নামাজে মন ফেরানো

পর্ব ৫

শারিন সফি অদ্রিতা

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২০

একবার রসূলের (সা.) সাথে ফেরেস্তা জিবরাঈল (আ.) বসে ছিলেন। হঠাৎ জিবরাঈল (আ.) উপর থেকে একটা শক্ত ক্রিকিং (creaking) শব্দ শুনতে পেলেন এবং মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটি হচ্ছে আকাশের এমন একটি দরজার শব্দ যা আগে কোনোদিন খোলা হয়নি।’ সেই দরজা দিয়ে এমন একজন ফেরেশতা আসলেন যিনি আগে কখনো পৃথিবীতে আসেননি। সেই ফেরেস্তা রসূলুল্লাহের (সা.) কাছে এসে বললেন, আপনি দুটি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করে আনন্দিত হন। যা আপনাকে দেয়া হয়েছে তা আপনার আগে কোনো নবিকে দেয়া হয়নি। সেই দুটি নূর হচ্ছে,  সূরা ফাতিহা ও বাকারার শেষ দু’আয়াত। (মুসলিম শরিফ: ৮০৬)

সুবহানআল্লহ! সূরা ফাতিহা পড়ার সময় আমাদের কি একবারও মনে হয়, এটি আল্লাহর তরফ থেকে আসা এমন এক নূর যা আমাদের উম্মতকে ছাড়া আর কোনো উম্মতকে দেয়া হয়নি? আসুন, নামাজে মন ফেরানো সিরিজের আজকের পর্বে আমরা সূরা ফাতিহা নিয়ে বিস্তারিত জানার এবং বুঝার চেষ্টা করি ইনশাআল্লহ। এটা মাথায় রেখে পরের অংশগুলো পড়ুন যে এই সূরা আপনার জন্যে পাঠানো আল্লাহর তরফ থেকে আসা বিশেষ আলো।

আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন— যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। এই আয়াত নিয়ে বিস্তারিত গত পর্বের আলোচনায় পাবেন। আর রহমানির রাহিম— বলুন তো আল্লাহ কেন তাঁর দয়ার কথা বলতে গিয়ে রহমান শব্দটা ব্যবহার করলেন? এর একটা চমৎকার কারণ আছে। আরবিতে মায়ের গর্ভ এবং রহমান শব্দ দুটি একই রুট ওয়ার্ড (root word) থেকে এসেছে। আরবিতে একই রুট ওয়ার্ড বা মূলশব্দ থেকে যে শব্দগুলোর উৎপত্তি হয়, তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক থাকে। তাহলে মায়ের গর্ভ ও আর রহমানের মধ্যে সম্পর্ক কী?

একজন মা নয়মাস ধরে একটা বাচ্চাকে পেটে ধরে। শতকষ্টের মধ্যেও সবসময় খেয়াল রাখে, বাবু ঠিক আছে তো? নিজের খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সবকিছু খুব সতর্কতার সাথে মেনে চলে। ছোট বাবুটা মায়ের পেটের ভিতরে বসে বসে মায়ের প্লাসেন্টা দিয়ে সবরকমের পুষ্টি শুষে নিতে থাকে। এই বাবুকে দুনিয়াতে আনতে গিয়ে একজন মায়ের প্রচণ্ড প্রসববেদনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনেকে এই প্রসেসে প্রাণ হারায়। যারা বেঁচে যায়, তাদের জন্যে শুরু হয় আরেক পরিশ্রমের যাত্রা! রাতের পর রাত জেগে থাকা। দিনের পর দিন ডায়পার-ডিউটি। এক সেকেন্ডের জন্যে চোখের আড়াল হলে ছোট বাচ্চা খেলনা গিলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলবে! যেই বাবুটা পেটের ভিতরে থেকেও কষ্ট দিলো, পেট থেকে বের হতে গিয়ে প্রায় মৃতপ্রায় করে দিলো, বের হয়েও সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখছে, তার একটু কান্নার শব্দ শুনলে মায়ের কী অস্থির লাগে! বাচ্চার একটু অসুখ হলে মনে হয় জান বের হয়ে যাচ্ছে! এ এক আজিব শ্রেণির প্রজাতি মায়েরা! কল্পনা করতে পারেন, আল্লাহ আমাদেরকে এই মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসেন!

মায়ের গর্ভ ও রহমানের মধ্যে সম্পর্কটা মাইন্ড ব্লোয়িং। বাচ্চা যখন মায়ের গর্ভে থাকে, সে কিন্তু তার মাকে দেখতে পারে না। মা যে কিভাবে তার জন্যে পা টিপে টিপে হাঁটছে, একটু পরপর বমি করছে, বাচ্চার জন্যে দুয়া করছে, বাচ্চা নেক হবার জন্যে দিনরাত কুরআন তিলাওয়াত করছে— অবুঝ বাচ্চা কিন্তু সেটা দেখতে পারে না। ঠিক যেমন আমরা অবুঝ বান্দারা আমাদের আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখতে পারি না। আল্লাহ কীভাবে দিনের পর দিন আমাদের খেয়াল রেখে যাচ্ছেন, আমাদের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন— সে ব্যাপার নিয়ে আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ছোট্ট বাচ্চাটা যেমন তার মায়ের গর্ভে পরম মমতায় মোড়ানো, ঠিক সেইভাবে আমরা চারপাশ থেকে আল্লাহর রহমত আর দয়া দিয়ে পরিবেষ্টিত। ছোট বাচ্চা মাকে জ্বালিয়ে মাথা নষ্ট করে দেয়ার পরেও যেমন বাচ্চাকে ছাড়া মায়ের চলে না, তেমনি আমরা মিনিটে মিনিটে আল্লাহর অবাধ্য হবার পরও আল্লাহ আমাদেরকে ছেড়ে দেন না। আমাদের প্রতিপালক যে রহমানুর রহিম।

মালিকিইয়াও মিদ্দীন— আগের দুই আয়াতে আল্লাহর এমন মহানুভবতা এবং ভালোবাসার কথা শুনে বান্দা ভাবতে পারে, আমার প্রতিপালকের এত দয়া! তাহলে আমি যতই গুণাহ করি না কেন, তিনি তো শেষমেশ আমাকে ক্ষমা করেই দিবেন। এই ধরণের ভাবভঙ্গি থেকে মানুষ যেন আল্লাহর দয়াকে সহজলভ্য ভেবে পাপে না জড়িয়ে পড়ে, সেজন্যে ঠিক পরের আয়াতেই আল্লাহ বলছেন যে, তিনি হলেন মালিকিইয়াও মিদ্দীন, অর্থাৎ তিনি কিয়ামত দিবসের মালিক। এমন এক দিনের মালিক আল্লাহ, যেদিন প্রতিটা কাজের পাই পাই হিসাব নেয়া হবে। আল্লাহ তার দয়াতে যেমন অতুলনীয়, তেমনি তার ন্যায়বিচারও অকাট্য। তিনি মায়ের থেকেও আমাদের বেশি ভালোবাসেন দেখে আমরা যা ইচ্ছা তাই করে পার পেয়ে যাব, সেটা হবে না।

ইয়্যা কানা`বুদু ওয়া ইয়্যা কানাস তাঈ`ন— আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। প্রথম তিন আয়াতে আল্লাহর পরিচয় এভাবে পাওয়ার পর আমরা বান্দারা আল্লার কাছে নিজেদের পুরোপুরি সমর্পণ করে দেই এই আয়াতের মাধ্যমে। যে আল্লাহ আমার প্রতিপালক, রহমানুর রহিম, মালিকিইয়াও মিদ্দীন, আমি কীভাবে তাঁর ইবাদত না করে থাকতে পারি? এই আয়াতের প্রথম অংশে ইবাদত করার এবং পরের অংশে সাহায্য চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ আমরা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া তাঁর ইবাদতটুকুও করতে পারবো না। আরবিতে অনেক শব্দই আছে যেটার মানে সাহায্য। কিন্তু এই আয়াতে সাহায্য বুঝতে আল্লাহ বাছাই করেছেন আরবি শব্দ ইস্তিয়ানা। ইস্তিয়ানার বিশেষত্ব হচ্ছে, যে ব্যক্তি সাহায্য চাচ্ছে, সে নিজে এরই মধ্যে নিজেকে সাহায্য করার জন্যে সবরকমের কাজ করে যাচ্ছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টারত থাকা অবস্থায় যে সাহায্য চাওয়া হয়, তাকে বলে ইস্তিয়ানা বা নাস্তাঈন।

আল্লাহর সাহায্য এবং হিদায়াত সস্তা না। আমরা নিজেরা কোনোরকমের চেষ্টা না করেই যদি খালি আল্লাহর কাছে দাও দাও করি, তাহলে হবে না। আমাদের দুইহাত তোলার সাথে সাথে নিজেদের উটের দড়িটাও বাঁধতে হবে। আল্লাহর দিকে এক কদম এগিয়ে আসলে আল্লাহ তা`য়ালা বান্দার দিকে দশ কদম এগিয়ে আসবেন। কিন্তু অন্ততপক্ষে প্রথম স্টেপটা বান্দাকে নিতে হবে।

ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম— আমাদেরকে সরল পথ দেখাও। আমরা তো আগের আয়াতে বললাম যে, আল্লাহ আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি। কিন্তু, এই ইবাদতটা কীভাবে করলে আল্লাহ সবচেয়ে খুশি হবেন সেটাও তো জানতে হবে। নিজের মনমতো কাজ করে ফেললেই সেটা ইবাদত হয়ে গেল না। তাই এই আয়াতে আমরা আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে দিক-নির্দেশনা চাচ্ছি। সীরাতাল মুস্তাকিমের পথ চাচ্ছি। সীরাত মানে যেই পথটা স্ট্রেইট, সহজ এবং পরিষ্কার। একটা রাস্তা যখন পুরোপুরি স্ট্রেইট বা সোজা হয়, তখন দূর থেকেও সেই রাস্তার শেষ মাথার গন্তব্য ক্লিয়ারলি দেখা যায়। মুসলিমরাও তাদের গন্তব্য এবং জীবনে চলার পথের উদ্দেশ্য নিয়ে এমনই ক্লিয়ার ধারণা রাখে— তারা চায় আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং জান্নাত। মাছির পাখার চেয়েও তুচ্ছ দুনিয়ার পিছে তারা ছুটবে না। ফলে দেখা যায় যে, দুনিয়াই তাদের পিছনে ছুটতে থাকে। সুবহানআল্লাহ!

সিরাতাল্লাযীনা আন আমতা আলাইহিম গইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দল্লীন— সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। এর আগের আয়াতে আমরা আল্লাহর কাছে ইন্সট্রাকশন চেয়েছি, এই আয়াতে আমরা চাচ্ছি জলজ্যান্ত রোল মডেল এবং উদাহরণ। গণিত ক্লাসে অঙ্কের সমাধান পুরোটা বইয়ে করে দেয়া থাকলেও একজন গণিতের টিচারের প্রয়োজন হয় যিনি স্টেপ বাই স্টেপ আমাদেরকে অঙ্ক করাটা প্রথম বার দেখিয়ে দেন। ঠিক তেমনি আমাদের নবিব-রসূলরা আমাদের টিচার। অনেক আত্মত্যাগ করে তারা স্টেপ বাই স্টেপ আমাদেরকে দ্বীন পালনের ব্যপারগুলো হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

`সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ— এরাই সেই হচ্ছেন নবি-রসূলদের (সা.) দেখানো আদর্শ। তারা যেই উদাহরণ সেট করে গিয়েছেন আমাদের জন্যে, আমরা সেটা ফলো করতে পারলে দুনিয়া-আখিরাতে কল্যাণ পাব ইনশাআল্লাহ। শুধু ভালো উদাহরণই যথেষ্ট না। শাস্তি বা ফেইল মার্কের ভয়ও মোটিভেশান হিসেবে কাজ করে। সেজন্যে পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্টের সাথে সাথে নেগেটিভ রিইনফোর্সমেন্টরও উদাহরণ আছে আয়াতের পরের অংশে। আমরা আল্লাহকে বলছি যে, আমরা তাদের পথ চাই না যাদের উপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়েছে। এরা হচ্ছে সেসমস্ত লোক, যাদেরকে আল্লাহ সঠিক জ্ঞান দিয়েছেন, তারপরও তারা আল্লাহকে মানেনি। জেনেবুঝেও ইসলামকে পালন করেনি। তাদের জ্ঞান ছিল, কিন্তু কোনো সৎকর্ম ছিল না।

অপরদিকে ওয়ালাদ্দোল্লীন হলো যারা পথভ্রষ্ট, তারা সেসমস্ত লোক যাদের হয়তো ভালো ভালো কর্ম আছে, কিন্তু তারা সেটা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যে করে না। নিজের জন্যে, দুনিয়ার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে করে, তাই তারা পথভ্রষ্ট। ঈমানহীন কর্ম এবং কর্মহীন ঈমান দুটাই মূল্যহীন। এই দুইই আমাদের দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংষ করে দিতে যথেষ্ট। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আপনি কি জানেন, ফাতিহার প্রতিটা আয়াতের বিপরীতে আল্লাহ আপনার কথার জবাব দিচ্ছেন? গা শিউরে উঠছে না এটা ভেবে? এটা সত্যি যে, আমাদের মতো নাম-না-জানা নাফরমান বান্দার পাঠ করা প্রতিটা আয়াতের জবাব আল্লাহ দেন। রসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার ও বান্দার মাঝে সালাতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে আমার কাছে চায়। যখন বান্দা বলে, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে।  বান্দা যখন বলে, আর-রহমানির রহিম, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণাগুণ বর্ণনা করছে। আর যখন বান্দা বলে মালিকি ইয়াওমিদ্দীন, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমাকে সম্মানিত করছে।

যখন বান্দা বলে, ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়াইয়্যাকা নাস্তা‘য়ীন, আল্লাহ আমরা শুধু তোমারই ইবাদাত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই, তখন আল্লাহ বলেন, এটি আমার ও আমার বান্দার মধ্যেকার ব্যাপার, আমার বান্দার সেটাই পাবে, যা সে আমার নিকট চায়। আর যখন বান্দা বলে, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম, সিরাতল্লাযীনা আন‘আমতা আলাইহিম, গাইরিল মাগদূবে ‘আলাইহিম ওয়ালাদ্দাল্লীন— সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে, তখন আল্লাহ বলেন, এটি আমার বান্দার জন্য! আমার বান্দার জন্য রয়েছে তা, যা সে চায়।  (মুসলিম, সালাত অধ্যায়)

মহাপরাক্রমশীল রবের সামনে পিপীলিকার চেয়েও নগণ্য এবং গুনাহগার বান্দা আমরা। কিন্তু তিনি আমাদের প্রতিটা কথার জবাব দেন এবং দিয়েই যাচ্ছেন। সালাত এমনই শক্তিশালী এক ইবাদত! সুবহানআল্লাহ! চলবে