মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৫০

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মে ০২, ২০২১

ভারতীয় রাষ্ট্রবিদ, সমরবিদ ও দার্শনিক শ্রীকৃষ্ণ এবং গ্রীক পুরাণের বীরযোদ্ধা অ্যাকিলিসের মৃত্যুর মধ্যে একটা মিল রয়েছে। আজ একাডেমির মাঠে দাঁড়িয়ে গল্পকার মোজাফ্ফর হোসেনের সঙ্গে গল্প করতে করতে বলছিলাম সেই মিলের কথা। অ্যাকিলিসের জন্মের পর তার মা থেটিস তাকে স্টিক্স নদীতে স্নান করালেন। স্টিক্স হচ্ছে পৃথিবী ও মৃত্যুপুরীর সীমানা নির্দেশক নদী। এ নদীর জলের ছোঁয়া পেলে মানুষ অমরত্ব লাভ করে। অ্যাকিলিসকে সেই নদীর জলে স্নান করানোর সময় তার বাম পায়ের গোড়ালি ধরে রেখেছিলেন থেটিস। ধরে রেখেছিলেন বলে সেই গোড়ালিতে জল লাগেনি। ফলে অ্যাকিলিসের সারা শরীর অভেদ্য বা অমর হলেও একমাত্র পায়ের গোড়ালি রয়ে যায় ভেদযোগ্য বা মরণশীল।

ট্রয় যুদ্ধ চলল দশ বছর। অ্যাকিলিস তখনো জীবিত। কেউ তাকে বধ করতে পারেনি। কীভাবে পারবে, স্টিক্স নদীতে স্নানের ফলে তার শরীর তো অভেদ্য। কোনো তলোয়ার, কোনো তীর তার শরীরকে হনন করতে পারবে না। ট্রয় রাজপুত্র প্যারিসের সঙ্গে যখন তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হলেন তখন দেবতা অ্যাপোলো সহায়ক হলেন প্যারিসের। বলে দিলেন অ্যাকিলিসের ঠিক কোন জায়গাটায় তীরবিদ্ধ করতে হবে। অ্যাপোলোর নির্দেশমতো জায়গামতো তীর নিক্ষেপ করলেন প্যারিস। তীর গিয়ে লাগল অ্যাকিলিসের বাম পায়ের গোড়ালিতে। এক তীরেই মৃত্যু হলো মহাবীর অ্যাকিলিসের।

এবার দেখা যাক শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর কারণ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শত পুত্রের মৃত্যুতে শোকবিহ্বল গান্ধারি এই ধ্বংসলীলার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে দায়ী করেন। গান্ধারীর স্থির বিশ্বাস ছিল কৃষ্ণ চাইলেই যুদ্ধ আটকাতে পারতেন। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ না আটকানোয় কৃষ্ণকে গান্ধারি এই বলে অভিশাপ দেন, ‘স্বামীর সেবা করার ফলে অর্জিত পূণ্যের বলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যে আজ থেকে ছত্রিশ বছর পর তুমিও পুত্র, বন্ধু ও স্বজন হারিয়ে বনের মধ্যে খুব কষ্টে নিহত হবে এবং যাদবনারীগণও কুরু ও পাণ্ডব-পক্ষীয় নারীদের মতো কাঁদবে।’ গান্ধারির অভিশাপকে আশীর্বাদ হিসেবে নিলেন কৃষ্ণ। কারণ তিনি জানতেন যাদবদের বংশ একদিন অন্তর্কলহে শেষ হয়ে যাবে। গান্ধারি বরং তার কাজ সহজ করে দিয়েছেন।

তা কৃষ্ণের মৃত্যু হলো কীভাবে? বলছি। তার আগে বলে নেই উগ্র মেজাজি ঋষি দুর্বাসার কথা। তিনি এমনই বদমেজাজি ছিলেন যে, যখন-তখন যাকে তাকে শাপ দিয়ে বসতেন। অভিশাপে স্ত্রীকে তো ভস্ম করলেনই, একবার খোদ দেবাদিদেব মহাদেবকেও শাপ দিয়ে বসেছিলেন। এছাড়া মাঝেমধ্যে তিনি উদ্ভট সব কর্মকা-ও করতেন। একবার দ্বারকায় বেড়াতে এলেন দুর্বাসা। গরম পায়েস খাচ্ছিলেন। হঠাৎ শ্রীকৃষ্ণকে সামনে দেখতে পেয়ে পায়েসের বাটিটা বাড়িয়ে ধরে বললেন এই পায়েন যেন কৃষ্ণ তার সারা গায়ে মেখে নেন। ঋষির প্রতি ভক্তিবশত কৃষ্ণ সেই পায়েস তার সারা গায়ে মাখলেন, শুধু পায়ের তলা ছাড়া। দুর্বাসা বললেন, ‘হে যদুশ্রেষ্ঠ, এই পায়েস মেখেছেন বলে আপনার সর্বদেহ অভেদ্য থাকবে, কোনো আঘাতই কাবু করতে পারবে না। কিন্তু আপনার পদতল থাকবে ভেদযোগ্য, কারণ সেখানে আপনি পায়েস মাখেননি।’

অতঃপর পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে যুদবংশ ধ্বংস হলো। শ্রীকৃষ্ণ দেহত্যাগের জন্য ইন্দ্রিয়গ্রাম সংযম ও মহাযোগ আশ্রয় করে বনের এক বৃক্ষের ওপর শায়িত হলেন। এমন সময় তার পায়ের তালুতে এসে বিঁধল একটি তীর। কে নিক্ষেপ করল এই তীর? নিক্ষেপ করল ‘জরা’ নামের এক ব্যধ। কে এই জরা? জরা হচ্ছেন ‘রামায়ণে’ বর্ণিত সুগ্রীবের ভাই বালি। শ্রীকৃষ্ণ তো জগৎ-পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর অবতার। ত্রেতা যুগে তিনিই রাম নামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাল্মিকী ‘রামায়ণে’র বর্ণনামতে রামের কাছে বালি ও রাবনের অপরাধ ছিল সমান। রাবন যেমন সীতাকে আটকে রেখে বিয়ে করার চেষ্টা করেছিল, তেমনি বালিও তার ছোট ভাই সুগ্রীবের স্ত্রীকে আটকে রেখে বিয়ে করার চেষ্টা করেছিল। সুগ্রীব তার রাজ্য থেকে বড় ভাই বালি কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বনবাসরত রামের আশ্রয় নিলে রাম প্রথমে সুগ্রীবকে সাহায্য করে তাকে তার দলে নেওয়ার জন্য বালিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সুগ্রীব ও বালির যুদ্ধের সময় আড়াল  থেকে তীর নিক্ষেপ করে বালিকে হত্যা করেন।

বালিকে হত্যার সিদ্ধান্ত ছিল ঠিক, কিন্তু তাকে হত্যার পদ্ধতি ঠিক বীরের মতো ছিল না, ছিল কাপুরুষের মতো। আড়াল থেকে তীর মেরে বালিকে হত্যা করাটা রামের কাছে অপরাধ মনে হতে লাগল। এই ভুলের শাস্তি তিনি স্বীকার করে বালির পুত্র অঙ্গদকে এই প্রতিশ্রুতি দেন যে পরের জন্মে একইভাবে বালিপুত্র অঙ্গদের আড়াল থেকে ছোঁড়া তীরে তিনি নিহত হবেন। এই অঙ্গদই ছিল ‘জরা’ নামের সেই ব্যাধ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্যারিসের নিক্ষিপ্ত তীর এসে লাগল অ্যাকিলিসের পায়ের গোড়ালিতে এবং জরার নিক্ষিপ্ত তীর এসে লাগল শ্রীকৃষ্ণের পায়ের তালুতে। দুজনের মৃত্যুর কী আশ্চর্য মিল! মিথের এই মিল কীভাবে হলো? ভারতবর্ষের এ মিথ কি গ্রিক পর্যন্ত পৌঁছেছিল? হয়ত। পৌঁছতেও পারে। হয়ত শ্রীকৃষ্ণের মিথ গড়াতে গড়াতে গ্রিকে অ্যাকিলিসে স্থাপিত হয়েছিল। মোজাফ্ফর বললেন, ‘মহৎ আখ্যান কখনো কখনো মিলে যায়। চিন্তার সঙ্গে চিন্তা কখনো মিলে যায়।’ হয়ত মোজাফ্ফরের কথাই ঠিক। কিন্তু আমি ভাবি, মিথের এই ধরনের মিল তো শুধু একটি নয়, এরকম অসংখ্য মিল রয়েছে। কখনো কখনো মনে হয়, সমুদ্রের জলের মতো মিথেরাও একদা পৃথিবী পরিভ্রণ করেছিল। আরব সাগরের জল যেমন বঙ্গোপসাগরেও আসে, প্রশান্ত মহাসাগরের জল যেমন আটলান্টিকেও যায়, তেমনি এক ভূখণ্ডের মিথ ঘুরতে ঘুরতে আরেক ভূখণ্ডে গিয়েছিল। কিংবা যায়নি। আলাদা ভূখণ্ডে সৃষ্ট এসব মিথের ঐক্য স্রেফ কাকতালীয়।

কখনো কখনো মনে হয়, মিথের এসব ঐক্য নিয়ে একটি বই লিখে ফেলি। পরক্ষণে মনে হয়, ধুর, আর কাজ নাই! তাছাড়া মিথ ও মহাকাব্য এমন এক জগৎ, যে জগতে ঢুকে বের হওয়াটা একটু কঠিন। মিথ ও বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে বের হতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। মহাকাব্যের জগত থেকে এখনো পারিনি বের হতে। মহাকাব্যগুলোকে এখনো আধুনিক মনে হয়। এখনো নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করি। যখন কোনো কারণে হতোদ্যম হই, তখন শরণ নেই মহাকাব্যের। মহাভারত-ইলিয়াদ-রামায়ণ-অডিসি-শাহনামা কিংবা ডিভাইন কমেডিয়া হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করি। ভাবি, পূর্বপুরুষেরা শত শত পৃষ্ঠার এমন মহৎ সব সাহিত্যকর্ম সৃজন করতে পারলে আমরা কি এক পৃষ্ঠাও পারব না? তখন দেখতে পাই দূরে দাঁড়িয়ে বাল্মিকী, হোমার, বেদব্যাস, ফেরদৌসী প্রমুখগণ মুচকি হাসছেন। চলবে

২.৫.২০২১