জীবনজুড়ে এত কোলাহল

পর্ব ২০

প্রকাশিত : মে ১৬, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ২০ পর্ব

৬ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার
সাত দিন সাত দিন করে খেলার মুলতবি হয়েছে আপাতত। আজ থেকে শহরের ভেতর চলতে শুরু করেছে গণপরিবহন। আগের মতোই দুই সিটে একজন করে যাত্রী বসানো হচ্ছে এবং ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৬০% বেশি। এবং আগের মতোই দাঁড় করিয়েও যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। তারপরও মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি দেখলাম। এই যে অতিরিক্ত যাত্রী উঠানো, অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া এসব নিয়ে কাউকেই উচ্চবাচ্য করতে দেখলাম না।

এর পেছনে কারণ হতে পারে বিগত দেড় মাসের অসহনীয় দুর্ভোগ, রিকশার সঙ্কট, সিএনজির সঙ্কট, পাঠাও উবারের সঙ্কট, গগনচুম্বী রিকশা ভাড়া, পুলিশের জেরাপনা ইত্যাদি। এরকম দুঃসহ নির্যাতনের মধ্যে গণপরিবহনের চলাচল নতুন করে মনে করিয়ে দিলো ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ থিউরিটা কতখানি যৌক্তিক এবং উপাদেয়।

আমি সকালে খুব সহজেই একটা প্রজাপতি বাসে উঠতে পারলাম এবং দশ টাকা ভাড়া দিয়ে আসাদ গেটে নেমে পড়লাম। অথচ গতকাল পর্যন্তও এটুকু পথ আসতে আমাকে প্রতিদিন গুণতে হয়েছে আশি টাকা-নব্বই টাকা রিকশা ভাড়া। বিকেলের দিকেও অফিস থেকে ফেরার সময় বাস পেতে খুব একটা সমস্যা হলো না। নির্বিঘ্নেই নীড়ে ফেরা গেল।

নীড়, অর্থাৎ বাসায় ফেরার পর ভাবলাম নিজের অনেক কাজ জমে গেছে। কাল শুক্রবার আছে, সারাদিন শুধু নিজের কাজ করব। প্রকাশক মহোদয় ম্যাজেঞ্জারে নিয়মিত নক করছেন আর জানতে চাচ্ছেন, উপন্যাস কতদূর এগোলো? জুনের মধ্যেই চাই কিন্তু। আরেক পুরনো প্রকাশক দু চারদিন পর পরই ফোন করেন, ভাই একটা পাণ্ডুলিপি দিতে চেয়েছিলেন, দিলেন না তো? এই ভদ্রলোকের সীমাহীন ধৈর্য দেখে আমি বিস্মিত। প্রায় তিন বছর ধরে তিনি আমার কাছে পাণ্ডুলিপি চেয়েই যাচ্ছেন। এক বড় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক একটা গল্প চেয়েছেন। আরেক সম্পাদক অনুবাদ চেয়েছেন। বন্ধু শ্রেণির দুইজন সুলেখক দুটো বইয়ের আলোচনা লিখতে অনুরোধ করেছেন।

আমি কাউকেই কোনো জবাব দিতে পারছি না। উপন্যাসটা গত বইমেলার আগেই শেষ করার কথা ছিল। পারিনি। গল্পের পাণ্ডুলিপিটা অনেকটাই প্রস্তুত, আর দুইটা গল্প হলেই হয়ে যায়। সেই দুটো গল্প গত এক বছরেও লিখতে পারিনি। প্রকাশক সম্পাদকরা যখন ভালোবেসে লেখা চান, আমি ম্যাসেঞ্জার আনইনস্টল করে দিয়ে ভালোবাসার প্রতিদান দেই। ফোন করলে ফোন রিসিভ করি না। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে ঠেলতে নিজেকে কোন আস্তাকুঁড়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি নিজেও বুঝতে পারছি না।

আমি তো চাই শুধু লিখতেই। কিন্তু জীবনজুড়ে এত কোলাহল...এত কোলাহল...! মা, আব্বার অসুস্থতা, বোনদের পড়ালেখা, নিজের চাকরির অনিশ্চয়তা, যেসব বন্ধু বিপদে আপদে সব সময় পাশে থাকে তাদের চাকরির নড়বরেবস্থা...আরও কত কি! এইসব কোলাহলের মধ্যে ডুবে থেকে শিল্পভাবনা ভাবতে পারি না। শব্দ, ভাষা, অনুভূতিরা আমার কলমে ধরা দেয় না। তারা সবাই আমার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকে। গভীর নির্জনতা ছাড়া তারা আমার কাছে এসে বসে না। মনে মনে ভাবি সিমেনোর মতো যদি একটা জীবন পেতাম।

সিমেনো ছিলেন ফরাসি লেখক। কোনো একটা নতুন বই লেখার আগে তিনি ডাক্তার ডেকে ব্লাড প্রেসার মাপাতেন, রক্ত পরীক্ষা করাতেন। তারপর বাড়ির দরজা বন্ধ করতেন। টেলিফোন নামিয়ে রেখে লিখতে বসতেন। টানা পনের বিশ দিন সকাল বিকাল লিখে শেষ করতেন একটা উপন্যাস। এরপর দরজা খুলে পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বেড়াতে চলে যেতেন কোনো প্রমোদতরীতে। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। পৃথিবীর চারটি দেশে ছিল তার বাড়ি। শুধু বইয়ের রয়্যালিটি দিয়েই গড়েছিলেন প্রভূত সম্পত্তি। এমন একটা জীবন যদি পেতাম! চলবে