নীহার লিখনের গল্প ‘মা’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১১, ২০২১

হাসপাতালের গন্ধের মধ্যে একমাত্র এই জায়গাটাতে এলেই একটু অন্য রকম হয় মন। কয়টা মুদি আর ফলের দোকানের সাথেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ক্যান্টিনের সামনে পায়ে হাঁটার লনের দু’পাশে গাছপালার ফাঁকে অন্ধকারটাকে মায়াবী লাগে। হাসনাহেনার গন্ধে এককোনায় একটা গাছের পাকা বেদিতে বসেছিলো তিথি। রাতটা প্রায় শেষের দিকেই চলে এসেছে, শব্দে বোঝা যায়। সর্বশেষ যখন সে হাসপাতালের বাইরে একটা ইঞ্জেকশন আনার জন্যে গেছিল তখনই ছিল বারোটা ছুঁইছুঁই, তখন হাসপাতালের সামনের রাস্তাটা পার হওয়াই যেন দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন একটা কাজ মনে হচ্ছিল তিথির। মনে হচ্ছিল, শহরের সব অটোরিকশা আর গাড়িগুলো যেন এখানেই এসে লাইন ধরে আছে , কোনোমতে এদের ফাঁক গলে ওপারের ঔষধের দোকানগুলোতে যেতে তার যেন বেশ ঝুঁকিই নিতে হয়েছিল। ভাগ্যিস একটা ডিভাইডার ছিল রাস্তাটার, এবং যার জন্যে কুচকিতে টান নিয়েও খুঁড়িয়ে পাড় হতে পেরেছিল সে। ডিভাইডারটি না থাকলে হয়তো ঝামেলাতেই পড়তে হোতো, তখন হয়তো বাধ্য হয়েই অপরিচিত কাউকে অনুরোধ করতে হতো , যদি সেই মানুষটি ভালো মানুষ কেউ হোতো তো কথা নেই , তা নাহলে টাকা ও ইঞ্জেকশন কিছুই আসতো না।

অচেনা এ রাতের শহরে মুমূর্ষু মায়ের চিকিৎসায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই ইঞ্জেকশনটির জন্যে তাকে সেরকম কোনো রিস্ক নিতে হয় নাই , নিজেই কোনোমতে রাস্তাটা পার হয়ে ইঞ্জেকশনটি নিয়ে এসেছে, খুব কাছ থেকে শুনে এসেছে যে হইচই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতালের লিফটে উঠতে উঠতে সে শব্দ কিছুটা পাতলা হয়ে গেছে। তবে কানে সারাদিনই একটা গুমট লেগেই থাকে যেন, আর লাগোবেই বা না কেন, হাসপাতালের সামনেই যে রাস্তাটি সেটি দ্বৈত সত্তার একটি রাস্তাই যেখানে শহরের অটোরিকশা আর গাড়ির পাশাপাশি এই জেলার পাশাপাশি পার্শ্ববতী দু`একটি জেলার দুরপাল্লার বাসগুলো সমানতালেই চলে। তারা দম ছেড়ে দিয়ে ভেঁপু বাজায়। যদিও মোড়ে লেখা থাকে সতর্কতার সে নোটিশটি, সামনে হাসাপাতাল বলে ভেঁপু না বাজানোর জন্যে, কিন্তু এটা বাংলাদেশ বলেই নোটিশ নোটিশের জায়গায় আর ভেঁপু ভেঁপুর মতনই বাজতে থাকে। কেউ কিছু বলার চেষ্টাও করে না, করলে উল্টো আরও দুচারটা খারাপ কথাই শুনতে হবে ড্রাইভার হেলপারের, আর যাদের বলার কথা বা যারা বললে শুনবে, সেই পুলিশদের একটা জ্বলজ্যান্ত নিয়ন্ত্রণ কক্ষও রয়েছে একেবারে মোড়ের মুখে। যেখানে তাদেরকে নাকি প্রায়ই দেখা যায় খুব সিরিয়াস হয়ে হেলমেট ছাড়া মটরসাইকেল আরোহীদের বাইক আটকাতে। এইটাই বোধহয় তাদের উল্ল্যেখযোগ্য দায়িত্ব।

তিথি লিফট থেকে নেমে তার মায়ের ওয়ার্ডে গিয়ে নার্সকে ডেকে এনে ইঞ্জেক্শনটি দেয়ায়। বেডে শুয়ে আছে প্রায় যায় যায় করা মহিলাটি তার মা, যাকে এখন হয়তো দেখতে একটা ক্ষীণ কোনো কুশপুত্তলিকা যাকে কাপড়ে মোড়ানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তবে বছর দুই আগেও তিনি এমন ছিলেন না। পুরো সংসারের গেরস্থালি ভালো-মন্দ দেখতে দেখতে অতি ব্যস্ত থাকা তাকে সারাদিনে কোনো এক জায়গায় একটু স্থির বসে আছে দেখাটা বিরল এক দৃশ্যটিই যেন, আর এমনিতেও সে একটু খুঁতখুতে স্বভাবের হওয়ায় অন্যের কোনো কাজ তার মনপুত হোতো তো নাইই উল্টো আরও সেই নিয়ে অযথা বাক্য বিনিময়ই যেন সাড় হোতো আখেরে। তিথির কাছে যেগুলো স্রেফ বাড়াবাড়ির মনে হোতো, এবং এসব নিয়ে হামেশাই মা-মেয়েতে যে বচসা লেগেই থাকতো এবং তা যে প্রায়ই কেবল  তুচ্ছ দুয়েক কথাতেই সবসময় ক্ষ্যান্ত হোতো তা নয়, মাঝমাঝেই ব্যাপারটা আরো বড় হোতো, তখন হয়তো মায়ের মুখ থেকে বের হয়ে আসতো দু`একটা সিরিয়াস গালি, যার প্রত্তুত্তরে মেজাজ হারাতো তিথিও, হয়তো ঘটনার মূলে একটা সামান্য কোনো গামছার নেড়ে দেয়ার স্থান, কিংবা বিছানা বা বালিশটার একটু এলোমেলো থাকার মতো বিষয় আশয়গুলোই এবং এ নিয়েই খুব সদা সিরিয়াস মা, যা তিথির কাছে কোনো কথারই বিষয় না।



তিথির কাছে না হলে কী হবে, মায়ের পৃথিবীতে এসবই আসল কাজ , এবং সারাদিন যিনি এই নিয়েই আছেন। পান থেকে চুন খসলেই ছোটা-কাজের বেটিটাকে আক্কেল দিয়ে ছাড়ছেন, মাথায় তুলে ফেলছেন সব, চিল্লানিতে, মনে হবে না জানি কী না কী একটা হয়ে গেছে। তবে এর বাইরে কঠিন শ্রমসাধ্য কাজগুলোও তিনি করতেন। এই যেমন যখন গ্যাস ছিল না, তখন স`মিলের কাঠের লাকড়ি দিয়েই রান্না হতো, এবং সেসব লাকড়ির মধ্যে কিছু না কিছু থাকতোই শক্ত বেসাইজের মুথা, যেগুলোকে চৌকায় ঢুকিয়ে রান্না করার মতো উপযোগী করতে এই মা`ই একে-তাকে বলার পরেও কোনো সমাধান না পেয়ে অগত্যা নিজেই কুড়াল নিয়ে উঠানে নেমে পড়তেন। এক বেলায় ওগুলোকে সাইজ করে রোদে দিয়ে আসার পরে স্নান সেড়ে সোজা চলে যেতেন চৌকার সামনে। একা একাই বলতে বলতে, হায় হায় রে আইজ আমারে কিয়ে ধরলো, বেলা কতটা হয়া গেল, এখন পর্যন্ত চুলাই ধরাইলাম না... ব্যতিব্যস্ত হয়ে রান্না ঘরের দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় যদি তিথি তার খাওয়ার কথা বলেছে তার উত্তরে একরকম রেগেই উঠে তিরিক্ষির জবাবে, আক্কল পছন্দ কিছু রাইখ্যা কথা কইস, ছেড়ি কুলে জন্ম নিছোস একদিন না একদিনতো মা হবিই, তখন বুঝিস।

তিথি এই উত্তর পেয়ে আর কথা বাড়ায় না। জানে, কথায় শুধু কথাই বাড়বে। কাজের কাজ যা হবার তাই হবে, তার  মা তার মায়ের মতোই নিজের কাজে অটল থাকবে। লাকড়ি দিয়ে এই গরম দুপুরে আগুনের পাশে ঘামতে ঘামতে শ্যামলা মানুষটা গাল-মুখ কিছুটা লাল হয়ে যাবে। বাবা তার রান্না ছাড়া আর কারোর রান্না খেয়ে যুত পায় না,  মাঝে মধ্যে শখ করে তিথি রান্না করে দেখেছে ব্যাপারটা। মায়ের অজর আপত্তি সত্ত্বেও সে এক রকম জোর করেই রান্না করে যখন খেতে বসেছে বাবা মুখে খুব প্রশংসা করলেও পাতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে। যদিও মা এবং বাবা দুজনেই খুব শান্তিতে খেয়েছে তবে পরিমানে অন্যদিনের তুলনায় ভাত একটু কমই খরচ হয়েছে যেন, সেটা শুধু বাবারই বা কেন স্বয়ং তিথিরও, একই বাতাই মাছের চচ্চড়ি যা দিয়ে তিথি একবার ভাত বেশী নেয়। সেই একই চচ্চড়ি তার রান্নায় সে একবারের ভাতটুকুই যেন শেষ করেছে কেবল নিজে রান্না করেছে সেই মনের সুখে, স্বাদে না, এবং ঠিক এই জন্যেই হয়তো জ্বরের শরীরেও মা রান্না করে গেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিথি দেখেছে তার মা কেমন যেন ঠিক আগের মতো নেই। আগের সেই ব্যতিব্যস্ততা কোথায় যেন নাই হয়ে গেল, এবং খুব হুট করেই যেন তার চেহারাটার মতনই যা শাখা-সিদুর উঠে পড়ার পরে লেগেছে,তেমনই কোনো নতুন মানুষটিই যেন তিথি দেখে তার মায়ের মধ্যে।

বাবার মারা যাওয়ার পরে মা বেশ কিছুদিন রান্না ঘরেই গেলো না । এর বাইরে অন্যান্য কাজে যেন আরও বেশী নিষ্প্রভ, নিস্পৃহই, এবং তাকে দেখলে মনেই হয় না যে, এই মানুষটিই মাত্র মাসখানেক আগেও কুড়াল দিয়ে লাকড়ি চিড়েছে, বা উঠানে তুচ্ছ একটু অযাচিত পাতা পড়ে থাকার জন্যেও খুঁনসূটি করেছে। বাবা মরে যাবার পরে খুব দ্রুতই যেন মা তার পৃথিবী থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছেন, পড়শিদেরকেও আফসোস করে এ কথা বলতে শোনায় যে, ‘দুজনের এত মিল ছিল যে, কবুতরের জোড়া, একজন ছাড়া আরেকজন টিকে না।’ পড়শিদের এমন কথায় কান্না আসতো তিথির, মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতো লুকিয়ে, এমনিতেও মাকে খুব কমই দেখেছে খাচ্ছে, কেবল বারবার পান খাওয়া ছাড়া, কোনো জিনিস সাধলে বলতো, ‘থ, পড়ে খামু, হাতের কাজটা শেষ করি, থ তুই।’ সেই মা দিন দিন যেন একেবারেই খাওয়া ছেড়ে দিলো, হাতের কাজও ভুলে গেল। ধীরে ধীরে শরীরটাও ভেঙে পড়তে থাকলো। ডাক্তাররা প্রথম প্রথম অনেকদিন বহু টেস্ট করে বলতো, তেমন কোনো রোগ নেই, আপনার মাকে আনন্দে রাখেন, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করান, সময়মত ঘুমটা হচ্ছে না তার। অধিকাংশ ডাক্তারই এমন বলেছে, টেস্ট করিয়ে কিছু না পেয়ে সামান্য ঘুমের ওষুধ আর ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট লিখে বাসায় পাঠিয়েছে।

তবে দিন দিনই তার শরীর খুব দ্রুতই যেন চুপসে গিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছিল, এবং ইদানীং জোর করেও কিছু গেলানো যেত না। গেলালেও বমি করে সব ঢেলে দিতেন। খাবার দেখলেই মুখটা সরিয়ে অন্য দিক করে ফেলতেন। গাল-চোখ গর্তে গিয়ে চেনার উপায় নেই। দুবছর আগের মানুষটার ছায়াও যেন না এটা। তিথির বুক ফেটে কান্না আসতো। বাড়িঘরে শ্রী নেই। খোদ মা যে বিছানাটায় শুয়ে থাকে সেই ঘরটাও যেন একটা গুদাম ঘরের মতো হয়ে গেছে। টেবিলের উপরে হিজিবিজি করে পড়ে আছে না খাওয়াসহ এখন খাচ্ছে এমন অনেক ঔষধগুলো, কেমন জানি একটা চিমসে গন্ধ, নাকে আসে, তবে তা দেখার বা বলার কেউ নেই। পড়শিরা বলাবলি করে এসব। তিথিও যেন মনমরা হয়ে যায় তবে জোরে নিজেকে ধরে রাখে, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক থাকতে পারে না, তবু খুব চেষ্টা করে নিজেকে সামলায়। এর মধ্যেই মামা এসেছে খবর পেয়ে। সাথে মামাতো ভাইটিকে নিয়ে। তারা চিন্তা করেছে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে দেখাবে। মামা তার বোনটিকে দেখেই দুচোখ ভাসিয়েছে। সাথে মামাতো ভাইটির মাথাটাও কেমন নিচু করে ফেলছে। মা তাদের দিকে একটু তাকিয়েই নীরবে কিছুটা চোখের জল ফেলে দিয়ে তিথির মুখের দিকে মুখটা স্থির করেছে। তখন তিথি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে।

মামাও চোখে জল ছাড়তে ছাড়তে তিথিকে জড়িয়ে ধরেছে। মুখে কিছুই বলতে পারছিল না যেন। মাথায় হাতদুটো রেখে মামা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

দুই.
মামাতো ভাইটির সামনের সপ্তাহে ফাইনাল পরীক্ষা। অচেনা শহরের এই বিশাল হাসপাতালে তিথির পক্ষে একা এমন একজন রোগীকে দেখা অসম্ভবই। প্রায় পনের দিন ধরে তারা এখানে এসেছে। আসার পর থেকেই বহুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। মাকে দলামোচড়া হয়ে স্ট্রেচারে শুয়ে থেকে এম আর আইয়ের রুমের দিকে যখন যেতে দেখছিল তিথি তখন অঝোরে কেঁদেছে। বারান্দার মানুষের ভিড়ের মধ্যে তার চোখের জল কেউ দেখে নাই হয়তো। এখানে আসার প্রথম সাতদিন একের পর এক পরীক্ষাই শুধু চলছিল। নার্সরা যখন রক্তের স্যাম্পল নিতে শিরা খুঁজতেছিলো তখন তিথি দেখেছে তার মায়ের মাংসগুলো কেমন যেন আলগা হয়ে গেছে। নার্সরা যেন কিছুটা বিরক্তও হচ্ছিল শিরা না পেয়ে। মামা প্রায় সাতটি দিন এক কাপড়েই ঘুরছে। মামাতো ভাইটা কেবল চা-বিড়ি ছাড়া আর কিছু খায়নি। এর মধ্যে মা যেন ধীরে ধীরে তাকানোটাও ছেড়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ দু’এক সেকেন্ড তাকিয়ে কী যেন খুঁজতে চেয়ে আবার চোখ বুজে ফেলেন। মায়ের পায়ের কাছে তিথি বসে থাকেন ডাক্তার আসলে। খুব আশা নিয়ে উঠে দাঁড়ান। সৌম চেহারার দুজন ডাক্তার আজও পালাক্রমে দেখে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নার্সের সাথে কথা বলেন ফাইল দেখেন। তিথি ডাক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলতে সাহস পায় না, পাছে যদি ডাক্তার খুব খারাপ কিছুটাই, যা তার মন বলে সেটাই বলে দেয়, সেই ভয়ে সে চুপ করে তাদের মুখ দেখে।

তাদের মুখের অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় অবস্থা খুব একটা আশাপ্রদ কিছু না। তারপরও তিথি কিছু জিজ্ঞেস করে না। একবার একজন ডাক্তার তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে সে রোগীর কি হয়, তখন সে ভেবেছিল জানতে চাইবে, স্যার, মা বাঁচবে না? তবু সে কিছু বলে না।

আজ হঠাৎ করেই মায়ের খুব ব্যথা শুরু হলে বেডে ছটফট করতে থাকে সে। তখন নার্স তাকে ডেকে বলে, এই রোগীর সাথে পুরুষ মানুষ কেউ নাই। দ্রুত এই ইনজেকশনটা বাইরে থেকে আনতে হবে। এই বলেই নার্সটি একটা প্যাডের পাতা ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দেন। মামাতো ভাইটি মাত্রই অন্য একটা কাজে বাইরে গেছে, আসতে ঘণ্টা দুই দেরি হবে তার ফিরতে। মামা গতকাল বাসায় গেছেন। আগামী কালই ফিরবেন। নার্সের কথামতো ইঞ্জেকশনটি দ্রুত আনতে তাই সে নিজেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে এটি এনেছে। নার্সকে ডেকে এনে এটি পুশ করানোর সময় ডাক্তারকে পাশে পেয়ে সে বলে ফেলে, স্যার মায়ের কী হয়েছে? ডাক্তারটি মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল তার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই , তিথি তার পেছন পেছন যেতে থাকে , স্যার... প্লিজ বলুন মা`র কী হয়েছে!

ডাক্তার জানতে চায়, রোগীর সাথে আর কে কে আছে?
তিথি বলে, আর কেউ নেই, আমাকেই বলুন।
ডাক্তারটি অগত্যা তাকেই বলে, দেখুন অনেক দেরি করে ফেলেছেন। এখন আসলে সত্যি বলতে এই কন্ডিশনে আমাদের হাতে আর তেমন কিছু করার নেই। আমি দুঃখিত আমাকে এটাই বলতে হলো বলে। আসলে আমরা কেন পৃথিবীর কোথাও গেলেও আর কিছু করার নেই। ভেঙে পড়বেন না, রিয়্যালিটি ইউ নো, বরং ভালো হয় তাকে বাসায় নিয়ে যান, আপনজনদের সাথেই কাটুক তার সময়।

এর মধ্যেই ডাক্তারটির সেলফোনে রিং বেজে উঠলে সে ফোনটি রিসিভ করে হাঁটা শুরু করে। তিথি আর ডাক্তারের পিছনে যায় না। মায়ের বেডের দিকেও না, খোঁড়ানো পা`টাতে সে কোনো ব্যথাও অনুভব করে না যেন, জোরে হেঁটে পাচঁ তলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এই জায়গাটায় এসে গাছের তলায় বসে থাকে। এতক্ষনে রাত একটু ভিন্ন  শব্দই করছে যেন। প্রায় শেষের দিকে বলেই খুচরা শব্দগুলোও বেশ গাঢ় মনে হচ্ছে, দূরে একটা কুকুর ভ্যাবাচ্ছে, মাত্রই হয়তো কোনো শিশুর জন্ম হলো যার কান্নার শব্দ আসছে। কাছেই কোথাও হয়তো হাসোনাহেনার গাছ আছে, গন্ধ আসছে, মা`র কথাটি মনে আনতে চায় না আর তিথি।

সে বসে আছে, কাল হয়তো মামা আসবে, মামাতো ভাইটি হয়তো কোথাও বিড়ি ফুঁকছে এখন, সেও হয়তো এতক্ষণে মায়ের বেডের পাশে দু`একবার বসে ফোনে তার প্রেমিকার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। ঘণ্টাখানেক পরেই সূর্য উঠবে। ডাক্তার তিথিকে বলেছে মা`কে বাসায় নিয়ে যেতে।