চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৪৫

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২০

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে পাবলিক রিলেশন শব্দটার মাহাত্ম্য বহু গুণ বেড়ে গেছে। ব্যাপারটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তাবড় তাবড় সেলিব্রিটিদেরও এর খেসারত দিতে হচ্ছে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও কোনও বিগ শট সেলিব্রিটির সাথে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে ছবি তোলার কথা ভাবা যেত কি? তারা বিচরণ করতেন সাধারণ জনস্রোত থেকে হাজার মাইল দূরে, দূর গগনের নক্ষত্রের মতো। তারা বাড়িতে কি করেন, কি খান, বিছানায় কেমন করে শুয়ে থাকেন, কার সাথে ডেটিং করেন— এসব আগ্রহ নিরসনের একমাত্র ভরসা ছিল `আনন্দলোক` বা `সানন্দা`। কিন্তু এখন দিনকাল বদলেছে। সাঈফ কন্যা সারা কিংবা শ্রীদেবীর মেয়ে জাহ্নবীর মতো জিম ফেরত বা এয়ারপোর্টে চলমান সকল নায়ক নায়িকাদেরই ধরা দিতে হচ্ছে সেলফি শিকারিদের কাছে। শুধু ধরা দিলেই হচ্ছে না, হেসে ন্যাকামো করে পোজও দিতে হচ্ছে। সহবৎ না দেখালেই এরা হবে পাপারাৎজির শিকার। তাই শান্ত মাথায় এটা ওটা প্রশ্নের উত্তরও দিতে হচ্ছে। কারণ এখন এরাও বুঝে গেছে দুটো কথা। এই দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের পরিসরে যত বেশি সম্ভব মানুষের নজরের সামনে ঘুরপাক খেতে হবে, অ্যান্ড নেভার আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ কমন পিপুল!

সম্ভবত আমরা খুব বেশি করে মুহূর্ত তথা তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। সবটা এখনই চাই। খুব লং টার্ম কোনোকিছুতে হয়তো আমাদের বিশ্বাস চলে যাচ্ছে। সেই ইনসিকুরিটি থেকেই এই নিজেকে টিকিয়ে রাখার অনর্থক প্রতিযোগিতা, যেখানে শিল্পী আসলে তার কাজের ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছে। আদৌ কিছু লিখতে পারলাম কিনা, আদৌ একটা সিনেমা বানাতে পারলাম কিনা, আদৌ একটা অসাধারণ অভিনয় করে দেখাতে পারলাম কিনা— এসব কিছুকে নস্যাৎ করে আজকের মার্কেটিং সর্বস্ব দুনিয়ায় রাজ চক্রবর্তীর মতো পরিচালকদের বোকা বোকা অপ্রাসঙ্গিক ড্রইংরুম ভিডিও নিয়ে অন্যদের বেডরুম অবধি ঢুকে পড়তে হচ্ছে।

আরে মানছি, ওরাও মানুষ ওদেরও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। কিন্তু তাই বলে ওনার স্ত্রীর জ্বর হলে শাশুড়ি তার পা টিপে দেয় কিনা কিংবা বৌমা কেমন করে শাশুড়িকে গাড়ি চালিয়ে বেড়াতে নিয়ে যায়— এসব কে দেখতে চেয়েছে ভাই? আমরা সত্যজিতের লিগ্যাসি ক্যারি করি। আমরা পেয়েছি ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো চিত্র পরিচালকদের। পারলে একটা `পথের পাঁচালী` বানিয়ে দেখান না, আরেকটা `পরশপাথর` কিংবা `বাড়িওয়ালি`।

মানুষের নারসিসিজমকে নতুন মাত্রা দিয়েছে সেলফি বিপ্লব। নিজেকে নতুন নতুন ভঙ্গিতে দেখতে শেখা মানুষের ধ্যানভঙ্গ ঘটানোর জন্য তাই বোধহয় মহৎ শিল্প আর কাফি নয়। শিল্পপ্রয়াসীকে তাই শিল্পী হয়ে ওঠার আগেই একজন পাবলিক ফিগার হয়ে ওঠার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে হচ্ছে। এসব কিছু যাকে স্পর্শ করতে পারছে না, এত প্রলোভন থেকে দূরে নির্জনে নিজের তপস্যা জারি রাখতে পারছেন যিনি, তিনিই হয়তো প্রকৃত সাধক।

সাহিত্যের আঙিনাতেও দেখা মিলছে ইউনিভার্সাল দাদাদিদি গোছের, ‘দেখে নেব শালা` অ্যাটিটিউড নিয়ে ঘোরা লেখক-লেখিকাদের যাদের ক্যাচলাইন অনেকটা এইধরনের— ‘লিখবো এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে!’ এরা সক্কলকে ভালোবাসে। তাই এদেরও সব্বাই ভালোবাসে।