লেখিকা

লেখিকা

তুমি আবার এসো আমার ভিতর

সঙ্গীতা দাশ

প্রকাশিত : নভেম্বর ১২, ২০১৯

মায়া ছিঁড়ে গেছে তোমার। ধীরে আমাকেও ছিঁড়ে যাবে তুমি। জল আঁকড়ে ধরার এই অন্ধ স্মৃতি থাকবে তোমার? আমি মনে রাখবো দুই মাসের গর্ভ-আলো, রক্তপাত, ঝড়? অনেক রক্ত নিয়ে কোন ইশারায় ঝরে গেছ তুমি। এখন কোন প্রান্তে যাব? কোন কোনায় লুকোবো? আমার ভিতরে হারিয়ে যাওয়া তুলোর দলা, তোমার অন্ধকার নিয়ে তবে উঠে বসি ট্রেনে।

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গ্যাংটক। অর্বাচীন, বিপদ-বোধহীন আমি হেঁটে তো পৌঁছেছিলাম নন্দাদেবির দুর্গম পাদদেশে! তবে মটরসাইকেলে গুরুদোংমার শুনে এবার কোথা থেকে মাথায় ছড়িয়ে গেল দ্বিধা! দেবদারু, আমার গর্ভ-রক্ত নিয়ে ঝরে গেছ যেদিন, সেদিন থেকে আমি ভীত।

কিন্তু প্রলয় জেদ ধরা শিশু। বাইক রেন্টের জন্য খোঁজ খোঁজ। আমার অনেক যুক্তি, প্রতি যুক্তি, নীরব রাত পেরিয়ে অবশেষে জোগাড় হলো না কোনও যানবাহন, গুরুদোংমার যাওয়ার পারমিট। তাই পরদিন সকালে চড়ে বসা শেয়ার জীপে, যাব মংগন, সেখান থেকে পূর্ব-নির্ধারিত জঙ্গু। পাশে বসে আছে কাঙ্ক্ষিত পথে যেতে না পারা আমার অভিমানী বালক। জীপের ভিতরে হাওয়া বইল না দখিনা, আমাদের কথা বন্ধ। এরপর এই গুমোট গিয়ে ছুঁয়ে ফেলবে এমন কি কর্মাকেও। কর্মা লেপচা ছটফটে পাহাড়ি ধারার মতো ছুটে এসেছে। মঙ্গন থেকে গাড়িতে করে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের আপার জঙ্গুতে। এমন সবুজ পথেও দুজনের এই চুপচাপ, ওকেও বিচলিত করে দেখি। দু’হাজার ষোলো সালের ল্যান্ডস্লাইডের পর ধ্বংসস্তূপের মতো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। হঠাৎ রাস্তা শেষ। এ গাড়ি এ পর্যন্তই।

সামনে রংইয়ং নদী। বুকে আকাশ নিয়ে থেমে আছে। ভূমিকম্পে ভাগ হয়ে গেছে সে। বুক চিরে দিয়ে উঠে এসেছে স্থলভূমি, বালির চরাচর। এভাবেই বিরাট কম্পন বুঝি ঘুরিয়ে দেয় গতিপথ, গড়ে দেয় শূন্যস্থান। শূন্যস্থানে ঝুলছে লোহার সাঁকো। হেঁটে পেরিয়ে যাও, ওপাশে আবার রাস্তা, ওপাশে আবার গ্রাম। পা দিয়েছি সাঁকোয়, অমনি একটা সরল হাওয়া ওপার থেকে ছুটে এলো। আর আমাদের একদিনের বাসি অভিমান তারই সাথে ছটফটিয়ে পালালো কোথায় দূরে। সাঁকো আবার গড়ে তুলল সাঁকো। হাওয়ায় চুল উড়িয়ে নেমে গেলাম বালি তীরে। রংইয়ং এর শীতল ছুঁয়ে এখন বসে থাকি। মায়ের গভীর গহ্বর থেকে তুমিও বুঝি ঝরে গেছ অসময়ে, রংইয়ং! মূল স্রোত তো তার সব ধারা নিয়ে বয়ে গেছে অন্য পথে। এই একরত্তি তোমাকে ছিঁড়ে দিয়ে গেছে কোনও অস্থির ভূমিকম্প। এখন হ্রদ হয়ে জেগে থাকো বালি চরে, মাতৃস্পর্শ থেকে দূরে, একা।

পঁয়ত্রিশের বালক কর্মা এবার নেমে এলো ছটফটে আনন্দ ঢেউ নিয়ে। এরপর বালির গায়ে হুটোপাটি, দৌড়, হাসি খেলা চলল অনেক। উপরে চিলতে এক ছাউনি থেকে এবেলার খাবার ডাক পড়েছে— রংইয়ং এর পাথরের খাঁজে ঘুরে বেড়ানো ঝিঁঝিপোকা ভাজা, বিফ মোমো আর বিয়ার। কর্মার এই বন্দোবস্ত! ছোট মালবাহী গাড়ি এলো এক, ঘরে ফিরছে সে। তাতেই উঠে বসলাম অপেক্ষারত পাঁচ-ছয় জন। আমরা দুজন কেবল অর্বাচীন, আর সবাই এ গ্রামেরই মানুষ। পৌঁছে দিলেন আমাদের গন্তব্যে। ধন্যবাদ ছাড়া স্বীকার করলেন না আর কোনও মূল্য।

এক ফালি জলধারা পেরিয়ে শিশুর মোমরঙে আঁকা একাকী চেরি গাছ ফুল ছড়িয়ে দিয়েছে বুনো ঝোঁপে। ওই তো স্কোয়াশ বাগানের পাশে কর্মার হলুদ, বাদামি বাড়ি। আগামী দুই, তিন অথবা চারদিন আমাদেরও বাড়ি। এই বাড়িতে খাবার তৈরি করে অপেক্ষা করে আছে একজন দেবদূত! কালদে, একটি সতেজ কিশলয়। কর্মার ছোট ভাই। সিকিম পুলিশে নির্বাচিত হয়েছে। গ্রামের মধ্যে প্রথম সরকারি চাকরির দাবিদার। ট্রেনিং যতদিন শুরু না হয় সাহায্য করছে দাদার কাজে।

সোনার জঙ্ঘা মিলিয়ে আছে মেঘের বেশে, আজ আর তার দেখা পাওয়া যাবে না। কর্মার আশ্বাস, কাল ভোরে বাড়ির চালের ওধারে স্পষ্ট হবেন কাঞ্চন। সন্ধ্যার পর হাজির গ্যালাক্সি। আর মিল্কিওয়ে জুড়ে জুড়ে আকাশ ছুঁড়ে দিচ্ছে বিস্ময়! তারার একটি ধূলোকণিকা, তুমি আবার এসো আমার ভিতর শস্যে।

কাঠের জানালায় স্কোয়াশ পাতার ফাঁকে মৃদু অলোর ভোর, কিন্তু কাঞ্চন? সব মেঘে মেঘে ধোয়া। চল ওই দূরের গায়ে, বনের পথে। সঙ্গী কালদে আর মেঘ। মৃদু পাহাড়, ঘন বৃক্ষ। এ রাস্তা সহজ, যেন ছোটবেলার খেলনাবাটির বন। ঝুলনের সাঁকো, ঝিরি নদী। কালদে শেখায় কোন বিশেষ ফার্ন আহার যোগ্য। তারপর ফার্নবনে হারিয়ে যাও তিনজন। সবাই পেল সেই বিশেষ সবুজ, কেবল আমার হাতে একটি দুটি। এরপর এগুলোই হবে আমাদের সান্ধ্য অনুপান। এর অনেক পরে কোলকাতার কোনও এক প্রাচীন বাজারে কোনও এক প্রাচীনা বৃদ্ধার কাছ থেকে জোগাড় করে আনা হবে এই ফার্ন, যার নাম জানা যাবে বৌশাক। ওই ফার্নের স্বাদে-গন্ধে আমরা ফিরে যাব আবার কর্মার ঘরে, কালদের শান্ত উচ্ছ্বাসে।

বনের পথে এক অপার মহীরুহ তার শরীরে ফুটিয়ে রেখেছে ছোট্ট, লালচে ফল। কালদে শেখায় খাবার প্রণালি। আরে, এ যে কিউইর ছোট ভাই! মন ভরে খাই তবে।

সন্ধ্যেয় এলো নতুন অতিথি হানা গোল্ড, ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে নতুন নতুন ঘরের খোঁজে। আর সেসব নবীন পরিবারের কথা লেখে জার্নালে। বাঁশের খোলে চি সহযোগে ছুটছে আমাদের গল্পের ঘোড়া। সবচেয়ে জোরে দৌড়চ্ছে অতীতের বেশ নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় কর্মা। আর কালদে স্তিমিত, বিচক্ষণ। দাদার পরিপূরক। এভাবে সন্ধ্যে নামে ঝিনঝোটি রাগে। হানার আগ্রহ দেখি এই অপরিচিত সঙ্গীতের ধারায়। রক সঙ্গীতে অভ্যস্ত কান স্বাদ নেয় প্রাচ্যের।

সকালে বৃষ্টি। আচ্ছা বেশ! রেইনকোট পরে বের হই। আজ আমরা পাঁচজন। গন্তব্য উপরের গ্রামের ঝর্ণা। মৃদু ট্রেক, তবু আমার শ্বাসকষ্ট, যেমন প্রতিবার শুরুতে হয়। এরপর বেশ লাফিয়ে, মাটির পথে আছাড় খেয়ে, বুনো পেয়ারা খেতে খেতে পেয়ে গেলাম রামধনু ঝর্ণা। ফেরার পথ ছিল মনোহর দুর্যোগের পথ। ঝুম বৃষ্টির পথ। সরু বাঁশের খোলে ওয়াইন নিয়ে আমরা ক’জন। আমাদের সবার নিজস্ব শূন্যতায় ঢুকে পড়ে নিঃসঙ্গ হাওয়া, অদৃশ্য বন্য ঘ্রাণ। এই আদিমতম পথ ধীরে পার হই আমরা।

ফেরার ক্ষণ প্রস্তুত। হানা সঙ্গী হলো আমাদের। কর্মা ওর ফ্ল্যামবয়েন্সি দিয়ে শেষ পর্যন্ত একরেখায় থেকে গেল এই চারদিন। বিদায়ও প্রাণবন্ত তাই। এমনকি একাকী সেই চেরি ব্লসম একসাথে দাঁড়িয়ে রইল জীপের অপেক্ষায়। যাত্রী প্রতুল, তাই সকলে সুজন। হাঁটু মুড়িয়ে ঝুঁকে বসে, তবু হাসি, তবু গন্তব্য সেই ছিন্নতার সেতু। পার হই সেতু। এবার আর অপেক্ষা নেই, ছিন্ন মায়া নেই, হাসি নেই, বালি তীর নেই, খেলা নেই। ওপারেই দাঁড়িয়ে জীপ। উঠে বসি সব্বাই। কিছু বাঁক ঘুরতেই এসে পড়ে মঙ্গন। হানার পথ লাচেনগামী, নতুন কোনও ক্ষণিকের পরিবার খুঁজে নেবার আশায়।

আর আমি নেমে যাব নিচে একটি নক্ষত্রের ধুলোকণা আত্মায় ধারণ করে। একটি ছিন্নতার স্মৃতির গায়ে বুনে নেব নতুন দেবদারু বীজ, নতুন সঞ্চার।

লেখক: কবি ও শিক্ষক