প্রলয় মুখার্জির গল্প ‘নবকুমার’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৩, ২০২১

নবকুমার যে পথে আসে তার দুই ধারে বাঁশবন। মাইলের পর মাইল বাঁশবন পেরিয়ে স্কুলে আসে। এই তিন কিলোমিটার পথ তার আপনজন। এখানে আকাশ মেঘলা হলে গোটা বাঁশবনের দৃশ্যপট বদলে যায়। ঘাসের রঙ হয় পতঙ্গের চেয়ে সবুজ। পতঙ্গের আনন্দ হয় ঘাসের চেয়ে আলো। এবং সে দেখছে তাই। ওই আকাশের দিকটা ক্রমশ ধূসর হলে স্তিমিত হয় বনের কলতান।

হালকা ঝড়ের আগে কাঠবেড়ালি অস্থির যাতায়াত করে ডালে। ওই কালো ডালের দিকে চেয়ে নবকুমার কিছু কি ভাবে? তিনমাইল জুড়ে বাঁশবনের উপলব্ধির বাইরে নবকুমারের কিছু ভাবা উচিত? না। ঘণ্টা বাজানোর লোক নবকুমার। চেয়ার সাজানোর কর্মী নবকুমার। জীবনে এত ত্রুটি, বিয়োগের জের এই তিনমাইল জুড়ে না আসুক। কেউ না বলুক নবদা টেবিলগুলো সাজান। জিলিপি আনুন। গ্রন্থাগারের ধূলা, ঝুল ঝাড়ুন।

জীবনের এত অর্ডারের মাঝে নবকুমার ভালবাসে ছুটির ঘণ্টা বাজাতে। সে সাতাশ বছর ধরে শ্রেণিকক্ষের হৃদয়ে ছুটি বাজায়। ছুটির ধ্বনি বাতাসে ছড়ালে সমস্ত শিশুর মনে বর্ষার মাঠ, বিকেলের খেত মুক্তি পায়। মুক্তির কলরবে নবকুমার ডুব দেয়। ঝিনুকের পেটে যেটুকু রশ্মি চুঁইয়ে পড়ার কথা, সে তার চেয়েও অন্ধকারে নিজেকে খোলে। ভিতরের মাংসে মৃদু বাতাস দোলা দেয়। এই বাঁশবন নবকুমারের স্বজন। তিনমাইল তাকে বিদ্রুপ করার কেউ নেই। জখম লেলিয়ে দেয়ার লোক নেই। ছায়ার মতো শান্ত বেজির পিছু নেয় হাওয়ার কলেবর। এখানে বৈষম্য নেই। ছায়াখানি বাতাসে টুম্বুর, নবকুমার ওই সবেদার ভিতর চুপচাপ পোকা। কার্য নেই, কারণ নেই। বসে বসেই নিদ্রা আসছে। ক্ষুধা আসছে। যৌনতা আসছে।

মুক্ত পুরুষ সে। পকেট থেকে বের করে মদ, ব্যাগ থেকে বের করে জল, সবেদার টুকরো, নাটকের খাতা। এই একাঙ্ক নাটকের রচনা সে দীর্ঘদিন করছে। ব্যক্তিগত শোকের নয়। না পাওয়ার নয়। অতিথি নবকুমার পরিত্যক্ত বাঁশবনে হারিয়ে যেতে যেতে এসে পড়ে প্রকাণ্ড ঝড়ে। দূরের গ্রাম থেকে ঘরের চাল হারানোর চিৎকার ভেসে আসে যখন নবকুমার রচনা করে একাঙ্ক নাটক।

বাইরের জীবনে তার স্পৃহা নেই। কষ্টও নেই। বোধহয় নবকুমারের জীবনে বিস্তৃত তিনমাইল বাঁশবন। এই সীমানা তার ওই গুগলির ব্যবহার, শান্ত স্থিত জলে খোলোস উন্মুক্ত করার স্থান। অন্তরের মাংসে লেগে যাক ও মৃদু জীবনের তরঙ্গ। এই আনন্দে নব কাটিয়ে দিক বাকি শয্যা। সমস্ত নির্দেশ দেহ থেকে ঝেড়ে রচনা করুক নিজস্ব নাটক।

নবকুমার নিজেকে এই কথা বলে স্কুল থেকে ঘরে ফিরল। তখনো ঘরের দেয়ালে কিছু শৈবাল। কিছু ভাঙা ইট। কাঠের গোঁজে যেমন পাঞ্জাবি ঝোলে। খড়খড়ি জানালায় যেমন চড়ুই। পুরানো মহল্লায় বাতাস গোছানো থাকে, তা ছিলই। শুধু বিছানার ওপর গোটানো একটা কাগজ, কেউ জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। নবকুমার কাগজ খুলে দেখল আদালতের নোটিশ। চৌত্রিশ বছরের পুরানো মামলা হেরেছে। বাড়ির যে অর্ধেকটায় নবকুমার থাকত, একমাসের মধ্যে খালি করতে হবে। সে দেখল বাইরে থেকে কেউ তার প্রতিক্রিয়া শুনতে চাইছে। যেন নবকুমার কান্নায় ভেঙে পড়বে, হাতে পায়ে ধরে বলবে, ওগো আমার সব শেষ।

দোমড়ানো মোচড়ানো দেহ দেখতে দেখতে প্রতিবেশী মাথায় হাত বোলাবে। বাতাসা মুড়ি দেবে। এই সুযোগ নবকুমার কাউকে দিল না। সে নোটিশটি বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে গান ধরল। প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে। এই প্রতিক্রিয়া রজনী চক্রবর্তীকে খুশি করতে পারেনি। রজনী, যার একশো বিঘা জমি, তিনটে হোটেল, লবঙ্গের রপ্তানি, বিদেশে একমাত্র কন্যা, চাইবেই নবকুমারের গরীব প্রাসাদ ভেঙে যাক। সরীসৃপের মতো চলুক। ঘাড় গুঁজে প্রার্থনা করুক ভিক্ষার স্থান। রজনী চক্রবর্তী কৃপা যে করবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল।

একখানা ঘর নবকুমার যে ছুঁড়ে মারবে। তার বিহ্বল দশা দেখার সুযোগ হারাবে রজনী, তা টের পায়নি। গোঙানির বদলে নবকুমারের এ গান চাবুকের মতো পিঠে পড়ছে। তখন রাত। বাইরে জোনাকির মেলা। জোনাকির ভারে বাতাস নুইয়ে পড়েছে। দরাজ গলায় নবকুমার মুক্তি দিচ্ছে মোকোদ্দমায় হারানো প্লাবন। উচ্চরক্তচাপের দিনগুলি। ক্রমশ নিজের প্রাসাদ থেকে রজনী চক্রবর্তীদের তাড়াচ্ছে। গুনগুন করে গান করছে। এই মাত্র নব মাংস আনবে। মাংসের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে রজনী চক্রবর্তীর পাঁচিল ভেঙে পুরানো প্রাসাদে। রজনী  কি লবঙ্গের কুঁড়ি ভেঙে বলতে পারবে এ আস্ফলন তার ভিতরের নয়?

নব মাংস বসিয়ে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে। দেয়ালে স্ত্রী নমিতা মণ্ডলের ছবি নেই। ছবি নেই দেবতার। তাই ভিক্ষা নেই। প্রার্থনা নেই। নব ঘরের দেয়ালে কোনো মৃত মানুষের ছবি রাখে না। মহাপুরুষের ছবি নেই। দেয়াল জুড়ে নাটকের খসড়া সাজিয়ে রেখেছে। ভাল লাগে তার। দেয়াল জুড়ে পিন দিয়ে আঁটা তার একাঙ্ক নাটক। এই নাটকের চরিত্র কেউ নেই। ধরা যাক দক্ষিনের দেয়াল। কৃষ্ণচূড়ার সাথে নবকুমারের ভাব বিনিময়। এক তরুণ প্রজাপতি দেখে নবকুমারের উচ্ছ্বাস। এই তার সংলাপ। সুড়কির দেয়ালে সাজানো। মামলার কারণে এখনো ওর ঘরে বিদ্যুৎ ঢোকেনি। ঢোকার মুখে যে পাঁচিল, পরিচর্যার অভাবে মাধবীলতার বন। সেখানে পেঁচা ডাকে।

গভীর রাতে কতবার নব কুকুরমণ্ডল দেখতে দেখতে পেঁচার ডাক শুনেছে। বিড়ি ধরাতে যে আলো, তার আভাসে দেখেছে অমলতাস ফুলে ঝুলছে শ্যাম বর্ণ অন্তঃসত্তা মথ। আজ আরো একবার এই বাড়ির পাঁচিলে হাত বোলাবে। ক্ষয়িষ্ণু ইটে কোন মাঠের মাটি তা আন্দাজ করবে। এক এক করে খুলে নেবে নাটকের পাতা। ওর মনে কোনো ভাবাবেগ নেই। সে একাঙ্ক নাটকটি খুলে পড়ল। এক জায়গায় কাঠ কেটে কাঠবেড়ালি লিখল।

এখন মাংস কষছে। এখন গান গাইছে। দুয়ারে তিনটি কুকুর। ওরা আর নব খাবে। লবঙ্গের গন্ধ, আ্যলাচের সুবাস নবকুমারের ভাঙা জানলা টপকে রজনীর বাড়ি গিয়ে পড়ল। গভীর রাতে নব ঘুমালো।

ও জানে, পরের দিন সবাই ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকবে। সে ভেঙে না পড়লেও নব কি কি হারাল তার তালিকা প্রস্তুত করবে। তারা ভীষণ ভাবে চায় নব ভেঙে পড়ুক। এই তো দেখে এসেছে আজীবন। মামলায় হেরে আত্মহত্যা। চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা। যেন কারোর জীবনে তিনমাইল বাঁশবন আসে না। শীতল ছায়ার পাশে পাকা সবেদা পড়ে থাকে না। কীর্তনের অংশে প্রদীপের ভগ্ন শিখা চকচক করে না। এই তো নবকুমারের চারিপাশ।

আর দুচোখে তাদের কেবল হারানোর ব্যথা। ঐশ্বর্য নেই, একশ বিঘা জমি আছে, প্রফেসরের মাহিনা আছে, এই তো অগাধ। কেন নবকুমার এই হারানোর ফাঁদে পড়ছে না। কৃত্রিম শোকের ছায়া, যা দ্বারা নির্মিত ওর প্রতিবেশী, বলবেই এই পুরানো বাড়ি ছাড়া নবকুমারের আছে কি?। স্ত্রী মারা গেছে। ঘন্টা বাজানোর চাকরি শেষ হবে। নবকুমারের কষ্টের কথা ভাবে ওরা। ওরা তুলনামূলক দু’এক বিঘা জমি আর সরকারি চাকরির মালিক। নিজেদের গয়না রাখে যত্নে। রবিবার মাছভাজা খাবে এই তো তাদের সমগ্র আনন্দ। আনন্দে নেই প্রজাপতির পুত্তলি। ভ্রমণের কুয়াশা নেই। দেহের বৃদ্ধি ক্রমশ স্তিমিত হওয়ার আগে কদমের ছায়ায় অন্তিম পরিণতি ফেলে আসার অভিপ্রায় নেই।

রজনী দিবস হারানোর, শোকের, প্রাপ্তির সংশয়। খালি সংশয়।আনন্দের ধারণা ক্ষুদ্র হতে হতে এই সিদ্ধান্তে এসেছে, নিশ্চই নবকুমার মামলা হেরে বাকি জীবনের উপাচার ত্যাগ করবে। অতটুকু স্থানের শোকে আস্ত দেহটিকে ছুঁড়ে ফেলবে। পরস্পর বলাবলি করছে নবকুমারের আত্মহত্যা নিয়ে। বোধহয় আজ রাতেই চক্রবর্তীর কাছে ভিক্ষা চাইবে এইটুকু স্থান।

রজনীর প্রাপ্তি তবু ঘটল না। মামলা জেতার পর বাড়ির অংশটুকু আদায় তো হলো। কিন্তু যে প্রাসাদটি নবকুমারের বুকের ওই অংশে, তার নির্জনতা ভেদ করবে কার সাধ্যি। বিমর্ষ হয়ে রইল রজনী। নবকুমারের মুখে প্রাঞ্জল আনন্দের কারণ হেতু সে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। প্রতিবেশী হিমাদ্রি প্রতিদিন নবকুমারের উত্তরণ, সূর্যস্নান, নাটকের খসড়া, ছাগল প্রতিপালন, মহিষের স্নান ব্যাখ্যা করায় রজনী চক্রবর্তী বৃহৎ অট্টালিকা নিয়ে রোগশয্যায় পড়ল। সেরেও উঠল দ্রুত। এখন সে সুস্থ হতে চলেছে কিন্তু বাঁ পা খোঁড়া। পক্ষাঘাত সামান্যই তবু মৃত্যুর ভয় চেপে ধরেছে। হাতে হিরার আঙটি ঘুরিয়ে  রজনী আজ দেখছে না। সে পালিয়েছে। ওই দূরেই নবকুমারের ভাড়া ঘর। মাটির দেয়াল তার। গোবর জল দিয়ে নিকানো। দেয়ালে আল্পনা দিচ্ছে নবকুমার। গান ধরেছে। উঠোনে হাস্নুহেনার ঝোপ। রজনী জানালা তাই বন্ধ করেছে।

একাঙ্ক নাটকের পাঠ জানালা দিয়ে ঢুকে না পড়ে। হাস্নুহেনার ঘ্রাণ ঢুকে না পড়ে তার রোগ শয্যায়। তার গোলমরিচের পাতায় হুতুম পেঁচার ডাক আবছা। নবকুমার  আজও মাংস কষবে। লবঙ্গের কৌটো খুঁজে পাচ্ছে না।