আমার বন্ধু শবনম

উপন্যাস ৪

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২০

শবনমের অবয়বে একই সাথে মায়া আর বিষাদের ছায়া। তবে কণ্ঠে পুরোটাই বিষাদ, আমার খুব শখ আপনেরে একবেলা রাইন্ধা খাওয়াই। কিন্তু...
সে তো খুব আনন্দের কথা। এর মধ্যে আবার কিন্তু কেন?

শবনমের মুখ এবার পুরো মলিন হয়ে যায়, আমার যে হারামের কামাই! সেই কামাই আপনেরে খাওয়াইলে আপনে আর আমি দুইজনাই গুনাগার হবো। আমার কথা বাদ দ্যান। আমি তো গুনা কর‌্যাই জীবন চালাই। আপনেরে গুনাগার বানাইতে চাই না।
হারাম-হালালের বিতর্কে যেতে চাই না। তাছাড়া সেসব বললে শবনম সব কথা বুঝবেও না। শুধু দৃঢ় নিশ্চিতকণ্ঠে বলি, তুমি রান্না করে খাওয়াতে চাইলে আমি অবশ্যই খাব শবনম।
শবনম অবিশ্বাসের চোখে তাকায়, আপনে জাইনা-শুইনা হারাম খাইবেন!
হারাম-হালালের চাইতে ভালোবাসা আমার কাছে অনেক বড় শবনম।
এবার শবনমের চোখে পানি দেখা যায়। আমার একটা হাত তুলে নিয়ে বলে, আপনে এত ভালো ক্যান!

আমি হাসি, কে বলেছে তোমাকে যে আমি ভালো মানুষ? কত পাপ যে আমার জীবনের প্রতিটি দিনরাতের সাথে জড়িয়ে আছে সেকথা কেবল আমি জানি। এখন অবশ্য চলছে আমার প্রায়শ্চিত্তের পালা।
শবনম খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, হইবার পারে না। আমি মানুষ চিনি। পুরুষ মানুষ চিনি। শয়ে শয়ে পুরুষ দেখছি। আপনে খারাপ মানুষ হইবার পারেন না।

কথাটাকে অন্যদিকে নিতে চাই আমি। বলি, আচ্ছা তোমার এই অবস্থার জন্য তুমি কি নিজেকেই শুধু দায়ী মনে করো? আর কাউকে দোষ দিতে ইচ্ছা করে না? এই অবস্থাতেও তুমি হারাম-হালালের কথা ভাবো। মানে আল্লার কথা ভাবো। তোমার কি একবারও মনে হয় না আল্লা তোমাকে কী দিয়েছেন? আল্লার উপর তোমার রাগ হয় না? আচ্ছা রাগের কথা বাদ দাও। অভিমান হয় না?
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে শবনম। তারপর বলে, আল্লারে তো দোষী করণ নিষেদ। তাঁই যা করে ভালোর জন্যে করে।
তাহলে বলো দেখি, তোমার জন্য তিনি কোন ভালোটা করেছেন?
তার লীলা বুঝন যায় না। হাদিছের একখান গল্প শুনছিলাম। এক খানকি একটা কুত্তারে পানি খাওয়াইছিল বইলা আল্লা তার সব গুনা মাফ কইরা তারে বেহেস্তে দিছিলো। আমার জন্যেও হয়তো সেইরকম কিছু বেবস্তা থাকবার পারে।

এমন বিশ্বাস! এত কষ্ট প্রতিদিনের কষ্ট, অবমাননা, নারীত্বের অপমান, মনুষ্যত্যের অপমান, নিজেকে বিক্রি করার গ্লানি— সবকিছুর পরেও এত কুণ্ঠাহীন বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তার প্রতি! জিগ্যেস করতে ইচ্ছা করে এত বিশ্বাস সে কোথায় পেল। তখন মনে পড়ে, পনেরো শতকে ইউরোপের বারবণিতারা তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে দিত গির্জাতে। নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু রেখে সব উপার্জন দিয়ে আসত গির্জায়। যদিও গির্জার ভেতরে ঢোকার অধিকার তাদের ছিল না, বাইরের দানবাক্সে রেখে আসতে হতো টাকা, তবু তারা ভাবত এই টাকার বিনিময়ে গির্জা তাদের পাপমোচনের দায়িত্ব নেবে। পাশের দেশ ভারতে সোনাগাছির পতিতারা কয়েক বছর হলো দুর্গা পূজা করছে নিজেদের এলাকায় মণ্ডপ বানিয়ে। এই বিশ্বাস নিয়ে যে মা দুর্গা তাদের উদ্ধার করবে পরলোকে।

আমি জিগ্যেস করি, তুমি কি কোনো পীরের মাজারে যাও?
শবনমের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, আপনে ক্যামনে বুজলেন! যাই তো। পীরের মাজারে যাই। ঐ জাগাত পাপী-তাপী সগ্গলডির জায়গা আছে।
টাকা দাও?
দিই তো। ট্যাকা দিই, শিন্নি দিই।
আমি হাসি, পীরের মাজারে যে টাকা দিতে পারো, সেই টাকাতে আমাকে খাওয়াতে পারবে না কেন?

উত্তর দিতে পারে না শবনম। পারার কথাও নয়। চালাক ভক্ত হলে বলতে পারত পীরের অলৌকিক ক্ষমতা আছে হারাম টাকা হালাল বানিয়ে ফেলার, আপনের মতো সাধারণ মানুষের তো সেই খ্যামতা নাই। শবনম অনুনয়ের স্বরে বলে, আপনে জেদ কইরেন না গো! আমি আপনের মুখে হারাম খাওয়ার তুইলা দিবার পারুম না।
আচ্ছা আমি খেতে চাইব না। তবে তোমার যেদিনই ইচ্ছা হবে, সেদিনই আমাকে খেতে ডাকবে। ঠিক আছে?
শবনম হেসে মাথা কাত করে, আইচ্ছা।

শবনম কীভাবে এই পথে এসেছে সে প্রশ্ন আমি কখনো করিনি। ওরা খুব বিরক্ত হয় এই ধরনের প্রশ্ন শুনলে। সাংবাদিক আর এনজিও-র আপারা এই ধরনের প্রশ্ন করে করে ওদের অতীত খুঁচিয়ে সামনে এনে দেয় বলে ওরা তাদেরকে এড়িয়ে চলে। তাদের সাথে আর কথা বলতে চায় না। আমি আসলে শবনমের অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ— কোনোটা নিয়েই কখনো প্রশ্ন করি না। কথা তুলি না। কিন্তু আজ হঠাৎ-ই একটি প্রশ্ন বেরিয়ে এলো, তুমি রান্না শিখেছ কার কাছে?
হাঁফ ছেড়ে বাঁচি যখন শবনম প্রশ্নটিকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করে। বলে, বুবুর কাছে শিখছি।
ও।
মা-বাপ তো আমারে খাওন দিবার পারত না। তাই রাখছিল বুবু আর বোনাইয়ের কাছে। খুব অল্প বয়স থাইকাই। বোনাই চালাইতো রিকশা আর বুবু ঝি-এর কাম করতো বাড়ি বাড়ি। এই ধরেন যে বয়েস বারো-তেরো হইতে হইতেই আমি রান্নাবাটি শিইখা ফালাইছিলাম। বুবুর তিন ছোডো ছোডো পোলা-মাইয়ারেও আমিই দেইখা রাখতাম।

হঠাৎ-ই কথা বন্ধ করে দেয় শবনম। মুখের দিকে তাকাই। মুখটা সাদা হয়ে গেছে শবনমের। নিশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে। গায়ে ঘাম দেখা দিয়েছে।
আমি পানির বোতলটা এগিয়ে দিই শবনমের দিকে। বলি, থাক আর কথা বলার দরকার নেই। তোমার কি শরীর খুব খারাপ লাগছে?
শবনম উত্তর দেয় না। এক ঢোক পানি খায়। একটু বিরতি দিয়ে আরেক ঢোক।
আমি এদিক-ওদিক তাকাই। একটু বেশি ফাঁকা জায়গা খুঁজি। শবনমের এখন খোলামেলা জায়গা আর বাতাস পাওয়া দরকার।

আমি উঠে দাঁড়াই। শবনমকে বলি, উঠতে পারবে? চলো একটু ঠাণ্ডা আর খোলা কোনো জায়গাতে যাই।
শবনম হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরে। কিন্তু উঠে দাঁড়ায় না। ঐভাবেই বড় বড় করে কয়েকবার নিশ্বাস টানে আর ছাড়ে। তারপর যেন পৃথিবীর সব দুঃখ সব ক্ষোভ সব কষ্ট সবটুকু ক্রোধ সবটুকু ঘৃণা কণ্ঠে এনে বলে, ঐ বোনাই, ঐ শুয়োরের বাচ্চা দুলাভাই-ই পয়লা ধর্ষণ করছিল আমারে। চলবে