এরই নাম নাকি জীবন!

শারমিন আহমেদ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২০

কখনও কখনও কোনও দিনকে এত্ত চেনা লাগে, মনে হয়, আজকে যা যা হবে তা সব আমার জানা। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আগেও দেখেছি, এমন লাগে। সেই দিনের গন্ধ আর এই দিনের গন্ধ কেমন মিলে যায়। আমি অতীতকে বর্তমানের ভেতর মেলাতে থাকি। গন্ধ শব্দটার মাঝে কেমন এক পুরাতন ভাব জুড়ে থাকে। মনে হয়, বহুদিনের আটকে রাখা কিছুতে লেগে থাকা ন্যাপথলিনের উপস্থিতির মতো কিছু।

ন্যাপথলিনের ভেতরে থাকা কর্পুরের গন্ধ ঝট করে হলেও একবার মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। অদ্ভুত, তাই না? কীটের আক্রমণ থেকে বাঁচার ইচ্ছেতে নিজের গায়ে মৃত্যু গন্ধ মেখে নেয়া, ইচ্ছেতে বা অনিচ্ছেতেই। মৃত্যুটাও হয়তো এমনই কিছু, যেদিন কাছে আসবে মনে হবে, ওকে তো চিনতাম তো! প্রতিদিন কতভাবে কত ইচ্ছের অপমৃত্যুর সাথে নিজেরও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়, এই নগ্ন সত্যটা অনেকেরই অজানা থাকে বা জেনেও না বোঝার ভান করতে হয়। এরই নাম নাকি জীবন!

কিংবদন্তী প্রকাশনী থেকে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে লুনা আহমেদের কবিতার বই ‘নগ্ন ক্ষুধা’। এরই মধ্যে পড়ে ফেললাম বইয়ের কবিতাগুলো। স্বাদ পেলাম ভিন্ন রকমের এক জীবনবোধের। জন্মের পরপরই মানুষকে নগ্নতার মুখোমুখি হতে হয়। অর্থাৎ নগ্নতা মানব জীবনের প্রথম সত্য। পরবর্তীতে এই নগ্নতা আসে নানাভাবে যাপিত জীবনের অংশ হিসেবে। লুনা আহমেদ এই উপলব্ধিকে শৈল্পিক উপায়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তার কবিতায়।

বাস্তবতার নগ্ন সত্য প্রতিটি বাক্যে নানা উপমায় উন্মোচিত হয়েছে। ধারণা করছি, তার বয়স খুব বেশি নয়। তবুও জীবনের নগ্ন সত্যকে উপলব্ধিতে তার প্রাজ্ঞতায় আমি মুগ্ধ।

এ মুগ্ধতা পাঠক হিশেবে। চলুন ‘নগ্ন ক্ষুধা’ থেকে একটু পাঠ নেয়া যাক:

নরকসম দহন পেলে স্বর্গের কথা ভেবে আফসোস হয়
বাবাকে ভুলে গেছি সেই মৃত্যুর বছর
মাকে মনে রাখিনি, তবুও ভুলে মনে পড়ে যায়
আমি তাকে পৃথিবী মানতাম
তিনি আমাকে কী ভাবতেন, জানা হয়নি।

মানুষ মূলত বেঁচে থাকে স্মৃতির ভেতর। সত্যি বলতে কি, যদি স্মৃতি না থাকত, মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা খুবই মুশকিল হয়ে পড়ত। লুনা আহমেদ সেই স্মৃতিমেদুরতার ভেতর দিয়ে কী চমৎকার ভাবে উপরের বাক্যগুলো গেঁথে তুলেছেন, পাঠক সহজেই তা উপলব্ধি করতে পারবে।

‘নগ্ন ক্ষুধা’র আরেক কবিতায় লুনা লিখেছেন:
পৃথিবী জুড়ে অবাক শোক আর দুঃখের মিছিলে আমি দর্শকমাত্র
মূলত, পৃথিবী একটি শ্মশানঘাট। সেখানে ভালোবাসা নিষিদ্ধ গন্ধম।

কী সাঙ্ঘাতিক উচ্চারণ! পৃথিবী নাকি শ্মশানঘাট। আর এখানে ভালোবাসা হচ্ছে নিষিদ্ধ গন্ধম। আমার ধারণা, ভালোবাসায় খুব বেশি প্রাজ্ঞ না হয়ে উঠলে এই উপলব্ধি কারো আয়ত্বে আসে না। লুনা আহমেদের এই উপলব্ধি তাই আমাকে বিস্মিত করে। ভালোবাসার মর্মচ্ছেদ করে তিনি এরই মধ্যে অন্তর্জগতের পাঠ নিয়ে ফেলেছেন। একজন মানুষের জন্যে যা একাকিত্বের কারণ।

আরও একটি কবিতার কিছু অংশ পড়ে ফেলতে পারি:
পারবি হতে, আমার রঙ! কুঁচকানো এই কালো চামড়া?
পারবি হতে একটা জগৎ, তুই আর আমি মিলে আমরা?
অদ্ভুত কিছু নাগরিক সত্য এখানে,
মানুষ শুয়ে থাকে রাস্তায়
মানুষ হেঁটেও চলে রক্তের দাগে
দাগগুলো পায়ে পায়ে হাঁটে মানুষের
যেন কিছুই হয়নি।

জগৎ-সংসারে এমন কিছু নগ্ন সত্য থাকে, যাকে দেখে বা অনুভব করেও মানুষ ঘুমোতে যায়। কিন্তু ‘নগ্ন ক্ষুধা’র কবিতাগুলো আমাকে একটি ধাক্কা দিয়েছে। যেন পা হড়কে পড়ে গেছি কোনো গহ্বরে।

বইমেলায় অনেক অনেক বইয়ের ভিড়ে ‘নগ্ন ক্ষুধা’ পাওয়া যাচ্ছে নবসাহিত্য প্রকাশনীর ২৯৪ নম্বর স্টলে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আহমেদ ইউসুফ। মূল্য ১৬০ টাকা।

একুশে বইমেলা ২০১৮