চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫৪

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২০

ইচ্ছে ছিল, একসাথে অনেকটা পথ হাঁটব দুজন পাশাপাশি। পথ চলতে গল্প হবে অফুরান। ইচ্ছে ছিল, অনাগত সন্ধ্যার মুখোমুখি ব্যালকনিতে দাঁড়াবো কফিমগ হাতে। কফিটা না-হয় আমিই বানাবো। বাইপাসের ওপারের আকাশ তখন অস্ত অভিমানে রঞ্জিত। ইচ্ছে ছিল, দেখব কানের পাশে তোমার নরম কুঞ্চিত চুল কেমন প্রতিমার মতো মুখাবয়ব তৈরি করছে। ঠিক সেই সময় তুমি আমার দিকে তাকাবে। ঈষৎ বাঁকা সে চাহনি। তারপর হেসে উঠবে অকারণ আচম্বিতে। হাসলে তোমাকে দারুণ লাগে যে!

সব সময় কথা বলতে না তুমি। অনেক অনেক সময়ের নীরবতা পার করে দেখতাম, তোমার কোঁকড়ানো চুল কেমন ঘাড়ের কাছে এলিয়ে পড়ে সময়কে থিতু করে রেখেছে। ইচ্ছে ছিল, ডেকে বলি, চলো। অনেক তো হলো। এসবে তোমার কি প্রয়োজন? এসব আয়োজনের বড় কি প্রয়োজন ছিল তোমার? এত সমারোহ। এত জিজ্ঞাসা। এত ভিড়। কিসের? কেনই বা?

ইচ্ছে ছিল, হাত ধরে টেনে নিয়ে যাই মহা অরণ্যে। শুধু একবার ভীষণ নির্জনে তোমাকে দেখব বলে। ইচ্ছে ছিল, ডেকে বলি আরও, তুমিও তো জানো তোমার এ বন্দিদশা। কেন এ শৃঙ্খল পরালে নিজেকে? মিছে এ সাজ সজ্জা। মিছে এত আলো। চলো। অকারণ সময় নষ্ট করো না আর। ইচ্ছে ছিল, ডেকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ভালো আছো? বলো। বলো। ভালো না থাকলে চলো। চলো এক্ষুণি।

তুমি তো মানবী ছিলে। কী নিপুণ এক মানবী। অথচ বড় বেশি ঈশ্বরী হয়ে উঠলে। সমুদ্রের মতো মানুষের ঢেউ বড় বেশি কপট হয়ে উঠল তোমাকে ঘিরে। তোমার হাঁটু তোমার চরণপদ্ম থেকে শুরু করে যে অলঙ্ঘ্য দূরত্ব তোমার হৃদয় তোমার মগজ অবধি, সে তো দৈবী। আমার বড় বেশি পার্থিব ইচ্ছের যাতায়াত তবে হবে কোন পথে?

মানুষ আসলে কি করে নিজেকে খুঁজে পায় তার ভেতরের প্রকৃত মানুষটিকে? কেউ কেউ নিজের জন্য একটি চরিত্র স্থির করে নেয়। কেউ কবির, কেউ সাধকের, কেউ জনপ্রতিনিধি কেউ যশস্বী কেউ ডাকাত তো কেউ ত্রাতার। তারপর সে সেই চরিত্রের অনুরূপ আচরণগুলি করতে থাকে। একসময় সে তার নিজের চরিত্রের হাতে বন্দি হয়ে পড়ে যখন চরিত্রটি তার নিজস্ব নয় কোনোমতে। আবার কখনো সেই চরিত্রের ভেতরেই তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। তবে সবটাই কি হয়ে ওঠা যায়? কিছু তো পূর্বনির্ধারিত বটে। রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হয়ে ওঠার গল্প সেও সত্য। কিন্তু সে কেবল হয়ে ওঠা নয়। সেই হলো আত্মার পূর্ণ প্রকাশ।

তুমি কি তবে ওই ঈশ্বরী প্রকল্পের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাও? আর কি তবে কোনোদিন তুমি বড় বেশি মানবী হয়ে উঠবে না? সারারাত ঝমঝম করে বৃষ্টি হয় যেদিন, তোমার কথা মনে পড়ে। তুমি কোথায়? কতদিন দেখিনি তোমায়, এ কথা ভাবলে একটা কষ্ট গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে। যাকে তুমি হেলায় ভুলেছ সে তোমাকে কিছুতে ভোলেনি, এ বড় বেশি সুন্দর নয় কি? শেষবারের মতো চলে যাওয়ার আগে আমাকে আরো কিছু বলে যেও লক্ষ্মীটি। জানি, আমার এ অপেক্ষা ফুরোবার নয়। কারণ, তুমি আর কেউ নও, তুমি আমার কবিতা। চলবে