বিশ্বজয়ী হও

শেষ পর্ব

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০২০

পৃথিবীতে যত মানুষ বিখ্যাত হয়েছেন, তারা কোনো না কোনো কারণে তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণেই হয়েছেন। তারা চলমান কর্মপদ্ধতিকে নতুন উদ্ভাবনী দ্বারা আরও সুন্দর, গতিশীল, সহজ, কস্ট ইফেকটিভ ও টাইম রিডিউসিং করেছেন। সেজন্য তাদের সে পদ্ধতি মানুষ গ্রহণ করেছে এবং তারা বিশ্বজয়ী হয়েছেন।

একসময় মানুষ সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতি incandescent lamp জ্বালাতো, এরপর আসল fluorescent lamp যাকে আমরা টিউব লাইট বলি, তারপরে আসল সিএফএল বা compact fluorescent lamp, যাকে আমরা এনার্জি সেভিং বাল্বও বলি। এখন এসেছে এলইডি বা light emitting diode বাল্ব। এসব বাল্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পারি, ক্রমশ এগুলো বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও সাদা আলোতে রূপান্তরিত হয়েছে।

মানুষ নতুনত্ব পছন্দ করে। নেতৃত্বের নতুনত্ব, টেকনোলজির নতুনত্ব, সঙ্গিতের নতুনত্ব, সাহিত্যের নতুনত্ব এমনকি লাইফ স্টাইলেরও নতুনত্ব চাই। সর্বদা নতুনের জয়-জয়াকার, নতুনের কদর। এই যে এত সব নতুনত্ব, এগুলো আসে নতুন উদ্ভাবন দ্বারা। জগতের ইতিহাসে যারা এমন নতুন কিছু করেছে, যা চলমান কর্মপদ্ধতিকে আরও সুন্দর, গতিশীল, সহজ, কস্ট ইফেকটিভ ও টাইম রিডিউসিং করেছে, তারা অমর হয়েছেন। মানব কল্যাণে লাগা সামান্য কাজও বিফলে যায়নি।

এই উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্য চাই আত্মবিশ্বাস। চাই উৎসাহ। স্বামীজি বলতেন, ‘তোরাও যদি ঐরূপ ভাবতে পারিস, আমাদের ভিতর অনন্ত শক্তি, অপার জ্ঞান, অদম্য উৎসাহ আছে এবং অনন্তেরই শক্তি জাগাতে পারিস তো তোরাও আমার মতো হতে পারিস।’ স্বামীজি ছিলেন বিশ্বজয়ী। তাই তিনি বলেছেন, তোরাও আমার মতো, অর্থাৎ বিশ্বজয়ী হতে পারবি।

বন্ধুরা, আমরাও যদি আমাদের ভিতরের অনন্ত শক্তি, অপার জ্ঞান ও অদম্য উৎসাহ জাগাতে পারি এবং সেই মতো জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমরা যে কাজ করি তাকে আরেকটু সুন্দর করার, আরেকটু গতিশীল করার, আরেকটু সহজ করার চেষ্টা করি বা সে কাজটি কম সময়ে, কম খরচে করবার চেষ্টা করি, তবে আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে থাকব। আর এগিয়ে থাকা লোকগুলোই তো বিশ্বজয় করে।

জীবনে উন্নতি করতে গেলে বা কোনো কিছু উদ্ভাবন করতে গেলে যে ক্রমাগত এগিয়ে যেতেই হয় এবং পথিমধ্যে না থেমে এগিয়ে গেলেই যে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে বা লক্ষ্য জয় করে আরও সামনে পৌঁছান যায়, সে প্রসঙ্গে একটি গল্প বলতে যেয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন—

এক কাঠুরে ছিল বড় গরিব। সারাদিন বনে সে কাঠ কাটত আর সন্ধ্যেবেলা গ্রামে এসে সে কাঠ বিক্রি করত। রোদ নেই জল নেই, অসুখ নেই বিসুখ নেই, রোজই তাকে কাঠ কাটতে যেতে হতো; আর মাথায় করে সব কাঠ বয়ে এনে বিক্রি করতে হতো। তাতে যে সামান্য পয়সা সে পেত, তাতেই সংসার তার কোনোরকমে চলত। খেটে খেটে কাঠুরের ভারি দুরবস্থা হলো। গায়ে ক’খানা হাড় ছাড়া যেন আর কিছুই ছিল না। একদিন কাঠুরে বনে কাঠ কাটতে গেছে, বনের মধ্যে এক সাধুর সঙ্গে তার দেখা। কাঠুরের অবস্থা দেখে সাধুর মনে বড় দয়া হলো। তিনি তাকে বললেন, আরও এগিয়ে যা।

সাধু চলে গেলেন। কাঠুরে মনে মনে ভাবতে লাগল, সাধু আমাকে আরও এগিয়ে যেতে বললেন। তা একটু গিয়েই দেখি। এই ভেবে কাঠুরে বনের ভিতর এগিয়ে চলল। যেতে যেতে সে গভীর বনে উপস্থিত হলো। গিয়ে দেখে সেখানে শুধু চন্দনের বন। খানিকটা চন্দন কাঠ কেটে কাঠুরে সেদিন বাড়ি ফিরল। সাধারণ কাঠের চেয়ে চন্দন কাঠের বিশগুণ দাম। কাঠুরে সেদিন অনেক পয়সা পেল। তারপর রোজই সে চন্দনের বনে চলে যেত, আর চন্দন কাঠ এনে বিক্রি করত। সংসারে তার আর আগের মতো কষ্ট নেই। কিছুদিন পরে তার মনে হলো, সাধু তো আমাকে এগিয়ে যেতেই বলেছিলেন, আরও কিছু এগিয়ে দেখি না, কী হয়। সেদিন সে বনে গিয়ে চন্দন বনের পর আরও এগিয়ে চলল। খানিক গিয়ে সে দেখল তামার খনি। খানিকটা তামা কাপড়ে বেঁধে সে ঘরে ফিরে এল। চন্দনের চেয়ে তামার দাম বেশি। কাঠুরে অনেক টাকা পেল। তার মনে তখন কি আনন্দ!

তারপর রোজ সে তামার খনিতে যেতে লাগল, আর যতটুকু বয়ে আনতে পারে নিয়ে আসে। এভাবে কিছুদিন যায়। কাঠুরের অবস্থা তখন আরও ভালো হয়েছে। কিছুদিন পর তার আবার মনে হলো, সাধু তো আমাকে এগিয়ে যেতেই বলেছিলেন। আরও কিছু এগিয়ে গিয়ে দেখি কি পাই। সেদিন সে তামার খনি পেরিয়ে আরও এগিয়ে যেতে লাগল। কিছুদূর গিয়েই দেখতে পেল এক রূপোর খনি। মহানন্দে কাঠুরে যতটুকু পারল রূপ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। দেখতে দেখতে কাঠুরে বড়লোক হয়ে উঠল। পাড়া-পড়শিরা বলাবলি করত, কাঠুরে দেবতার ধন পেয়েছে। রূপোর খনি পাবার পর কাঠুরের মনে হলো, সাধুর দয়ায় আমার অনেক হয়েছে। আর এগিয়ে গিয়ে কাজ নেই। যা হয়েছে বেশ হয়েছে। কিন্তু আবার তার মনে হলো, সাধু তো আমাকে এগিয়ে যেতেই বলেছেন। না, আমি থামব না, আরও এগিয়ে যাব।

এইভাবে কাঠুরে রোজ রোজ খানিকটা এগিয়ে যেতে লাগল। তাতে পর পর সোনার খনি, হীরার খনি, তারপর মণিমুক্তা জহরত সে পেল। আর কাঠুরেকে কে পায়? তার অবস্থা দেখে রাজারও হিংসা হতে লাগল।

বন্ধুরা, এই গল্পটি নিছকই গল্প নয়। তুমি লক্ষ্য করে দেখবে, যারা মাটি, পাহাড় বা সুমুদ্রের বুকে তেল, গ্যাস অনুসন্ধান করে, তারা এভাবেই এগিয়ে যায়। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার এভাবে এগিয়ে গিয়েই করেছিলেন। চাঁদের বুকে মানুষ এভাবে এগিয়ে গিয়েই পা রেখেছিল। পড়াশুনাতেও মানুষ এগিয়ে গিয়েই একের পর এক উন্নতি করে।

শুধু তাই নয়, কেউ কেউ হয়তো লেখাপড়ায় ভালো নয় কিন্তু সংগীত, অভিনয়, নৃত্য, সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্রাঙ্কন, ব্যবসা, খেলা, বা অন্য কোনো বিষয়ে তার বেশ আগ্রহ। সেও প্রবল পরিশ্রম করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেয়েই বিশ্বজয়ী হয়।

সুতরাং, যদি জীবনে উন্নতি করতে চাও তবে ক্রমাগত এগিয়ে যাও। যদি কিছু আবিষ্কার করতে চাও, তো ক্রমাগত এগিয়ে যাও। যদি বিশ্বজয়ী হতে চাও, তো ক্রমাগত এগিয়ে যাও। যদি তুমি চলা না থামাও, যদি তুমি মনেপ্রাণে চাও, তবে তুমিও তোমার নতুন উদ্ভাবনী দ্বারা খুব সহজেই বিশ্বজয়ী হয়ে উঠতে পারো। এ কথায় বিশ্বাস রাখো। তুমি নিশ্চয় বিশ্বজয়ী হবে। হবেই হবে।

এভাবে দৃঢ় ইচ্ছা শক্তির জোরে, মনে সাহস অবলম্বন করে, ধীর-স্থির শান্ত স্বভাবের হয়ে, সময়ের কাজ সময়মত করলে কাপুরুষও বীর হয়ে যায়। একজন মূর্খও বিদ্বান হয়ে যায় এবং একজন অসফল ব্যর্থ ব্যক্তিও জীবনে সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে। স্বামীজির ভাষায়, ‘তোমাদের কি মন মুখ এক হয়েছে? তোমরা কি মৃত্যুভয় পর্যন্ত তুচ্ছ করে নিঃস্বার্থভাবে থাকতে পারো? তোমাদের হৃদয়ে প্রেম আছে তো? যদি এইগুলি তোমাদের থাকে তবে তোমাদের কোনো কিছুকে, এমন কি মৃত্যুকে পর্যন্ত ভয় করবার দরকার নেই। এগিয়ে যাও, বৎসগণ। সমগ্র জগৎ জ্ঞানালোক চাইছে, উৎসুক নয়নে তার জন্য আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

বন্ধুরা, স্বামীজির এ কথায় বিশ্বাস করো, ‘যদি তুমি পবিত্র হও, যদি তুমি বলবান হও, তাহলে তুমি একাই সমগ্র জগতের সমকক্ষ হতে পারবে।

সুতরাং বন্ধুরা, আর আলিস্যি করে বসে থেকো না, সমস্ত ভয় ত্যাগ করে, সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, জগতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ো। ওঠো, জাগো, সমস্থ দুর্বলতা পেছনে ফেলে, ন্যায় ও সত্যকে আঁকড়ে ধরে, নিরন্তর কাজ করে জগতের মাঝে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করো এবং বিশ্বজয়ী হও।