শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫৫

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০২০

আইসোলেশন ১
একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হলো। সাথে রোদও উঠেছে। এমন হলে রামধনু ওঠে। ছাদে উঠে মনে হলো, যেন সদ্য স্নান সেরে উঠেছে। সোঁদা গন্ধে ম ম চারপাশ।

নেট ভালো চলছে না। এয়ারটেল ও ভোডাফোন দুটোই ভীষণ স্লো। ইচ্ছে করছে, ঘুমিয়ে পড়ি। সেল্ফ কোয়ারান্টাইনে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই মানুষ আইসোলেশনে চলে গেছে। মনের মতো সঙ্গী বলতে, ফোন।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা পড়েছিলাম সেই স্কুলে। কাল হঠাৎ মনে পড়লো। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলাম। দুটো-আড়াইটে হবে। ছাদে কার পদধ্বনি শুনতে পেলাম। পাশের ঘুমন্ত মানুষটাকে ডেকেছিলাম। তার ঘুম ভাঙেনি। শেষে আমিই ঘুমিয়ে পড়লাম।

জীবনে ভালো থাকার সময় ও কারণ, দুটোই যেন কমে আসছে। আর কোনোদিন রামধনু দেখতে পাব?

আইসোলেশন ২
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের ভেতর যা দেখলাম, মেয়ের স্কুলে ডক্টরস ডে পালন হচ্ছে। মেয়ে ডক্টর সেজেছে। এবং সে স্কুলের আয়া দিদিকে টানতে টানতে কোথায় একটা নিয়ে যাচ্ছে। মুখে বলছে, এসো এসো, কিচ্ছু হবে না।

এইসব দেখেশুনে আমি পালিয়ে এলাম। মনে হয়, থার্মাল স্ক্রিনিংয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে কেউ বেল বাজালো। একবার! দুইবার! তিনবার!

আইসোলেশন ৩
কাল সারারাত ব্যাপক বৃষ্টি হলো। বজ্র বিদ্যুৎসহ। আমার নদীর ধারে বাড়ি। বৃষ্টি হলে পৃথিবীকে এখানে যেন আদিম লাগে। আমি কল্পনা করি ঘন জঙ্গলের দিন। সেখানে বৃষ্টির জল ঝাপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। আমি আড়াল হই বুনো অশ্বত্থের তলে।

বজ্রপাতের শব্দ এখানে খুব প্রকট লাগে। মনে হয় যেন এই ঠিক আমার গায়ের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। পুরনো বাড়ির খরখরি দেয়া কাচের জানলায় বিদ্যুতের আলো লেগে ঘরের অন্ধকার মুহূর্তে আলোকিত হয়, পুনরায় সব অন্ধকার লাগে।

এমন কতবার। তবু কাল মনে হচ্ছিল, এ বোধহয় কোনও অশনি সংকেত। স্বর্গের দেবতারা রুষ্ট হলে পৃথিবীতে যে বার্তা আসে, এ বোধহয় তাই। তারপর মন চলে গেল শূন্যে:

Things fall apart; the centre cannot hold;
Mere anarchy is loosed upon the world,
The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere   
The ceremony of innocence is drowned

এই ভরা বর্ষণের রাতে সে-ই সুখি, যে কোনও মহৎ প্রেমের ভেতর আছে। আশ্চর্য এই, প্রেমকে আমি কোনও দিনই ভীষণ নিরাভরণ করে ভাবতে পারিনি। এই জীবন এই মৃত্যু এই সবই যেন প্রত্যাশিত। আকস্মিক বলে যা জেনেছি, তা সেই রাজকীয় প্রেম...

বিদ্যুতের আলোর মতো লহমায় সব আলোকিত করে নিমেষেই যে চির অন্ধকারে বর্জন করে স্বার্থপরের মতোই মহাভিনিষ্ক্রমণে চলে যায়...

আইসোলেশন ৪
ভারতবর্ষে করোনার যে দুর্ভোগ শুরু হলো তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। রোগটাকে বিদেশ থেকে রীতিমত ডেকে আনা হলো। ভারতবর্ষের মতো দরিদ্র ও জনবিপুল দেশে একে আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? বিপদকালীন তৎপরতায় অনেক আগেই উচিত ছিল, বিদেশ থেকে প্রবেশ বন্ধ করা। পাকিস্তান যদি সেটা করতে পারে, ভারত কেন পারবে না?

সরকার থালাবাটি বাজিয়ে আর লকডাউন বলে দায়িত্ব সারছে। রাজ্য সরকার একা কতটুকু পারবে? ভারতবর্ষের সাথে ইউরোপীয় দেশগুলোর কোনও তুলনা হয় না। এখানে প্রত্যেক দিন কাজে না বেরলে যাদের পেট চলে না, তাদের কি হবে? একটা দেশকে দেশের মানুষকে চূড়ান্ত অসহায়তার মধ্যে ঠেলে দেয়া হলো।

অনেক রাত অবধি জেগে ঝিঁঝির ডাক শুনলাম। আমার ধারণা ছিল, এরা অবলুপ্ত হয়ে গেছে। আমার কিছু কিছু ধারণা নিশ্চয়ই ভুল। রাত প্রায় একটা হবে। নাইট গার্ডের বাঁশির আওয়াজ শুনতে পেলাম। যাহ বাবা! কাকে পাহারা দেয় আজ? চোরেদের কী কপাল! উহাদের কোনও `লকডাউন` নাই।

সকালে বেশ ঝলমলে রোদ উঠেছিল । বারান্দায় বেরিয়েছিলাম কলাগাছ খুঁজতে। কারণ একশালিখ দেখে ফেলেছি জাস্ট। এই একটাই অন্ধবিশ্বাস আমার অনেক ছোটবেলাতেই মনের ভেতর ঢুকে গ্যাছে। হঠাৎ শুনি, টিনাভাঙা লোহাভাঙা বিকিরি... সেই আদিম সুর। ভাবলাম, এই দুর্দিনেও লোকে হাঁক শুনে বের হবে নাকি? ভাবতে ভাবতেই ভ্যান অদৃশ্য হলো গলির মোড়ে ।

একটু আগেই একটা ফোন এসেছিল, ম্যাম, গোল্ডেন ওয়েভ সলিউশন থেকে বলছি। দুমিনিট সময় হবে?
আমার হাতে এখন অখণ্ড সময়। কিন্তু, অতঃপর, সেকি! এখন তো লকডাউন চলছে। গোল্ডেন ওয়েভে কি করোনা মরে?
না, মানে... আপনার কি কোনও ওয়েবসাইট দরকার আছে?
আজ্ঞে না। এই বলে কেটে দিয়েছি।

ফোনটা রাখার মিনিট ঘুরতে না ঘুরতেই অন্য নম্বর থেকে ফোন। কিন্তু কণ্ঠস্বর সেই আগের জনের, ম্যাম, গোল্ডেন ওয়েভ সলিউশন থেকে বলছি। দুমিনিট সময় হবে?
আরে, আপনি তো এইমাত্র ফোন করেছিলেন।
কই, না তো।
না তো মানে?
মানে ম্যাম, মাত্র দুমিনিট সময় হবে?
কণ্ঠস্বর ছিল নেহাতই এক নারীর। তাই বেশি কিছু ভাবছি না। ভাবছি, করোনার চোটে লোকজন কী পাগলে গেল নাকি! এই মর পৃথিবীতে কেউ কারোর থেকে মাত্র দুমিনিট সময় চেয়েছে। এর জন্য আর কত রাগ করা যায়?

আইসোলেশন ৫
কাল অনেক রাতের দিকে অডিও লাইভে এসেছিলাম। শুধুই শব্দগ্রাহ্য, তাই নিজের সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন হয় না। চেতনার অন্তর্গত শব্দের স্রোত খুব আরাম করে প্রবাহিত হয়।

রাত হয়েছিল অনেক। তবু প্রায় এক ঘণ্টা এগারো মিনিটেরও বেশি কথা বলা হয়ে গেল। শেষে যখন থামলাম তখন প্রায় দুটো বাজে। তারপর লাইভ রেকর্ডটা চালিয়েই শুয়ে রইলাম। বেশ সুদিং লাগছিল। নিজের শব্দের পালক বুলিয়ে নিজেকেই শুশ্রুষা করছি যেন। শেষ যখন ঘড়ি দেখলাম, তিনটে বাজে।

আবারও আসার ইচ্ছে রইলো অডিও লাইভে। আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। মাথাটা যেন অসম্ভব ভারি। চলতে গেলে দুনিয়া টাল খাচ্ছে। সবই বড় বাহুল্য ঠেকছে। যুগ যুগান্ত পার হয়ে গেল। এত মানুষ এলো-গেল। কেউ কি সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছিল?

এখন বসে বসে চাল ডাল আটার হিসেব রাখি। দুধের। ওষুধের। বেঁচে থাকা বড় বালাই। এক টুকরো প্রকৃত সোহাগের বাসনা উড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায়...

আইসোলেশন ৬
আমার ভেতরেও কোথাও একটা দেশভাগ হয়ে গেছে যেন। এপার আর ওপার। দেশ ভাগের সময় যেমন রাতারাতি বহু মানুষকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল জন্মভিটে ছেড়ে কাঁটাতার টপকে... হাতে ছিল কেবল এক পুটুলি। জীবনের আহরিত কত সম্পদ, প্রিয় মানুষের মুখ, ক্ষেত খামার, বাড়ির পুকুরে ভেসে থাকা মাছ সকলই স্মৃতি হয়ে গিয়েছিল। কতই না অন্তর্লীন রক্তক্ষরণ ও জীবন যুদ্ধের কষাগাতে ক্ষয় হতে হতে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আমি সেদিনের সে সংগ্রামের শরিক ছিলাম না। আমি এমন কতই না সংগ্রামের শরিক হতে পারিনি।

আজ বুঝতে পারছি, কোথাও আমার ভেতরেও একটা দেশভাগ ঘটে গেছে। এপার আর ওপার। আমার জীবনের অর্ধেকটাই আমি ফেলে এসেছি অন্য কোথাও। আমার শৈশব, আমার বেড়ে ওঠা, আমার প্রথম যৌবনের স্মৃতি। আমার খেলাধুলো, আমার প্রথম প্রেম, আমার অজস্র বইয়ে ঠাসা আলমারি, প্রিয় চুড়িদার। আমার স্কুলের ডায়েরি, আমার নকশা কাটা গয়নার বাকসো, চুড়ি রাখার কাঠের স্ট্যান্ড। আমার রবীন্দ্র রচনাবলি, প্রেমিকের উপহার দেওয়া ফটোফ্রেম, পুরনো চিঠির দিস্তা। তারপর একদিন, ঠিক একটি দিনের ব্যাবধানে আমার এপার ওপার ঘটে গেছে। আমিও চলে এসেছি অন্য কোথাও। না, পালিয়ে নয়। কাউকে ভালোবেসে বহুদূর, ওপার থেকে এপার।

না, ঠিক বহুদূরও বলা চলে না। দেশান্তর আমার ঘটেনি। দ্বীপান্তরও নয়। কেবল ভেতরে ভেতরে একটা পার্টিশন ঘটে গেছে। কারণ আমার অনেকটা আমিকেই আমি আজও নিয়ে আসতে পারিনি। যতটুকু আনতে পেরেছি সে কেবল আমার অর্জন। আমার তিলে তিলে গড়ে ওঠা আমিটুকুকে। এপারের নোনা হাওয়া যাতে লেগে ঘটে গেছে অনেক অদল বদল। কিন্তু যা কিছু আমার অধিক প্রিয় স্মৃতি দুচারটে ব্যাগ বোঝাই হয়েও তার যেটুকু বা মাত্র এপারে এসেছে, ওপারে রয়ে গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি ।

প্রতিটি মানুষই এক একটি আলাদা ভূখণ্ড। যেই মাত্র একটি মানুষের হাত ছেড়ে অন্য আরেকের হাত ধরা হলো সে মাত্রই দেশান্তর। অথচ আমরা মেয়েরা কত সহজেই এটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছি। নিতে পেরেছি কারণ একটা কাঁধের ওপর আমাদের মোহ বড় বেশি ছিল, যা কাঁধ অতিক্রম করে অতি সহজেই একটি গোটা সংসারে তার শিকড় বাকড় গ্রন্হিত করতে দ্বিধান্বিত হয়নি। এই কারণেই তাকে তার স্মৃতি থেকে উৎপাটন করাও বোধহয় সহজ হয়েছে। ছেলেরা আঁকড়ে ধরে কম। কারণ প্রথম থেকেই তার বিচরণের ক্ষেত্রটি অসীম। আর মেয়েরা একটু ভালোবাসা পেলে কীই না করতে পারে তার ছোট্ট সীমার ভেতর!

আমার এই এপার আর ওপারের মধ্যে আজ কোনও কাঁটাতার নেই। যা আছে তা হলো, কেবলই এক মানুষ নিয়ন্ত্রিত সময়ের সীমারেখা। যা আছে তা হলো লকডাউন, কার্ফু। আজ আমি চাইলেই যেখানে যেমন খুশি বিচরণ করতে পারি না। আজ আমি সন্দিহান যে সীমার ওপারে আমার চলাচল আমার স্বেচ্ছার অতিরিক্ত অন্য কোনও শর্তে নিয়ন্ত্রিত হয়, সে দেশ আদৌ আমার কিনা।

এই সব কিছুর শেষে আমি নিজেকেই খুঁজে বেড়াই। তবে এপারের আমি? নাকি ওপারের আমি? নাহ্। কোনোটাই নয়। আমি ততটুকুই যতটুকু এ জীবন আমি আমার মাথার ভেতর ধারণ করতে পেরেছি। সেটুকুই অর্থবহ। বাকি যেখানে যা পড়ে আছে, সে সবই অতিরিক্ত। ওসবে আজ আমার কোনও প্রয়োজন নেই।