দেবাশীস তেওয়ারী
দেবাশীস তেওয়ারীর কবিতাগুচ্ছ
প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২০
পরমহংস
একটা পাতা উড়তেছিল এবং তোমায় বলতেছিল, দেখো একটা ফুলের উপর কয়টা ভ্রমর পাপড়ি হচ্ছে। তবু তুমি ভাবতেছিলে, একটা সূর্য একা কোনো ভোরবেলাতেই মার্কারি রং চিচিংফাঁকের দস্যুদল!
একটা নৌকা আঁকতে গিয়ে একটা নদী আঁকতে হবে। তাহার উপর মেঘ, মেঘের নিচে লম্বা গলার সারসগুলি উড়তে থাকবে। তাতে কোথাও বনের মতো একটা কিছু থাকবে যদি, আবার খড় আবার কুঁটো আঁকতে গিয়ে অনেক রং অনেক কালি আনতে হবে, ভেবে
হংস তোমার জলের উপর বসত করে, বসত গড়ে না।
হ্যামিলন
হ্যামিলনে হাঁটতেছি করুণ বাঁশির সুরে, আগে আগে হাঁটতেছে জন্মের আগেই মৃত ভূমিষ্ট হওয়া প্রিয়
আত্মজা সহোদরা। তার পেছনে
বাবার আঠেরোতে বিধবা হয়ে যাওয়া পিসি,
মান্দার ফুল ফোটা দুই দেউড়ির মাঝ দিয়ে
বাড়ি ফেরা মেজোকাকা, তার কান্তিময়
ঝাঁকড়া চুলে হাওয়াঢেউ মুখ হাঁটতেছে।
কলকাতার বাতাসে জন্ম-পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে
গায়ে আগুন ধরিয়ে মরে বেঁচেছিল যে অভিমানি বোনটা
উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতেছে
বৈশাখী ঝড়ের পর আম কুড়াতে গিয়ে নাফেরা দিদিমা, ঠাকুমা সবাই হাঁটছি
সাদা কালো বাদামি মানুষ, মানুষের ভিড় হাঁটতেছে।
হাঁটতেছে মানুষের গল্প, মানুষের মায়া
সবার আগে আগে হাঁটতেছে
আলখাল্লা পরা সেই নির্বিকার বাঁশিঅলা
এক ত্রিসন্ধ্যা বেলা।
গান
সব গান ফুড়িয়ে যায়নি এখনো মানুষের
মেঘের ওপারে রয়ে গেছে কিছু
কিছু রয়ে গেছে তারাদের কাছে
সবচে বিষণ্ণ যে ডলফিনটাকে ধরে বেঁচে দিয়েছিল মুলারের ভাইয়েরা
শুড়িখানায় রক্ত বমি করেছিল ম্যাথিউস।
যতবার মেট্রোতে সে ভায়োলিনে বাজাতে চেয়েছে এই সুর
নীল চাঁদের মদে
ঝাপ দিতে গিয়ে বিপন্ন হয়েছে ডলফিনগুলি
কিছু গান নিয়ে জেগে আছে রাত্রিচর শ্মশান ঘুঘুরা।
গেম
গোপনে আমটি দুধে মিশে গেল
শুধু আঁটি রয়ে গেল।
দেখলাম,
শুনলাম,
বুঝলাম,
কিন্তু কিছু বললাম না।
বললে চাকরি থাকবে না।
সাধন
কালীপূজা এলে আমি আর বাবা মিলে
সারাদিন বনে বনে কাঠ কুড়াতাম
বাবা কাপালিক ছিল
আমিও ছিলাম
মড়ার খুলিতে বাবা তাড়ি খেত, অঘোরির মতো
যজ্ঞের আগুনে তেতে লাল হতো কামনা-বাসনা যত।
বহুদূরে সমতলে আস্তিক ও ঠাকুরেরা থাকে
ফুল ফল দূর্বা ঘৃত চন্দনকাঠের মতো
দেবিরাও তুষ্ট হয়ে তাদের যজ্ঞের ঢাকে
আরতিতে নাচে যেন পূজারির মাংসের ফুল
বাবা পশু হয় ঈর্ষায়, দেখে আমি পশু হই
শূলে চড়িয়ে পশু, বাবা বলিকর, আমি বলিকর হই
গোপন মন্ত্রপাঠে বাবা শাক্ত অন্ধকার, আমিও।
ধান ও সন্তানের দ্রোহে সঞ্চারি তান্ত্রিক, নতজানু নই
ছোঁয়া
কথাশিল্পী ওয়াসি আহমেদকে উৎসর্গীকৃত
বৃষ্টিতে ভেজাই ভালো, ছুঁয়ে যেতে নেই
ছুঁয়ে গেলে, পড়ে যাওয়া বেড়ালটি থাকবে কার্নিশেই
সারাদিন তুমিই ঝরবে কার্নিশ থেকে পড়ে যাওয়া বেড়ালে
ছুঁয়ে যেতে নেই কোনও ক্ষত, এই ঘোর পতনোন্মুখকালে।
হুতুম পেঁচা
একটিও বৃক্ষ আর তার শাখা বাদ নাই
যেখানে অন্তত একবার বসা হয় নাই
পাখিগুলি চেনা সব
ঘুরেফিরে একই গান গায়,
গানেই নিহিত থাকে—
তারা কে কোন ঠিকানার!
কোথাকার কোন রেণু
কোথায় কোথায় ওড়ে, এই যে ছড়িয়েছে
ধূপ ও ধাতুর এমন মৃন্ময়ী সুতোর আকার!
যাপনের রূপে— সেও এক আটপৌরে বাস্তুধেনু
পাখি, এবার তোমাকে তোমার বদলানো দরকার