পাপিয়া জেরীনের গপ্পো সপ্পো

পর্ব ৮

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০১৯

নাজিমউদ্দীন আহমেদ তার ছেলের কানে আজান দিয়া নামকরণ করছিলেন `চাঁন`, আখ্তারউজ্জামান চাঁন মিঞা। নাম শুইনাই বুঝতে পারার কথা তার সৌন্দর্য কেমন ছিল। মুন্সীগঞ্জ সদরে তার মতো সুপুরুষ নাকি কেউ এখনো জন্মায় নাই। তিনি ছিলেন আমার নানা। তার প্রথম কর্মস্থলে ডেপুটি কালেক্টর সাহেব নাকি বাসায় দাওয়াত দিয়া একমাত্র মেয়ের সাথে বিয়ার প্রস্তাব দিছিলেন। আমার নানাভাই বৃদ্ধ বয়সেও সেই কালেক্টর-কন্যার রূপের বর্ণনা দিতেন।

আমরা জিজ্ঞাস করতাম, ‘নানাভাই, সেই মেয়ে কি আমাদের নানুমণির চাইতেও সুন্দর!’ কারণ আমরা জানতাম যে, নানুমণির চাইতে সুন্দর কেউ হইতেই পারে না।

নানাভাই এদিকওদিক তাকায়া সংকোচ নিয়া বলতেন, ‘অপরূপ সুন্দরী!’ অথচ, তিনি সেই কালেক্টর-কন্যারে কখনও দেখেন নাই, দেখছেন তার পা দুইটা। আমরা হাসতে হাসতে মরতাম। পা দেইখা কি রূপ ঠাহর করা যায়? আমাদের হাসিতে নানাভাই প্রতিবার বিব্রত হইতেন। কারণ আমরা এরপর নানুমণির কাছে গিয়া বিচার দিতাম... নানুমণি, নানাভাই আবারও বলতেছে, ওই মেয়েটা নাকি তোমার চাইতেও সুন্দর।

নানুমণিও রাগ কইরা মাছ ভাজার চটি নিয়া (মারতে আসতেন না, রান্নার সময়ে আরকি) তাইড়া আসতেন, ও! বুড়া বয়সে আবার সেইসব মনে পড়ছে? কাম তো নাই? বইসা বইসা আজাইরা প্যাচাল। যাও, বাজারে যাও। লবণ নিয়া আসো।
সকালেই তো লবণ আনলাম।
তাতে কী হইছে? আবার আনবা।

আমার নানা যেইদিন কালেক্টর-কন্যার আলাপ দিতো, সেইদিনই উনার বাজারে যাইতে হইতো পঞ্চাশবার, শাস্তিস্বরূপ। দুইটা জিনিস ঘুইরা ফিরা আনতে হইতো, লবণ আর মরিচ। আমার নানাভাই সেই বিয়া প্রায় কইরাই ফেলছিলেন, শুধু তার বাপ নাজিমউদ্দীন আহমেদের অনুমতির অপেক্ষা। চিঠিমারফত সব জানতে পাইরা আমার বড় আব্বা নাজিমউদ্দীন টেলিগ্রাম করলেন, ফাদার সিক্। কাম হোম।

আর আমার নানাভাই আইসা দেখলেন, কীসের বিমারী! বাড়িতে মহিলারা বইসা বিয়ার গীত গাইতেছে হলদি-মেন্দি বাটতে বাটতে। সব বুইঝা যখন তিনি বাড়ি থিকা পালায়ে যাবেন, তখন তারে ঘরবন্দি করা হইলো। আমার নানাভাইয়ের মা জানাইলেন তার ছেলেরে, বিক্রমপুরের ঘাসবুকের ফজলে আলী খাঁর প্রথম কন্যার সাথে বিয়া ঠিক হইছে তার। রূপে-গুণে-শিক্ষায় এমন মেয়ে এই তল্লাটে নাই। মেয়ের নাম আয়শা আক্তার ভানু।

আমার নানাভাই কোনোমতেই রাজি না। কারণ তিনি কথা দিয়া আসছেন অন্যখানে। এই দিকে বর্ষাকালে থৈথৈ পানিতে বজরা প্রস্তুত। ফজলে আলী খাঁ সাহেব তার প্রথম মেয়ের বিয়াতে ধলেশ্বরীর খালের দুইপাশে লালসালু বান্ধছেন। এই বিয়াতে যৌতুক নাই, কিন্তু মেয়ের নিজেরই আছে একশো ভরি সোনা আর অঢেল সবুজ জমি। আমার নানা বইসা আছেন, সামনে কাজীসাহেব। কিছুতেই সে কবুল বলে না। শেষে বিয়া ভাঙ্গার জন্য একটা সোনার কলম আর বিশ হাজার নগদ দাবি কইরা বসলেন। এই কথা শুইনা নাজিমউদ্দীন সাহেবের মাথা নিচা হইলো। কারণ তিনি তার ছেলের বিয়াতে যৌতুক নেবেন না।

অনেক ঝামেলার পর, আমার নানুমণির বাপ সোনার কলম আর নগদ টাকা নিয়া উপস্থিত হইলেন। বিয়া হইলো। বিয়ার রাতে আমার নানুমণিরে দেইখা নানাভাইয়ের মাথা খারাপের মতো দশা। সারা জীবনই এই দশা বহাল ছিল (বিশেষ কয়েকটা কালেক্টর-কন্যা দিবস ছাড়া)।

আমার নানাভাই নব্বই বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর আগেও উনার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। উনি মাঝে মাঝে কালেক্টর-কন্যার কথা বলতেন, আমরাও প্রতিবার আগ্রহ নিয়া সেই গল্প শুনতাম। ছাইরঙা পর্দার আড়ালে মেয়েটা, নিচ দিয়া একজোড়া পা, আঙুলগুলি শরমে গুটানো, বকুল ফুলের মতো। পর্দাটা দুইলা উঠতেছে।

আমরা কখনোই বিশ্বাস করতাম না, যে উনি মেয়েটার কেবল পা দুইটা দেখছেন। আমরা খোঁচাইতাম, বলো না নানাভাই! সত্যি কইরা বলো, নিশ্চয়ই তোমরা দেখা করছিলা, বা অন্তত মুখটাতো দেখছো। আমার নানাভাই প্রতিবারই জবাবে বলতেন, `না`। মৃত্যুর আগদিয়া উনি নাজিম মঞ্জিলের একতলার কাচারিঘরে থাকতেন। কারণ সিঁড়ি দিয়া উপরে ওঠানামার শক্তি ছিল না তার। আমি আর আম্মা থাকতাম তার পাশের পূর্বদিকের রুমে। ছোটমামা দক্ষিণ দিকের রুমে। উনি সবাইরে নাম ধইরা ডাইকা খাটে বসাইয়া নানান আলাপ করতেন। সবার নাম তার জানা। মুখস্ত। মাঝে মাঝে তিনি একটা নাম ধইরা ডাকতেন, ‘বকুল`। তখনও আমাদের বাড়িতে বকুল নামের কেউ নাই।

আমরা উনারে বলতাম, নানাভাই! বকুল বইলা কারে ডাকো? বকুল নামে তো কেউ নাই!
নানাভাই তার অবশিষ্ট দুইটা দাঁত বাইর কইরা বিব্রত একটা হাসি দিতেন। সেই হাসিতে যে কেউ বুঝবে, `বকুল` নামের বালিকাটা কে!