প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

কষ্ট হয়, কী দুর্দশা এই দেশটির

তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৩, ২০২০

এই সময়ের খুবই জনপ্রিয় একজন ওয়াজেন আলহাজ্ব মাওলানা ড. মিজানুর রহমান আযহারী; তার অনেক বক্তব্য নিয়ে ফেসবুকে প্রায়ই শেয়ার দেখি। আমি আজ তার বহুল প্রচারিত একটা ওয়াজ শুনলাম মিনিট দশেক সময় নিয়ে।

তিনি বললেন, চাঁদে মানুষ পাঠানোর আগে নাসার বিজ্ঞানীরা আগে কুকুর পাঠিয়েছিল, যার নাম লাইকা। কারণ মরলে আগে কুকুর মরুক। চাঁদে গিয়ে নীল আর্ল্মস্ট্রং লক্ষ্য করে দেখলেন, চাঁদের এই মাথা থেকে ওই মাথার মাঝখানটাতে ফাঁটা। খাবার ছিল না, চকলেট খেয়ে একটু পরেই চাঁদের মধ্যে সে চমৎকার একটা মিউজিক শুনতে পেল। পৃথিবীতে ফিরে কোথাও সে এই মিউজিক আর খুঁজে পায় না। পরে আমেরিকায় একটা প্রেয়ার হলের পাশ দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ দেখে মসজিদর ভেতর থেকে ওই মিউজিকটা বাজছে। মসজিদে ঢুকে দেখে একটা লোক কানের মধ্যে দুই হাত দিয়ে এই মিউজিকটা বাজায়। আসলে এটা মিউজিক না, আজান। চিল্লায়া বলেন আজান।

এই ভদ্রলোক নাকি মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। আর তাই নামের শেষে আযহারী লেখেন। এরশাদ সাহেবরা হজ করে ফিরে যেমনটা নামের আগে আলহাজ লিখতেন, ঠিক তেমনটাই। তবে তিনি আলহাজ এবং আযহারী দুটোই লিখেছেন। ভদ্রলোকের চেহারাও এরশাদের মতোই সুন্দর; বাড়তি হিসাবে কণ্ঠটাও তার অসাধারণ সুন্দর, প্রশংসাযোগ্য। এই সময়ের অতি জনপ্রিয় ওয়াজেন আলহাজ্ব মাওলানা ড. মিজানুর রহমান আযহারী সাহেব তার উপরোক্ত বক্তব্যের মাত্র তিনটি বাক্যে সরাসরি তিনটি মিথ্যা কথা বলেছেন। আমি বলবো না বা বিশ্বাস করি না যে, তিনি তার অজ্ঞতা থেকে বলেছেন। কারণ তিনি কথায় কথায় সুন্দর ইংলিশ উচ্চারণ করেন। নিশ্চয়ই তিনি ভালো ইংরেজি জানেন। অনেক পড়াশোনা করেন। সুতরাং আমি মানতে নারাজ যে তিনি `অজ্ঞতা` থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওয়াজ করেছেন।

আদতে তিনি জনপ্রিয় হবার জন্য সস্তা বক্তব্য দিয়ে মানুষের প্রিয় হবার চেষ্টা করেছেন। আর এই বাংলাদেশের যেহেতু অধিকাংশ মানুষই জিপিএ-পাইপ, সেহেতু তিনি জনপ্রিয় হবার সবচে সহজ রাস্তাটিই বেছে নিয়েছেন। প্রথমত, লাইকা নামের মস্কোর রাস্তা থেকে ধরে নেয়া একটা নেড়ি কুকুর মহাশূন্যে পাঠিয়েছিল রসকসমস নামের সোভিয়েট মহাকাশ সংস্থা। নাসার সংগে যার কোনও সম্পর্কই নেই বা ছিল না। দ্বিতীয়ত তিনি বললেন, `নীল আর্ল্মস্ট্রং লক্ষ্য করে দেখলেন চাঁদের এই মাথা থেকে ওই মাথার মাঝখানটাতে ফাঁটা` যা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য। চাঁদ কি একটা ফুটবল যে হাত দিয়ে ধরে তিনি দেখলেন তার এমাথা থেকে ওমাথা ফাটা! আমি জানাতে চাই, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা এবং ড. আযহারীর মনগড়া গল্প। নীল আমর্স্ট্রং চাঁদের ফাটা নিয়ে কোনও কিছু বলেননি, তাছাড়া সেটা তার জানারও কথা না। এমনকি নাসা বা অন্য কোন মহাকাশ বা চাঁদ নিয়ে গবেষণা সংস্থাও এযাবত চাঁদে কোনও ফাটল খুঁজে পায়নি।

তাই বলে আমি মহানবি মুহাম্মদের (সা.) চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করাকে অসত্য বলছি না, আমি বলছি সেটা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছিল এবং পরে তা মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটার কোনও বাস্তব প্রমাণ আজ অবধি বিজ্ঞান খুঁজে পায়নি। আমি বিষয়টা নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছি। কোনও সায়েন্স জার্নালে আমি এর সত্যতার প্রমাণ পাইনি। ড. আযহারী নির্লজ্জভাবে মিথ্যা কথা বলেছেন।

তৃতীয়ত, সেই একই নীল আর্মস্ট্রং নাকি চাঁদে আজান (মিউজিক) শুনেছেন! আশ্চর্য! একজন মানুষ যিনি একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেছেন বলে দাবি করেন, তিনি কিভাবে এরকম মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। আজ পর্যন্ত যে সমস্ত অতি ক্ষীণ যে সব `আওয়াজ` (মহাজাগতিক শব্দ) মহাশূন্যে পাওয়া গেছে, সেটা চাইলেই আপনি ইউটিউবে বা নাসার সাইটে গিয়ে শুনতে পাবেন। সেখানে আজান বা মিউজিক কোথায় পেলেন এই মিথ্যুক আযহারীরা? নীল আর্মস্ট্রং এর অনেকগুলি ইন্টারভিউ আমি দেখেছি, তাকে নিয়ে অনেক পড়েছি কিন্তু এইসব আজগুবি বা গাঁজাখুড়ি গল্প কোথ্থাও খুঁজে পাইনি।

ইসলাম মিথ্যাকে ঘৃণা করে। ইসলামের আবির্ভাবই হয়েছিল মিথ্যাকে দূর করতে। আর বাংলাদেশি এসব ওয়াজেনরা মিথ্যার পসরা নিয়ে বসেছেন। শুধুই ঘৃণা হয় এসব তথাকথিত ইসলামি ব্যক্তিত্বদের কর্মকাণ্ড দেখলে। ওয়াজ নিয়ে আরও অনেক কথা শেয়ার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বেশ কয়েকজন নামকরা মাওলানাদের অনেক ভাঁড়ামি দেখলাম।

একজনেকে বলতে শুনলাম, আইফোনের মালিক `ব্লেল গ্রেড` এর সংগে নাকি তার দেখা হয়েছে, ব্লেল গ্রেড দেখতে টিকটিকির সমান! আরেকজন, সিরিয়া থেকে ধরে নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে `রোনাল্ড ট্রাম্প`কে! আরও একজন ইংল্যান্ডে যেয়ে `লীগে` খেলেছেন, ১৯৯০ সালে। আবার একই সংগে ১৯৯০ সালে অক্সফোর্ডের `শ্রেষ্ঠ টিচার`ও ছিলেন, তাও একবার নয়, তিনবার। এটা কেউ জানতো না, তার পরিবারও জানতো না। আজকেই সে ফট করে প্রকাশ করে দিয়েছেন। অক্সফোর্ডের সেলেবাসেই নাকি চলে ইংল্যান্ড-আমেরিকার স্কুলগুলি!  `নাসা বলছে, যে-কোনও সময় সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে!’

আরেকজন আইজ্যাক নিউটনকে `ইসহাক নিউটন‘ বানিয়ে তাকে আবার ইসলামি চিন্তাবিদ-গবেষক বানিয়ে ছেড়েছেন। অন্যজন আইনস্টাইনকে `চোরা নকলবাজ` আর কীসব বানিয়ে দিলেন। আমরা বাংলাদেশিরা নিয়মিত ভারতীয়দের গোমূত্র নিয়ে ট্রল করি। মজা নিই। ভারতীয়দের জ্ঞান নিয়ে উপহাস করি। কিন্তু ভারতীয়রা যখন জানবে আমাদের কথিত প্রথম শ্রেণির ধর্মীয় ব্যক্তিদের মিথ্যার বেসাতিপূর্ণ জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ, তখন তারা কিভাবে ট্রল করবে! সেটা কি ভেবে দেখার সময় পেয়েছেন?

আমার তো মনে হচ্ছে, `এসব হুজুর` আর ভারতীয় `গরুর মূত্র` একই সূত্রে গাঁথা। মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে একশ্রেণির লোক দ্বারা চাঁদে পাঠিয়ে `মহাকাশ জয়` করে ফেলার ফলাফল বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার পেতে চায় নাকি?

যাই হোক, আযহারীরা যখন ওসব নাসা, চাঁদ, মিউজিক বা ব্রেল গ্রেড, আইফোন, অক্সফোর্ড বা নিউটন-আইনস্টাইন শব্দগুলি উচ্চারণ করে, তখন উপস্থিত জনতা (হাজেরাইনে মজলিস) যেভাবে `সুবাহানাল্লা`, `আলহামদুলিল্লাহ` বলে জিকির শুরু করে দেয়, তখনই সবচে বেশি ভয় পাই; মিথ্যার শেষেও আজ ওসব পবিত্র শব্দমালা শুনতে হচ্ছে। কষ্ট হয়, কী দুর্দশা এই দেশটির!