এহসান হাবীবের গদ্য ‘শীতের ওম’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২১

শীতের ওম প্রথম কবে টের পেয়েছিলাম, মনে নাই। যেটা মনে আছে সেটা সদ্য কৈশোরে পা রাখা সময়। আমার এক কাজিন, বয়সে আমার দশ-বারো বছরের বড়, সে আমারে খুব আদর করতো। দেখা হলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো। তো একদিন শীতের রাতে আমি গ্রামের উঠোনে সবার সাথে নাড়ার আগুন পোহাচ্ছিলাম। আমার সেই কাজিনও সেখানে ছিল। আগুন পোহাতে পোহাতে রাত অনেক হয়েছিল অথবা গ্রামের নীরবতা রাত বাড়িয়ে তুলেছিল। কাজিন আমাকে আম্মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল। রাতে তার সাথে ঘুমিয়েছিলাম। একটা নিরপরাধ সম্পর্কই তো আমাদের! তার বাৎসল্য আমাকে মুগ্ধ করতো, এখনো করে। কিন্তু আমি সেই আপার লেপের নিচে ঘুমের মধ্যে ঘেমে উঠেছিলাম। আপা আমাকে ওমের মধ্যে উষ্ণতার মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিল। সেই প্রথম আমি শীতের ওম টের পাই।

তারপর অনেকদিন কেটে গিয়েছে। আমার নিরপরাধ বয়ঃসন্ধিকাল কেটে যাওয়ার পর অনেক ওম আমি টের পেয়েছি। শীতের সকাল হলুদ র্সষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে রিকশায় যেতে যেতে এক চাদরের ভেতর দুজনের ওম ভাগাভাগির স্মৃতি তো এখন ইতিহাস। অনেক শীতের সন্ধ্যায় অনেকেই এসেছিল, তারা আমাকে রিকশা করে ঘুরে বেড়িয়েছে। কারো অল্প সল্প ওম, কারো অষ্টেপৃষ্টে। কতজন কত বেখেয়ালে ওম জমা করে গেছে। হিসাব রাখি নাই। রাখার কথাও ছিল না। একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিল। আমি প্রচণ্ড উত্তাপ নিয়ে খুব শীতে কুকড়ে যাচ্ছিলাম। আমি একধরণের দেয়ালায় ছিলাম। হঠাৎ একটি নগ্ন, খালি শরীরের অস্তিত্ব আমি আমার শরীরের সাথে টের পেয়েছিলাম। এক অনাত্মীয়া শরীর প্রবলবেগে আবেগে কেঁপে গিয়ে আমার শরীর থেকে জ্বর ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল। এটাও ওমের স্মৃতি।

এখন পৃথিবী থেকে তো শীত তার দাপট তুলে নিয়েছে। ফলে এইসব ওমের গল্প এখন মৃত। শীতই নেই, তার আবার ওম। কিন্তু গত দুইদিন হঠাৎ করে কোত্থেকে যে শৈত্য প্রবাহ এলো আর শীত তার দাপট দেখাতে শুরু করলো! আর আমার ওমের স্মৃতিসমগ্রও শৈত্য প্রবাহের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল। যারা প্রবল শীতে, খুব জ্বরে ও ঝড়ে আমাকে ওম দিয়েছিল, আমি তাদের প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এই শৈত্য তাদেরকে আমার মনে আবার জাগরুক করে গেল। এই শৈত্য প্রবাহের প্রতি কৃতজ্ঞতা। শীত বেঁচে থাকুক।

লেখক: কবি