মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৪৯

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২১

কিছু বই আছে, যেগুলো কাশির ওষুদ বাসকপাতার তেতো রসের মতো। বহু কষ্টে গিলতে হয়। যেমন ‘ক্রোচের নন্দনতত্ত্ব’। এই জিনিস গিলতে খুব কষ্ট হয়েছিল। মাথায় জেদ চেপেছিল বলে গিলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আরেকটা আছে, কমলকুমার মজুমদারের ‘গোলাপসুন্দরী’। আবুবকর সিদ্দিক স্যার পড়তে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এক মাসের মধ্যে পড়ে ফেরত দেবে।’ আমি প্রায় দুই বছর রেখে দিয়েছিলাম সমগ্রটি। সব কটি উপন্যাস পড়া হয়েছিল, কেবল ‘গোলাপসুন্দরী’ ছাড়া। বইটা ফেরত দেওয়ার সময় স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব কটি পড়েছ তো?’ বললাম, ‘জি স্যার, সব পড়েছি।’ বললেন, ‘গোলাপসুন্দরী কেমন লাগল?’ আমি খুব জোর দিয়ে বললাম, ‘অসাধারণ স্যার, অসাধারণ!’

তখনই স্যারের ফোনে একটি কল এলো, তিনি দ্বিতীয় প্রশ্নটি করার ফুরসত ফেলেন না। করলে ইজ্জত সোজা গাছে উঠে যেত। উপন্যাসটা পড়িনি জেনে কমলকুমারের বাংলাদেশীয় প্রতিনিধি কবি শোয়াইব জিবরান না আবার ক্ষেপে যান! ক্ষেপলেও কী করা! তবে ইচ্ছা আছে জীবনের অন্তিমলগ্নে হলেও মজুমদারের উপন্যাসটা একবার পড়ার চেষ্টা করে দেখব। অন্তিম লগ্নে কি পড়া যায়? নাকি মৃত্যুচিন্তায় কাবু হয়ে থাকা লাগবে? দেখা যাক।

প্রচুর বই কেনা হয়। পড়াও হয়। কয়েক বছর ধরে কোনো কোনো বই কোণাকুণি পড়ি। লাইন বাই লাইন নয়, কোণাকুণি। শীতকালে রাস্তা বাদ দিয়ে মানুষ যেমন কাটাধানের মাঠে কোণাকুণি রাস্তা বানিয়ে নেয়। কোণাকুণি পাঠের এই কৌশলটা বেশ কাজে লেগেছে। প্রচুর সময় বেঁচে গেছে, যাচ্ছে। জীবন ছোট তো। সময় কম, কাজ বেশি। দেখা গেল পাঁচ-দশটি, কখনো কখনো পনের-কুড়িটি বই কোণোকুণি পড়ার পর একটি বই সামনে এসে দাঁড়াল। সেটা সত্যিকারের বই। সেটা লাইন বাই লাইন পড়া হয়ে উঠল। সত্যিকারের বই কেমন? যে বই ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়, চিন্তা নাড়িয়ে দেয়। এই জিনিস কোণাকুণি পড়া যায় না, লাইন বাই লাইন পড়তে হয়। যেমন আজ শেষ করলাম বুদ্ধদেব বসুর ‘আত্মজৈবনিক।’ অবশ্য শেষ করলাম বলা যাবে না। বইটা তিন পর্বের : আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন, আমাদের কবিতাভবন। আমি ‘আমার ছেলেবেলা’টা কোণাকুণি মেরে দিয়েছি। কিন্তু বাকি দুই পর্ব লাইন বাই লাইন পড়েতে হয়েছে। ফাঁকিবাজি করার সুযোগ ছিল না।

যতই দিন যাচ্ছে, টের পাচ্ছি, পাঠযোগ্য বইয়ের সংখ্যা কমে আসছে। পৃথিবীতে কত কত পাঠযোগ্য বই যে আছে তার তো শুমার নাই। কিন্তু বাংলাদেশে বসে সব বইয়ের কি হদিস পাওয়া যায়! গেলেও পড়ার মতো সময় পাওয়া যায় না। তেমন মহৎ না হলে উপন্যাস এখন আর খুব একটা পড়তে ইচ্ছে করে না। ‘ব্রাদার্স কারামাজভ’ও আকর্ষণ করছে না। হয়ত মহৎ উপন্যাস, কিন্তু আকর্ষণ করছে না। এর কারণ হতে পারে উপন্যাসে এখন আর গল্প খুঁজি না, খুঁজি ভাষা আর স্টাইল। দস্তয়ভস্কির স্টাইল তো জানি। জানা জিনিস পড়ার কী দরকার। কিংবা এমনও হতে পারে, বইটি পড়তে নিরুৎসাহিত করেছেন হোর্হে লুইস বোর্হেস। তিনি বলছেন, ‘ধীরে ধীরে আমার মনে হতে লাগল যে দস্তয়ভস্কির চরিত্রগুলো বড় বেশি একই রকম এবং সেই অবিরাম অপরাধবোধের মধ্যে অস্বস্তিকর কিছু একটা ছিল।’

অবশ্য বোর্হেসের সব কথা কানে তুলি না। যেমন উপন্যাস বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এই কান দিয়ে ঢুকিয়ে ওই কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। তিনি উপন্যাস পছন্দ করতেন না। বলেছেন, ‘উপন্যাস পড়তে আমার ভালো লাগত না। আমার মতে, উপন্যাস এমন এক ধরণের সাহিত্যকর্ম যা একসময় হারিয়ে যাবে।’ উপন্যাস-সাহিত্যকে বোর্হেস বাহুল্য মনে করতেন। তিনি বলেন, ‘...আমি কখনো উপন্যাস লেখার কথা ভাবিনি। আমার মনে হয় যদি আমি কোনো উপন্যাস লিখতে শুরু করতাম, আমার কাছে এটাকে অর্থহীন মনে হতো এবং আমি এর শেষটা ধরে রাখতে পারতাম না।’ (দ্র. হোর্হে লুইস বোর্হেসের সাতটি আলাপ : রাজু আলাউদ্দিন)। শেষটা ধরে রাখতে পারতেন না, এটাই হচ্ছে আসল কথা। ধরে রাখতে পারতেন না বলেই তিনি আসলে উপন্যাস লিখতে পারেননি। হাসান আজিজুল হক যেমন বলেন, ‘বুঝলে স্বকৃত, কালি নাই। উপন্যাস লেখার মতো বোর্হেসের কলমে কালি নাই। হা হা হা।’ স্যারের হাসিটায় খুব মজা পেয়েছিলাম।

এই যে বোর্হেস বললেন উপন্যাস এক সময় হারিয়ে যাবে। উপন্যাস হারিয়ে গেলে থাকবে কী? মহাকাব্য? বোর্হেস মহাকাব্যের খুব ভক্ত ছিলেন। কিন্তু উপন্যাস হারিয়ে গেলে মানুষ কি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মহাকাব্যগুলোই পড়তে থাকবে? তার কথাটি যৌক্তিক মনে হয়নি। প্রযুক্তি তো এখন চরম উৎকর্ষে। মানুষ তো এখন চরম অস্থির ও ব্যস্ত সময় পার করছে। কই, উপন্যাসের পাঠক তো কমেনি! বরং সাহিত্যের সকল শাখার মধ্যে উপন্যাসই এখনো সবচেয়ে পাঠকপ্রিয়। মনে হয় না ভবিষ্যতেও উপন্যাস হারিয়ে যাবে। যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন গল্প থাকবে। যতদিন গল্প থাকবে ততদিন উপন্যাসও থাকবে।

বাসা থেকে প্রচুর বই সরাই। রাখি কেবল প্রয়োজনীয় বইগুলো। ইদানীং অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রয়োজনীয় বইগুলোও রাখার জায়গা হচ্ছে না। দেখ গেল একটা বই খুঁজছি। খুঁজছি তো খুঁজছিই...। খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে আলমিরার সব বই নামিয়ে ফেলেছি। ঘেমে নেয়ে হয়রাণ হয়ে গেছি। পরে দেখা গেল বইটা আলমিরার সামনের তাকেই পড়ে আছে। খামোখাই এতক্ষণ খুঁজলাম! রাগ কি আর রাখার জায়গা থাকে? আবার দেখা গেল প্রয়োজনীয় বইটা খুঁজেই পাচ্ছি না। মন খুব খারাপ হলো। পরে মনে পড়ে গেল বইটা তো অমুকজনকে বা অমুক লাইব্রেরীতে দিয়ে দিয়েছি। দিয়ে দিয়েছি, আর তো ফেরত চাওয়া যাবে না। সুতরাং আরেকটা কোনো। আবার কখনো দেখা গেল যেটি খুঁজে বেড়াচ্ছি সেটি অফিসের আলমিরায় বা টেবিলে পড়ে আছে। কিংবা নতুন আরেকটা কিনে আনলাম। কেনার পর দেখা গেল আগেরটাও খুঁজে পাওয়া গেছে।

মোজাফ্ফর বললেন, খালেদ হোসেইনির ‘দ্য কাইট রানার’ খুব ভালো উপন্যাস। এতদিন পড়িনি বলে তিরস্কারও করলেন। দেখি পড়ে। খারাপ হলে তার কাছ থেকে সব টাকা ফেরত নেওয়া হবে। চলবে

২৭.০৪.২০২১