বিশ্বজয়ী হও

পর্ব ৪

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ২৬, ২০২০

বন্ধুরা, জীবনের কিছুটা সময় অধ্যবসায়ে ডুবে থেকে যদি সারাজীবন সব পাওয়া যায়, তবে অ্যাডমিশনের স্টুডেন্টরা, চাকরি প্রার্থী ছেলেমেয়েরা কিংবা সদ্য আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত তারুণ বন্ধুরা সব ছেড়ে থাকবে না কেন? জগতের সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দ, আমাদের জন্যই সৃষ্টি, তবে তা ভোগ করার উপযুক্ত সময় আছে। যুদ্ধক্ষেত্রটা যুদ্ধ করার স্থান, বিয়ে করার ছাদনাতলা নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে হাতে বন্দুক থাকে, কারো হাতে পড়িয়ে দেবার জন্য আংটি নয়। শিক্ষাজীবনটা, নতুন উদ্যমে কোনো কাজ শুরুর জীবনটা, নিবেদিতপ্রাণ হবার জন্য, নিষ্ঠাবান হবার জন্য।

জীবনের কয়েকটি বছর তোমার লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকো। মানুষের মতো মানষ হও। অসাধ্যকে সাধন করো। তুমি সব পাবে। সুন্দর জীবনসঙ্গী, দামি গাড়ি, বিরাট বাড়ি, সুস্বাদু খাবার, স্টাইলিশ পোশাক, সমাজিক মানসম্মান, সব তোমার জন্য। সব তুমি পাবে। বাস্তবেই পাবে। তবে যদি অধ্যবসায়ী হয়ে মানুষের মতো মানুষ হও তবে পাবে, অন্যথা নয়।

স্বামীজির ভাষায় বলতে হয়, ‘সাফল্য লাভ করতে হলে প্রবল অধ্যবসায়, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি থাকা চাই। অধ্যবসায়শীল সাধক বলেন, ‘আমি গণ্ডুষে সমুদ্র পান করব। আমার ইচ্ছামাত্রে পর্বত চূর্ণ হয়ে যাবে। এইরূপ তেজ, এইরূপ সঙ্কল্প আশ্রয় করে খুব দৃঢ়ভাবে সাধক করো। নিশ্চয়ই লক্ষ্যে উপনীত হবে।’

স্বপ্ন দেখে সময় পার করলে বাস্তব গড়বে কীভাবে? জীবনটা স্বপ্ন দেখে অতিবাহিত করার জন্য নয়, স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করবার জন্য। এ পি জে আব্দুল কালামের ভাষায় বলতে হয়,‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে। স্বপ্ন সেটাই, যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’

প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে ওঠো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে (স্ব-স্ব ধর্ম ও মত অনুসারে) প্রার্থনায় বসো। প্রার্থনা দ্বারা দেহমন পবিত্র হলে শান্ত মনে নিজের অধ্যবসায়ে ডুব দাও। ততক্ষণ পড়বে, অথবা ততক্ষণ তোমার অভীষ্ট কাজটি করতে থাকবে, যতক্ষণ অন্যকোনো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোমার সামনে না আসে। দ্রুত সব পড়াও যায় না। দ্রুত সব কাজ করাও যায় না।

নিয়মিত অভ্যাসে মনের অজান্তেই সব কঠিন বিষয় সহজ হয়ে যায়, শেষ হয়ে যায়। কঠিন থেকে কঠিনতম কাজ, নিজের বাধ্যগত, নিজের অধীন হয়ে যায়। তোমার কর্তব্য পড়া, তোমার কর্তব্য নিষ্ঠা, তোমার কর্তব্য নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলা, বাকি যা, তা এমনিতেই হবে। প্রতিদিন কত ঘণ্টা পড়বে বা কত ঘণ্টা অনুশীলন করবে অথবা কতঘণ্টা তোমার আকাঙ্ক্ষিত কাজটি করবে, তার টার্গেট ঠিক করে নাও। প্রতিদিনের পড়ার বা কাজের একটা হিসাব রাখো। লক্ষ্য পূরণের কাজে কোনোদিন একঘণ্টা সময় কম পেলে, পরের দিন এক ঘণ্টা বেশি দিয়ে ওই ঘাটতি পূরণ করে নাও।

একটি বিষয় অনেকক্ষণ না পড়ে, একটি কাজ দীর্ঘক্ষণ না করে, অল্প অল্প করে অনুশীলন করো। যাতে একঘেয়েমি তোমাকে পেয়ে না বসে। বিষণ্ণতার কাছে তুমি হেরে না যাও। গতানুগতিকতার চক্র তোমাকে আবদ্ধ করে না ফেলে। সবসময়ই দেখা যায়, তাত্ত্বিক থেকে ব্যবহারিক কাজে সফলতা বেশি পাওয়া যায়। যেমন আজীবন কীভাবে গাড়ি চালাতে হয় সে বই পড়লেও গাড়ি চালানো শিখতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত দিচ্ছ, যতক্ষণ না তুমি গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছ, যতক্ষণ না তোমার কমান্ডে গাড়ির চাকা ঘুরছে, ততক্ষণ তুমি একবিন্দুও এগোতে পারবে না।

সেজন্য তোমরা যারা শিক্ষার্থী তারা পড়ার থেকে লেখো বেশি; কারণ, লিখলে মনে থাকে ভাল। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়ে পূর্বের পড়া অনুশীলন করবে। সময় নষ্ট না করলে তুমি সফল হবেই। বিশ্বাস রাখ, আবার বলছি, তুমি সফল হবেই। যারা অন্য কোনো কাজে আত্মনিয়োগ করেছো, তাদেরকেও হাতেকলমে শেখার কাজে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসা শুরু করলে নিজে প্রথমে কর্মী হয়ে ওঠো, পড়ে মালিক হয়ো। নিজে হাতে সব কাজ শিখে নাও, নিজের কাজ নিজে করতে দক্ষ হয়ে ওঠো, পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বনির্ভর হয়ে ওঠো। তাহলে কেউ তোমাকে বিপদে ফেলতে পারবে না। কেউ তোমাকে ব্লাকমেইল করতে পারবে না।

চাকরি পেতে চাইলে একজন পিওনের চাকরিকেও ছোট মনে করো না। পৃথিবীতে কোনো কাজই ছোট নয়। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়েই পরবর্তী ধাপে যেতে হয়। মানুষ ছোট থেকেই বড় হয়। ছোট কাজ করা অগৌরবের নয়, কাজ না করে বেকার বসে থাকা বরং অগৌরবের। সেটাই বরং লজ্জার। মোবাইলে একজনের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলা, মেয়ে হয়ে ছেলে অথবা ছেলে হয়ে মেয়ে চিন্তা করা, এসব বোকামি, এসব ছাড়ো। মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনা মনের মধ্যে রেখো না। উন্নত উন্নত চিন্তা করতে থাক, মহৎ হবার চেষ্টা করতে থাক, জীবনকে গণ্ডীবদ্ধ করে রেখো না। ভেবো না তুমি রক্ত মাংসের একটি প্রাণি। ভাব তুমি ঈশ্বরের অংশ, বিশ্বাস কর ঈশ্বরের শক্তি তোমার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।

নিজের এই জড় দেহটাকে তুমি মনে করো না। তোমার আত্মাকে তুমি মনে কর। জান তুমি এক অমিত জ্ঞানের সমুদ্র। তুমি স্থির হয়ে আছ। ইচ্ছাশক্তির ঝড় তোমার হৃদয়ে উঠলেই তুমি প্রলয়ংকরী প্রতিভা হয়ে উঠবে। তুমি নিজেও জান না, তোমার ভিতরে কত শক্তি আছে। পৃথিবীতে যা কিছু আবিষ্কার হয়েছে সব মানুষের মস্তিষ্ক থেকেই হয়েছে, সব ইচ্ছাশক্তির জোরেই হয়েছে।

তুমি নিজেকে পশু নয় দেবতা ভাব; পাপী নয়, পূন্যবান ভাব; অপরাধী নয়, মহৎ ভাব। ‘খারাপ কাজ করেছ বলে নিজে হীনমন্যতায় ভুগ না। চিন্তা করে দেখ, তুমি তো অনেক ভাল কাজও করেছ। খারাপ কাজের জন্য যদি তুমি দোষী হও, অসাধু হও, ভাল কাজের জন্য কেন সাধু হবে না?’ মনে রেখ, হীনমন্যতা শুধু তোমার কাজকেই থামিয়ে দেবে না। তোমাকে ধ্বংসও করে ফেলবে।

স্বামীজি বলতেন, ‘মুক্ত হও; অপর কারও নিকট কিছু আশা করো না। আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, তোমরা যদি তোমাদের জীবনের অতীত ঘটনা স্মরণ কর, তবে দেখবে, তোমরা সর্বদাই অন্যের কাছে সাহায্য পাবার বৃথা চেষ্টা করেছ, কখনও সাহায্য পাওনি; যেটুকু সাহায্য পেয়েছ, সব নিজের ভিতর থেকে। যে-কাজে তুমি নিজে চেষ্টা করেছ, তারই ফল পেয়েছ।’

জেন যে, হীনমন্যতা হলো মানব মনের ঘুনপোকা। তাই এখনই নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে দূর করে দাও। নিজের অপরাধ, পরাজয়, গ্লানির দৃশ্যগুলোকে মন থেকে মুছে ফেলে দাও। সত্য-সুন্দর-পূণ্যের কথা স্মরণ কর। ভাল হও, ভাল কিছু করে দেখাও। আমি জানি তুমি পারবেই। তুমিও বিশ্বাস করো তুমি পারবে।

নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলার দায়িত্ব তোমারই। প্রতিদিন যোগব্যায়াম, খেলাধুলা বা নির্দিষ্ট একটা সময়ে— তা সকাল হোক বা বিকালে হাঁটা অনুশীলন করো। যোগব্যায়াম, খেলাধুলা করলে বা প্রতিদিন সময় করে হাঁটলে, সম্ভব হলে সাঁতার কাটলে, তোমাদের দেহ ও মন সুস্থ হবে।

এই দেহ ও মন সুস্থ রাখার জন্য শুধু ব্যায়াম নয়, তার পাশাপাশি সুষম আহারও প্রয়োজন। সব সময় ফাস্ট ফুড বা দামি খাবার নয়, বরং শাক-সবজি, ডাল, দুধ, ডিম, ছোট মাছের মতো অল্পদামি পুষ্টিকর লঘুপাক খাবার খাও। আরো সুন্দর করে বলতে গেলে বলতে হয়, ‘যা আয়ু, উৎসাহ, বল ও স্বাস্থ্যের উন্নতি বিধান করে এবং আনন্দ ও সুখ বাড়ায়, সরস ও স্নিগ্ধ, যার ফল বহুকাল দেহে থাকে, যা আহারে আনন্দ হয়, তাই উত্তম রুচি, উন্নত বুদ্ধি ও প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির প্রিয়।’

"অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণ, অতি গরম, অতি ঝাল, অতি তিক্ষ্ণ এই সকল খাদ্য মধ্যম শ্রেণীর ভোগবিলাসে মত্ত ব্যক্তির প্রিয়। এগুলো থেকে তারা দুঃখ, শোক ও ব্যাধিগ্রস্থ হয়।’‘

"যে সকল খাদ্য বহু আগে তৈরি করা আছে, রস যার শুকিয়া গিয়াছে, বাসি দুর্গন্ধযুক্ত উচ্ছিষ্ট (কাহারও এঁটো) তা নিম্ন জ্ঞানসম্পন্ন, অধম ব্যক্তির প্রিয়।"

এ থেকে সহজেই প্রণিধানযোগ্য, সদ্ বা ভাল গুণের অধিকারী, উত্তম ব্যক্তির প্রিয় খাবারগুলোই তোমাদের গ্রহণ করা উচিত। এতে তোমরা সুস্থ, সবল ও মেধাদীপ্ত হয়ে উঠবে। তোমরা সর্বদা শক্তি ধারণ কর। স্ব স্ব ধর্মীয় অনুশীলন মেনে পবিত্র জীবনযাপন কর। পবিত্রতা বজায় রাখ। পবিত্র চিন্তা কর। সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস রাখ। নিজের উপর বিশ্বাস রাখ। তুমি অবশ্যই জয়ী হবে।

তোমার নিজের কল্যাণ তোমার থেকে ভাল আর কে করতে পারে? তুমি ভাল হলে তোমার পরিবার ভাল হবে, তোমার সমাজ ভাল হবে, তোমার দেশ ভাল হবে। একটি দেশকে পৃথিবীর বুকে সম্মানজনক স্থানে পৌঁছে দিতে একজন আইনস্টইন, একজন ম্যারাডোনাই যথেষ্ট।

তুমি বিশ্বাস কর এ যাবৎ যত বিজ্ঞানী, যত মহামানব পৃথিবীতে এসেছেন, একজন মানুষ হিসেবে তুমি তাদের কারো থেকে ছোট নও। বিশ্বাস করো, অধ্যবসায়ী হলে তুমি সবাইকে ছাড়িয়ে যাব, সবার থেকে মহৎ হবে। তাহলেই তুমি বড় হবে। তাহলেই তুমি মহৎ হবে।

বিশ্বাস রাখো নিজের উপর। বিশ্বাস রাখো এগিয়ে যাবার। বিশ্বাস রাখো পৃথিবীকে সুন্দর করার, পৃথিবীতে শান্তি আনার, পৃথিবীতে সমতা আনার ক্ষমতা তোমার মধ্যেও আছে। নিজের উপর প্রবল বিশ্বাসই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

জন স্টুয়ার্ট মিল বলতেন, ‘যার বিশ্বাস আছে, সে একাই নিরানব্বই মানুষের সমান।’ তুমিও বিশ্বাস কর, তোমরা কারণে গোটা পৃথিবীর সব হানাহানি, সব অশান্তি, সব দুঃখ-দারিদ্র্য, সব অন্ধ কুসংস্কার, সব ঘৃণা-হিংসা দূর হয়ে যেতে পারে। যদি তোমার মতো সবাই ভাবে আমি মানুষ হব, তাহলে পৃথিবীটা স্বর্গ হতে এক মুহূর্তকাল সময়ের প্রয়োজন। চলবে