহ্য করতে না পেরে সোজা আমার ক্লাসের সামনে এসে হাজির হন। তাঁকে খুবই রাগান্বিত মনে হচ্ছিল। তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন, “ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসো। জরুরি কথা আছে।” আমি বললাম, “ক্লাস প্রায় শেষের দিকে। আপনি যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আসছি।” কিন্তু তিনি কিছুতেই শুনলেন না। অগত্যা কয়েক মিনিট পূর্বেই আমাকে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে বললেন, “কী ঘণ্টার নোটিশ লিখেছ, এত বানান ভুল? সিনিয়র স্যারেরা হাসাহাসি করছেন।” আমি দমে গেলাম। এত বানান ভুল হওয়ার কথা নয়তো। আমি নোটিশটি হাতে নিয়ে দেখি শুদ্ধ বানানগুলোকেই তারা ভুল বলে তিরস্কার করেছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম যে, শব্দগুলোর নিচে লাল দাগ দিয়েছেন কে? একজন স্যার বললেন, “মান্নান সাহেব, বানানগুলো ভুলা না?” আমি বললাম, “স্যার, বানানগুলো শুদ্ধ। আমি দুই মিনিটের মধ্যে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানটি নিয়ে আসছি। আমি কথা না বলি। আপনারাই দেখে নেন।” তাদের আমি বানানগুলো দেখালাম। এবং বললাম প্রথম ভুক্তিকে হালনাগাদ শুদ্ধরূপ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শব্দগুলো হলো ‘এতদ্দ্বারা’, ‘ন্যূনতম’, ‘প্রতিযোগিতা’, ‘খেলাধুলা’ ইত্যাদি। একমাত্র `এতদ্দ্বারা` শব্দটির বহুল প্রচলিত ভুল বানান হলো ‘এতদ্বারা’। এই শব্দটির বানান ভুল মনে হতে পারে। কিন্তু বাকি শব্দগুলোর বানান কেন তারা ভুল মনে করলেন তা আমরা কাছে খুবই পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। অবশ্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেইদিন আমি দেখেছি, আমজাদ ভাই কী পরিমান খুশি হয়েছিলেন। আমি অপমানিত হব এটা তিনি ভাবতেও পারতেন না। বের হয়ে আমাকে বলেন, “তোমাকে আজ বিকালে চিত্ত দার দোকানে মিষ্টি খাওয়াব।” এবং ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমজাদ ভাই সেদিন সন্ধ্যায় মেসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছেন। কিন্তু মিষ্টি খাওয়ানোর উপলক্ষ প্রকাশ করেননি। কিন্তু গোপন কথাটি সবসময় গোপন থাকে না।

মূলত আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েই আমি কাপাসিয়ার স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হই। সেই সময় বাস স্টেশনের সঙ্গে লাগোয়া একটি নতুন টিনসেড বাড়িতে থাকতেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা শহিদুল্লাহ ভাই এবং জসিম ভায়ের পরিবার। শহিদুল্লাহ ভাই ১৯৮৬ তে এমপি হয়েছিলেন সিপিবি থেকে- আট দলীয় জোটের নৌকা মার্কা নিয়ে। পরে উনি আওয়ামী লীগে যোগদেন এবং কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এই দুটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আমরা প্রায়ই বিকেলে আড্ডা দেওয়ার জন্য ওই বাড়িটিতে যেতাম। আড্ডার জন্য আদর্শিক মিল খুব ঘুরুত্বপূর্ণ বলেই আমার ধারণা। ওই পরিবার দুটির সঙ্গে এই মিল ছিল। অথচ আমরা রাজনীতি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা করতাম না বললেই চলে। জসিম ভাইয়ে এক পুত্র ও এক কন্যা এবং শহিদুল্লাহ ভাইয়ের দুই কন্যা। ওরা তখন খুব ছোট ছিল। ভাবীরা আমাদের কিযে সমাদর করতেন! আপন দেবর-ভাবীর মতোই একটি অধিকারের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ওনাদের সঙ্গে। এই পরিবার দুটি যখন নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে তখন আমি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষক। কিন্তু কাপাসিয়ার প্রতি আমার আকর্ষণ কখনোই কমেনি। সুতরাং আমি যখনই ঢাকা থেকে কাপাসিয়া গিয়েছি তখনই চেষ্টা করেছি শহিদুল্লাহ ভাই ও জসিম ভাই এবং ভাবীদের সঙ্গে দেখা করতে।
আমার স্মৃতিশক্তি সম্ভবত শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে। আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে বাজারে আড্ডা দিতে গিয়ে কাপাসিয়ার যে সব বন্ধুরা আমাদের নিত্য সহচর ছিলেন তাদের অধিকাংশের নামই ভুলে গেছি। কিন্তু খোরশেদ ভাইয়ের নাম ভুলিনি। তিনি কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন সম্ভবত কাজাকিস্তানে। প্রত্যেকবার যাওয়ার সময় তিনি বিশ-ত্রিশ কেজি কাচা হলুদ নিয়ে যেতেন। ওই হলুদ বিক্রির টাকায় তার সব ধরনের খরচপাতি মিটে যেত। ওখানে হলুদ নাকি খুব একটা হয় না। কিন্তু বিয়েতে প্রচুর কাচা হলুদ লাগে। ফলে উচ্চ মূল্যে ওদের কাচা হলুদ কিনতে হয়। আর এই সুযোগটিই গ্রহণ করেছেন খোরশেদ ভাই। এভাবেই তিনি পড়াশোনা শেষ করেন।
বিকেল বেলায় আমরা অধিকাংশ সময় তাজউদ্দীন ভাইয়ের নেতৃত্বে যেতাম চিত্ত দার হোটেলে মিষ্টি খেতে। দেখা যেত আমাদের দেখেই অনেক শিক্ষার্থ টেবিল ছেড়ে দিচ্ছে কিংবা চলে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন ভাই ওই ছেলে-মেয়েদের বলতেন, “বসো বসো বাবা। তোমরা চলে গেলে তো চিত্তের লস। আমাদের খাওয়াইয়া তো ওই লস পোষাবে না। বসো বসো। খাইয়া টেহা দিয়া যাও। আমাগো খাওয়ার টেহা কিন্তু তোমরা দিতে যাইও না।” কিন্তু কখনো কখনো দেখা যেত, কোনো ছাত্র ঠিকই আমাদের বিল দিয়ে চলে গেছে।
চিত্ত দা খুব যত্ন করে আমাদের মিষ্টি পরিবেশন করত। ওর সঙ্গে আমাদের প্রগাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। মনে আছে, চিত্ত দার বিয়ের সময় আমরা দলেবলে গিয়েছিলাম নেত্রকোণা। খুব আড্ডা আর আনন্দের ভেতর দিয়ে মনে রাখার মতো সময় কাটিয়েছিলাম।
চিত্ত দার হোটেল থেকে বের হয়ে রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলত আড্ডা। এই অড্ডা যে সবাই এক সঙ্গে দিতাম, তা নয়। একসময় দেখা যেত প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ বলয়ে আড্ডা দিতে চলে গেছে। কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে আমার বৈকালিন আড্ডা হতো কমই। আমজাদ ভাই আর আমি চলে যেতাম স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে।

কলেজের পাশেই ছিল মোহর আলী স্যারের বাসা। তাঁর বাড়ি কাপাসিয়াতেই। তিনি এখানে নতুন বাড়ি করেছেন। আর এই বাড়িতে অসংখ্য বৃক্ষের সমারোহ। মোহর আলী স্যারের তিন কন্যা ও এক পুত্র। কন্যারা সবাই কাপাসিয়া কলেজে পড়ে। বড় মেয়ে ডলি খুবই মেধাবী। বিএসসি-তে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে। একদম কলেজ লাগোয়া এই বাড়িটিতে আমাদের ছিল দলেবলে নিত্য আড্ডা। মোহর আলী স্যার খাটের উপর শুয়ে-বসে থাকতেন। ভাবী সরাক্ষণ তাঁর মাথায় পায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন । মনে মনে ভাবতাম, আহারে, এমন একটি বউ যদি জীবনে জুটত! আর এর মধ্যেই চলত আমাদের আড্ডা। দুনিয়ার যত জোক্স, যত চুটকি, যত ধাঁধা, যত কথা, কুকথা, আকথা- সবই চলত মোহর আলী স্যারের বাসায়। সেই বিপুল আড্ডায় ভব্যতা ও সৌজন্যের একটি অলিখিত সীমা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভাবী এককথায় সর্বংসহা মহিলা। কত সন্ধ্যায় আমাদের কত আবদার যে তাঁকে রাখতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একজন হয়তো বলল, “ভাবী মুড়ি বানান। মরিচ বেশি দিবেন। ফালতু মরিচ। ঝাল কম।”
আরেক জন বলল, “পেয়াজ বেশি দিবেন না ভাবী। পেয়াজ কম হবে। পেয়াজ খেলে মুখে গন্ধ হয়।”
অখিল বাবু কথাটা এমনভাবে বলতেন যেন এই প্রথম জানা গেল যে, পিয়াজ খেলে মুখে গন্ধ হয়।
অখিল বাবু বিয়ে করেননি। সুতরাং মুখে পেয়াজের গন্ধ হলে তার কী সমস্যা, এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল। আর বিয়ে করার সঙ্গে মুখে পেয়াজের গন্ধের কী সম্পর্ক, সেটাও ছিল জটিল এক সমস্যা। এর মধ্যে কাদের সাহেব বলবেন, “ভাবী, ঠান্ডা লাগছে। সরিষার তেল দেন। একটু বেশি কইরা দিয়েন।”
আমাদের এই বিচিত্র আবদার শুনতে শুনতে ওই মহিলার মুড়ি বানানোর আনন্দটা বেশ ঘনিভূত হয়ে উঠত। এবং কে কী আবদার করেছে তার প্রতি বিন্দুমাত্র পরোয় না করে তিনি যে মুড়িটা বানিয়ে আনতেন তা রীতিমতো অমৃত হয়ে উঠত। আমরা আমাদের বিচিত্র আবদারের কথা ভুলে গিয়ে মজা করে মুড়ি খেতাম।
এই বাড়িটিতে আমাদের অনেক অনেক সন্ধ্যা নানা রকম খাবারের আবদার আর আড্ডায় মুখর হয়ে উঠত। আর এই বাড়ির মেয়েদের ব্যবহারের শোভনতা, আন্তরিকতা ও তাদের আনন্দ আমাদের আড্ডাগুলোকে আরও মধুর করে তুলত। মাঝেমধ্যে ওই বাড়ি থেকে মেসের সবাই নিমন্ত্রণ পেতাম, “আজ বিকেলে মেসে রান্না হবে না। মোহর আলী স্যারের বাড়িতে দাওয়াত। মেসের বাইরে থেকে থাকবেন আমজাদ ভাই।” ইত্যাদি।
একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমাদের টিনসেড মেসের সামনেই ছিল বেশ উঁচু একটি নারকেল গাছ। আমি, তাজউদ্দিন ভাই এবং কাদের ভাই ওই গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। মেসের ভিটিতে পা রাখার সঙ্গ সঙ্গে বর্জপাতে ওই গাছটি পুড়ে যায় এবং গোড়া পর্যন্ত অঘাত এসে পৌঁছোয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমরা তিনটি প্রাণী বেঁচে যাই। আল্লাহর অসীম রহমতের কথা কি ভোলা যায়। সেই আমরা তিন জন ওই ঘটনার পরে তিরিশ বছর ধরে এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে আছি।
টিনের দোচালা যে ঘরটিতে আমরা থাকতাম ওই ঘরটি পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না। সুতরাং আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে কলেজের লম্বা দ্বিতল ভবনের পশ্চিম পাশের নিচ তলায় একটি অব্যবহৃত বেশ বড় রুম আমার জন্য বরাদ্দ করা হলো। আমার গবেষণার জন্য এই রুমটি খুব দরকার ছিল। পরে এক সময় আয়ুব ভাই এবং এক সময় নিরঞ্জন বিশ্বাস আমার সঙ্গে ওই রুমে অবস্থান করেছেন। আমার অত্যন্ত প্রিয় এই দুইজন মানুষের কথা কখনই ভুলার নয়।

মোল্লা স্যারের মতো রসিক মানুষ আমি আর দেখিনি। সব সময় কথা বলতেন প্রতীকী ভাষায়। আর সেই ভাষা হলো যৌনতার প্রতীক। কী শিক্ষার্থী, কী সহকর্মী কী আত্মীয়-স্বজন সুবিধা বুঝে সর্বত্রই তিনি এই ভাষায় কথা বলতেন।
কলেজে পরীক্ষা চলছে। অর্থনীতির পুষ্প আপাকে মোল্লা স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “পুষ্প, তোমার ডিউটি কোথায়?”
পুষ্প আপা বললেন, “স্যার, নিচ, ১ নম্বর রুমে।”
এরপর তাজউদ্দিন ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাজউদ্দিন, তোমার ডিউটি কোথায়?”
তাজউদ্দিন ভাই হয়তো বললেন, “আমার ডিউটি উপরে ৫ নম্বর রুমে।”
মোল্লা স্যার তখন অবশ্যই বলবেন, “হ, পুষ্পের ডিউটি নিচে অইলে তোমার তো উপরে অইবই।”
স্যার যখন সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে স্টাফ রুমে আড্ডা দিতেন, তখন আমারা কোনো কোনো জুনিয়ররা স্টাফ রুমে ঢুকতে চাইতাম না। তো কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। তিনি বলতেন, “আরে আসেন আসেন, বসেন। আপনারা এখন আর কেউ জুনিয়র না। বিয়েসাধি করেন আর না করেন- জুনিপোকা দেখতে বাকি নেই কারোরই।”
আমি একবার মহা বিপদে পড়েছিলাম। স্টাফ রুমে স্যার একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। অন্য সিনিয়র স্যাররা চেপে চেপে হাসছেন। বোকার মতো আমি তখন গিয়ে বসলাম স্যারের পাশে। স্যার মেয়েটিকে বলছেন,“শোন মেয়ে, এটা হলো করার বয়স। করতে হবে। যখনকার কাম তখন করতে হয়। এই যে দেখ, তোমাদের মান্নান স্যার। করাকরির কোনো চিন্তা নাই। এইডা অইল?”
আমি লজ্জায় মারা যাচ্ছি। আর ওই বোকা মেয়েটা কী বুঝে না-বুঝে হাসছে।
মোল্লা স্যারের স্বভাবের এই যে অবয়ব, এটা ওনার সঙ্গে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। এক সময় আমরাও ওনার সঙ্গে বেশ ফ্রি হয়ে গেলাম। বাজারে স্যারের ঔষধের দোকান ছিল। বিকেলে মাঝেমধ্যে আমরা ওখানে আড্ডা দিতে যেতাম। তবে স্যার তেমন কিছু খাওয়তেন-টাওয়াতেন না। দু-একবার চায়ের কথা বলেছন। কিন্তু দেখতাম, চা আসতে দেরি হচ্ছে। সুতরাং আমরা চলে আসতাম। তাজউদ্দিন ভাই বলতেন, “দেখেন, চাওয়ালাকে হয়তো বলে দিয়েছে, “চায়ের কথা আমি যতই বলিনা কেন, আমার দোকানে যেন কখনই চা না আসে। আর বিস্কুট? খবরদার, না।”
আর বিপদভঞ্জন স্যার ছিলেন আমাদের প্রাণের মানুষ। এত সহজ সরল বিনয়ী এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল হৃদয়বান মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। বাজারে স্যারের ছিল হোমিওপ্যাথ চিকিৎসার দোকান। বিকেলে দলেবলে আমরা ওই দোকানে যেতাম। আর এটা খাওয়া, ওটা খাওয়ার বায়না ধরতাম। প্রায় প্রতিদিনই তরুণ শিক্ষকদের কোনো না কোনো দল স্যারকে জ্বালাতেন।
স্যারের হোমিওপ্যাথ চিকিৎসায় কেউ কোনো দিন ভালো হয়েছে কি না জানি না। কিন্তু আমার ঠোঁটের একটি শক্ত মাংসপিণ্ড সারেনি। কেন সারেনি সেই নিয়ে মোল্লা স্যারের ব্যাখ্যা অন্য। তিনি বলেন, “প্রত্যেক ঔষধের সঙ্গে অনুপান লাগে। ঠোঁটের কাজ ঠোঁটকে যদি করতে না দেন তা হলে তো শক্ত হবেই। বিপদভঞ্জন বাবুর ঔষধের কী দোষ? মনে করবেন না, ওনার ঔষধে কেবল শক্তই হয়। কখনো কখনো নরমও হয়। আপনারটা নরম না হলে আপনার দোষ। বিপদভঞ্জন বাবুর কোনো দোষ নাই। উনি বিপদ ভঞ্জন করার জন্যই আপনাদের নিয়ে সারাক্ষণ বিপদে থাকেন।
মোল্লা স্যার এবং বিপদভঞ্জন স্যার এখন আর বেঁচে নেই। আনন্দিত এক জীবন যাপন করে ওনারা বিদায় নিয়েছেন। চলবে