আমার বন্ধু শবনম

উপন্যাস ৩

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০২০

রাত সাড়ে দশটার দিকে শবনমের ফোন, আপনের লগে দুই-তিনদিন দেখা হইব না। কথাও হইব না।
কেন? দুই-তিনদিন কী কাজ তোমার?
শবনমের হাসি শোনা যায়, কুনো কাম নাই। আত্মীয়রা ধইরা আনছে। দুই-তিনদিনের আগে বোধায় ছাড়ব না।
মানে?
এবার খোলাসা করে শবনম, হোটেল থাইকা খইদ্দারসহ আমারে ধইরা আনছে পুলিশ।

থানায় পৌঁছে দেখি ফটোশেসন চলছে। ছয়জন পুরুষ আর চারজন নারী। রীতিমতো উৎসবের আমেজ। কেউ মুখ নিচু করে রাখছে, কেউ ওড়না দিয়ে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে ধমক, এই সামনে তাকা। কাপড় সরা। পরিষ্কার মুখ দেখা যায় এমন করে দাঁড়া। এখন মুখ ঢাকিস ক্যান? আগে মনে ছিল না?

ভাগ্যক্রমে ওসি সাহেবকে পাওয়া যায়। তার ঘরভর্তি মানুষ। চা চলছে, গল্প চলছে। বোঝা গেল বেশিরভাগই কোনো-না-কোনো পত্রিকার রিপোর্টার। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কেউ আমাকে খেয়াল করে না। কর্ণ বা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গলাখাঁকারি দিই। লাভ হয় না। শেষে চেয়ারগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে ওসি সাহেবের যতখানি কাছে যাওয়া সম্ভব গিয়ে বলি, এক্সকিউজ মি!

ওসি সাহেব আমার দিকে তাকান। মানুষ মেপে নেওয়া দৃষ্টিতে তাকান। তারপর একটু নড়ে উঠে বলেন, কী ব্যাপার? বলেন। বসেন না, বসেন।

তার সামনের টেবিলের সামনে বসা মানুষগুলো কেউ তো চেয়ার ছাড়বে না। কোনো চেয়ারই খালি নেই। আমি বলি, ঠিক আছে। আমি দাঁড়িয়েই বলি।
আচ্ছা বলেন।
আমি এসেছি একটি মেয়েকে নিয়ে যেতে।
মানে? ওসি সাহেবের ভুঁরু কোঁচকানো।
আজ রেইড দিয়ে হোটেল থেকে যে মেয়েগুলোকে খদ্দেরসহ ধরে আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে শবনম নামে একটি মেয়ে আছে। আমি ওকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছি।

এবার পুরো রুমে সবার চোখেই কিছুটা বিস্ময়। ওসি সাহেবেরও। কিন্তু অবিজ্ঞ মানুষ। রাস্তা খুঁজতে চান চট করে, আপনি কি কোনো এনজিও সংস্থার মানুষ? ঐ মেয়েটি কি আপনাদের সদস্য? মানে রিহ্যাবিলিটেশন?
আমি ভেবেচিন্তে বলি, হ্যাঁ তা বলা যায়। তবে একক উদ্যোগ বলতে পারেন।
ওসি বলেন, লাভ নাই। অরা ভালো হয় না। খাসলত খারাপ হয়ে গেলে সহজে ফিরতে পারে না।
আমি বলি, ফেরার রাস্তা কি আর আমরা সহজ থাকতে দিয়েছি?

ঘরে বসে থাকা সাংবাদিকের দল তারস্বরে প্রতিবাদ করে, কী বলেন? কেউ ভালো হতে চাইলে তার জন্য দরজা তো খোলাই থাকে। এই যে দ্যাখেন আপনার মতো একজন মানুষ আইছেন তাকে ছাড়ায়া নিতে। এইডা কি কম বেপার? নিজের ইজ্জত-সম্মানের পরোয়া করেন নাই।
কথা বাড়াতে ইচ্ছা করে না।
ততক্ষণে আমার বসার ব্যবস্থা হয়েছে।
ওসি সাহেবের হুকুমে একজন কনস্টেবল শবনমকে নিয়ে আসে। শবনম দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে কেবল ওসি সাহেবের দিকে। চেহারায় ভীতির কোনো চিহ্ন নেই। তবে তাকে এই ঘরে ডেকে আনার রহস্য ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ওসি সাহেব দরাজকণ্ঠে বলেন, আপনি এসেছেন। আপনার সম্মানে ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু এই মাইয়ারে বুঝান সে য্যান ভালো হয়ে যায়। পরেরবার ধরা পড়লে কিন্তু আর ছাড়ব না।

ওসি সাহেবের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার দিকে তাকায় শবনম। সাথে সাথে ফ্রিজ হয়ে যায়।
জিজ্ঞেস করি, জরিমানার টাকাটা কোথায় জমা দেব?
মানে?
পরিষ্কার করি, ধারা ২৯০/২৯১। সর্বোচ্চ শাস্তি দুশো টাকা জরিমানা।
হেসে ফেলেন ওসি সাহেব, আপনে কি উকিল?
না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হিসাবে আইন কিছুটা জানার চেষ্টা করি মাত্র।

থানার মুনসির টেবিলে দুইশো টাকা জমা দিয়ে শবনমকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। থানার গেট পেরিয়েই আমার হাত ধরে দাঁড় করায় শবনম। সরাসরি আমার মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার চোখে ক্রোধ, খাড়ান! আপনে থানাত আইলেন ক্যান?
বলি, আসব না? আমি না এলে কে আসবে?
শবনমের চোখের দৃষ্টি নরম হয় না। বলে, এইরকম অনেকবারই আমার হাজতখাটা লাগছে। একদিন দুইদিন রাইখা ছাইড়া দ্যায়। টেকা-কড়ি যা থাকে নিয়া নেয়। তারপর এমনেই ছাইড়া দেয়। এইবারও ছাড়ত। কিন্তু আপনে আইলেন ক্যান?
আমি আসাতে কি কোনো ক্ষতি হয়েছে তোমার?
হয়নি। কিন্তু হইবার পারত। অনেক বড় ক্ষতি হইবার পারত।
বুঝতে পারি না শবনমের কথার অর্থ, কী ক্ষতি হতো?
অরা যদি আপনেরে অপমান করত? যদি আপনেরেও আমগো দলের সাথে খাড়া করায়া ফটো তুলাইতো? পরদিন পেপারে ছাইপা দিত? আপনের সনমান কই থাকত তখন?
আমি হেসে বলি, দিলে তেমন কোনো ক্ষতি আমার হতো না। মানুষজন আমার সম্পর্কে কী ভাবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি যে কয়জন মানুষকে মূল্য দিই তারা আমাকে ভালোভাবে চেনে এবং জানে। তারা কেউ পুরোটা না জেনে আমাকে বিচার করবে না।
শবনম কথা থামায় না, আপনেরে তো আরো নানারকম অপমান করবার পারত। পুলিশরে তো আপনে চেনেন না।
আমি হাসি, তা বোধহয় করত না শবনম। পুলিশের ওসি আর কর্মকর্তারা এমনিতেই অনেক ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট ব্যাপার নিয়ে ওরাও আর বেশি ঝামেলা করতে চায় না।
ওই যে মানুষগুলান বইসা ছিল, অরা সব সম্বাদিক। পুলিশের মতো অরাও থানাত বইসা ভাগা খায়। অরা আপনের ফটো ছাপানোর ভয় দেখায়া পিছু নেবার পারত।
আমি আবারও হাসি। বলি, কোনো ভালো পত্রিকাতে এইসব নিউজ বা ছবি ছাপা হয় না শবনম। ওরা সব অচেনা-অজানা পত্রিকা আর অনলাইনের রিপোর্টার। বেতন-টেতন পায় না। এইভাবেই ওদের চলতে হয়। ওদেরকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। তাছাড়া বললামই তো, সারাদেশের মানুষ আমার নামে ছি ছি করলেও আমার কিছু যায়-আসে না।

থানার গেটে রিকশা বা সিএনজি থাকে সবসময়। আমি একটা রিকশার দিকে এগিয়ে যাই। শবনমকে বলি, ওঠো। সন্ধ্যা থেকে নিশ্চয়ই তোমার পেটে কিছু পড়েনি। করোনার রাত। কোনো খাবারের দোকান খোলা পাব কি না কে জানে!

মনে হয় বাস টার্মিনাল বা রেলস্টেশনে গেলে খাবারের হোটেল খোলা থাকতে পারে। আমি তাই রিকশাঅলাকে সরাসরি কমলাপুরে যেতে বলি।
রিকশা চলতে শুরু করে।
শবনম গম্ভীর চেহারা নিয়ে বসে আছে।
আমি বলি, এখনো রাগ করে আছো আমার ওপর!
হঠাৎ শবনম আমাকে জড়িয়ে ধরে দুইহাতে। সেই রিকশার ওপরে বসেই। প্রথমে ফুঁপিয়ে ওঠে। ফোঁপানিটা বাড়তে বাড়তে হেঁচকিসহ কান্নায় রূপ নেয়। আমার কাঁধের ওপর শবনমের মাথা। কান্নার সাথে সাথে দুই-একটা শব্দ বের হতে থাকে। আমি শুধু দুইটি শব্দ বুঝতে পারি, বন্ধু! আমার বন্ধু! চলবে