চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৩১

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০১৯

আমি ভূতে বিশ্বাস করি বললে বলাটা যথেষ্ট হবে না। বরং বলা ভালো, আমি ভূতে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি। যা কিছু সহজ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, সূক্ষ্ম, এবং স্থূল জাগতিক ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে, এমন অনেক কিছুর অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করতে ভালোবাসি। আমার মনের ভেতর এক অদ্ভুত অতীন্দ্রিয় জগৎ আছে, যেখানে খটখটে আলো নেই, আবার পুরোপুরি অন্ধকার নয়। সেই আলোছায়াময় রহস্যাবৃত জগতে আমি নিভৃত শ্মশানচারিণী। এ বিষয়ে আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু দর্শন ছাড়া যা আছে, তা নেহাতই কিছু অনুভব।

রিষড়ার গঙ্গা ধারের বাড়িটিতে যখন আসি তখনো মনের ভেতরে সেই শিহরণ জাগানো অদ্ভুত বিশ্বাসের জগৎ এতখানি জাঁকিয়ে বসেনি। মানুষের ভেতরের অবদমিত কামনা বাসনার যে রোমহর্ষক সাম্রাজ্য, সে সম্পর্কেও ছিল অবগতির অভাব। তবে রাত গভীর হলে কে যেন আমার শয়নকক্ষের দরজা হালকা করে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যেত। দুলে উঠতো চাবির গোছা। সে কি কোনও হাওয়া মাত্র?

রাত আরো গভীর হলে দোতলার সুবিশাল ছাদে স্পষ্ট শুনতাম কারোর পদচারণার শব্দ। একেক দিন টানা দুঘণ্টা ধরে কে যেন পায়চারি করতো। তার সাথে গোলাকার কোনও জিনিস গড়িয়ে দেয়ার ঘরঘর শব্দ। এ বাড়ির লোকেরা বলতো, ওটা ব্রহ্মদৈত্য যে নাকি বাস করে ছাদলাগোয়া বেলগাছের মাথায়।

এ বাড়ির জমিতে নাকি কোনও এক সময় উত্তর পাড়ার রাজাদের আউট হাউস ছিল। বাগান সংলগ্ন নাচঘরে নাচ দেখতে আসতো বাবুরা। সেই বাইজি নাকি ওই নাচঘরেই আত্মহত্যা করে। তারই ভূত নাকি অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়ায় এ বাড়িতে, যেটি আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে আমার দাদাশ্বশুর নির্মাণ করেন। ঘটনার সত্যতা বিচারের কোনও উপায় না থাকলেও একা একা এলোচুলে বিকেলবেলা এ বাড়ির ছাদে ওঠা আমার মানা ছিল। আর সে নিষেধের তোয়াক্কা না করেই বারবার সন্ধ্যার অন্ধকারে একা এলোচুলে আমি ঘুরে বেড়াতাম ছাদে।

কারণ, ভয় নিয়ে লুকিয়ে পড়ার মানুষ আমি কবেই বা ছিলাম? বাইজির ভূতের সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ না হলেও ক্রমাগত বুঝেছিলাম, এ বাড়িতে ভূত আসলে এক নয়, অনেক। তবে আমার সাথে এই সামান্য পরিচয়ে ক্ষান্ত হওয়ায় লোক তারাও ছিল না। এ বাড়িতে অনেক রাত আমি কাটিয়েছি একা আমার ঘরে।

সেদিন দক্ষিণের ঘরটিতে শুয়েছিলাম। ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার শ্বশুরের ঠাকুমা শুয়ে আছেন সটান হয়ে। ইহজীবনে তাকে আমি দেখিনি। গল্প শুনে কেবল তার ছবিটি ছিল আমার মনে। প্রচণ্ড ভয়ে হাড় হিম হয়ে গেল। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না। ঠাকুমা শুয়ে আছেন মৃতবৎ। হঠাৎ তার ঘাড়খানা আমার দিকে কাত্ হয়ে এলো। দেখি, ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছেন আর বলছেন, ‘ভয় পাচ্ছিস কেন নাতবউ?’ বলেই ভ্যানিশ। এরপর অন্তত আধঘণ্টা আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। স্বপ্ন না সত্যি সে বিচার সম্ভব হয়নি আজও। তবু এদিনের পর জানতে পেরেছিলাম, ঠাকুমা এ ঘরেই মারা গেছিলেন।

পরের ঘটনাটি উত্তরের ঘরে। এই ঘরটিই এ বাড়ির মধ্যে সব থেকে ঠাণ্ডা। এক গরমের বিকেলে শুয়ে আছি। বেশ ঠাণ্ডায় চোখ লেগে এসেছে। হঠাৎ কিসের আওয়াজে তন্দ্রা কেটে গেল। মনে হলো, কে যেন আমার হাত দুটো জোর করে চেপে ধরে রেখেছে। তার সাথে এক অদ্ভুত শ্বাসকষ্ট অনুভব হলো। কোনোরকমে ছিটকে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতে গেলাম। কিছুতেই দরজা খুলতে না পেরে যেই বিছানার দিকে তাকিয়েছি দেখি, আমার শরীর তো বিছানায়। তবে দরজার কাছে কে? অনেকটা ধস্তাধস্তির পর, জানি না কার সাথে, দরজা খুলে বাইরে বেরতে পেরেছিলাম। যদিও এই অভিজ্ঞতাকে কেউ কেউ স্লিপ প্যারালিসিস বলে ব্যাখ্যা করেছেন, তবু সে ব্যাখ্যায় আমার মন ভরেনি।

শুনেছিলাম, ওই ঘরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন আমার দিদিশাশুড়ি। কন্যার মৃত্যুর পর যিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। নীরবেই মারা যান তিনি। যেদিন মরা যান, ঘরের ভেতর থেকে ছিটকিনি তোলা ছিল। কী জানি, হয়তো শেষ বারের মতো ছিটকিনির দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও হাত এলিয়ে পড়েছিল তার। দরজাটা আর খুলতে পারেননি শেষ বারের মতো।

কন্যার যখন বছর আড়াই, ছাদে নিয়ে যেতাম বিকেলের দিক করে। এত বড় ছাদ পেয়ে তারও বেজায় মজা। কিন্তু ছাদের উত্তরের কোণটি দেখিয়ে সে বারবার বলতো, ওখানে একজন দিদি আছে যে নাকি ওর সাথে খেলতে চায়। ভালো করে খুঁজেও আমি কোনোদিন কাউকে দেখতে পাইনি। সে বারবার ওই দিদির কথা বলতো যে তাকে আদর করতে আসে। পরে শুনেছিলাম আমার দিদিশাশুড়ির বছর পাঁচেকের কন্যা মারা গেছিল ছাদের ঠিক ওই অংশের নিচে একতলার যে ঘর যা এখন বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেখানেই।

এসব অভিজ্ঞতা শুনে আমার অনেক বন্ধুরাই আমাকে প্রশ্ন করেছে, ‘তুই ও বাড়িতে থাকিস কি করে?’ যারা এ বাড়িতে এসেছে তাদের কেউ কেউ সন্ধ্যার পর ছাদে ওঠার প্রশ্ন সটান নাকচ করে দিয়েছে। তবে মনের অন্দরমহলে এমন অনেক অশরীরী আত্মার সাথে নিত্য সহবাসে অভ্যস্ত আমি কোন অধিকারে এই আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করি! এ বাড়ি কোন অজানা সময়ের সরণী পার করে আমার মনের ভেতর তার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে রেখেছিল। রিষড়ার গঙ্গাধারে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি বহুকাল পরে।

দু’চার পলের এই জীবনে এমন কত অশরীরী কামনাদের মানবশরীর ধারণ করতে দেখি। অসময়ে ডাক এলে তাদেরই কেউ কেউ ভূত হয়ে যায়। ভয় তো ভয়কে উত্তীর্ণ করে আরো বহু দূর এগিয়ে চলার জন্যই, তাই সেই শিহরণ নিয়েই পথ চলতে ভালোবাসি। মনের ভেতর কে যেন বারবার ঘোরাতে থাকে এফএমের নব, বেজে ওঠে গান দূরস্থিত রেডিও স্টেশনে:

খালি হাত আয়েথে হাম খালি হাত যায়েঙ্গে... চলবে

লেখক: কবি