মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৫৫

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২১

ঔপন্যাসিকের জন্য নিয়মানুবর্তিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেউ বলতে পারেন, পৃথিবীর কত বড় বড় কবি জীবনের বিপুল অপচয় করে কবিতা লিখেছেন, আর আমি কিনা নিয়মানুবর্তিতার কথা বলছি! আমার কথা বিশ্বাস না হলে উইলিয়াম ফকনারের মন্তব্য শোনা যেতে পারে। জিন স্টিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঔপন্যাসিক ফকনার বলেছিলেন, ‘ঔপন্যাসিকের ৯৯% হলো মেধা, ৯৯% হলো নিয়মানুবর্তিতা, ৯৯% হলো কাজ করে যাওয়া।’ সুতরাং ঔপন্যাসিক জীবনযাপনে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকা জরুরি। কবির জন্য নিয়ম না হলেও চলে। একটি উপন্যাস লেখার জন্য যে বোধ, যে অনুসন্ধান, যে প্রজ্ঞা আর যে সৃষ্টিশীলতার প্রয়োজন হয়, একটি কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও তা-ই প্রয়োজন হয়।

কিন্তু কবিতা ও উপন্যাসে শ্রমের মাত্রা এক নয়। সৃষ্টিশীলতার মাত্রা সমান হলেও শ্রমের মাত্রায় ব্যবধান আছে। একটি কবিতা লিখতে কতক্ষণ বা কতদিন সময় লাগে? বড়জোর এক ঘণ্টা, একদিন বা এক সপ্তাহ? অপরদিকে একটি উপন্যাস লিখতে তিন মাস, ছয় মাস, এক বছর, দুই বছর কিংবা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। সময়টা উপন্যাসের বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে। যে উপন্যাস দুদিন, চার দিন বা এক সপ্তাহে লেখা হয় সেটি উপন্যাস হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, সেটি উপন্যাস নামের জঞ্জাল হওয়ার শঙ্কাই বেশি। ধানের মধ্যে তুষ যেমন।

দস্তয়ভস্কির ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাসটির কথা বলছেন? দস্তয়ভস্কি মাত্র একরাতে উপন্যাসটি লিখেছিলেন, এই তথ্য সঠিক নয়। দস্তয়ভস্কির জীবনকেন্দ্রিক এই ছোট্ট উপন্যাসটি লিখতে আসলে সময় লেগেছি প্রায় চব্বিশ দিন। ‘মোড়লের শরৎ’ লিখবার জন্য গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস পরিকল্পনা করেছেন সতের বছর; লেখাটা শেষ করতে যদিও দু-বছরের বেশি লাগেনি। লেখা শেষ করার পরও ঠিক লেখাটা পেতে গিয়ে দুবার পুরো লেখাটা পাল্টাতে হয়েছিল। আর ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ লেখার জন্য মার্কেস পরিকল্পনা করেছিলেন প্রায় পনের বছর; যদিও টাইপরাইটারে লিখতে লেগেছিল মাত্র আঠারো মাস।

প্রত্যেক ঔপন্যাসিককেই আসলে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয় উপন্যাস রচনায়। উপন্যাস আসলে এমন এক জটিল শিল্পকর্ম যার মধ্যে সারাক্ষণ থাকতে হয়। এটি লেখার মুডের ওপর নির্ভর করে না। উপন্যাস ওহি নয়, ইলহাম নয়, নয় কোনো অলৌকিক বাণী। এটি ঝলকানির মতো আসে না, একে ধরতে হয়। বড়শি দিয়ে যেমন মাছ ধরে শিকারি। কবিতা ঝলকানির মতো আসতে পারে। কবি ঘুমানোর জন্য বালিশে মাথা রাখলেন, অমনি কবিতার পঙ্ক্তি তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল, আর শোয়া থেকে উঠে মাত্র দশ-কুড়ি মিনিটে কবিতাটি তিনি মাথা থেকে কাগজে নামিয়ে ফেলতে পারেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাটাছেঁড়া করে এটিকে আরও সুন্দর করে প্রকাশের জন্য পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতে পারেন।

কিন্তু উপন্যাসের ব্যাপারটা তেমন নয়। উপন্যাস আসলে বিক্ষিপ্ত একটা ব্যাপার। উপন্যাসের সব কিছুই বিক্ষিপ্ত অবস্থার মধ্যে থাকে। কাহিনি, চরিত্র, শব্দ, বাক্য, আঙ্গিক সব। অনেকটা নির্মিতব্য বাড়ির মতো। বাড়িটা তৈরির জন্য ফাঁকা একটা জায়গার একদিকে ইট-সুরকি, একদিকে সিমেন্ট-বালি এবং একদিকে রডের স্তূপ পড়ে থাকে বিক্ষিপ্তভাবে। অক্লান্ত সাধনায় সেসব বিক্ষিপ্ত উপাদানকে সাজিয়ে তোলে রাজমিস্ত্রি, নির্মাণ করে বিশাল এক দৃষ্টিনন্দন ইমারত। এই সৃষ্টির জন্য তাকে লেগে থাকতে হয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে ডিজাইনটা করে একদিনেই সে ইমারতটা নির্মাণ করে ফেলতে পারে। উপন্যাসের নির্মাণও এমনই। আমি ঔপন্যাসিক, আমার যখন লেখার মুড আসবে তখন লিখলাম, বাকি সময় ঘুরেফিরে কাটিয়ে দিলাম―এই করে উপন্যাস লেখা হয় না। বেহায়া প্রেমিকের মতো সারাক্ষণ উপন্যাসের পেছনে লেগে থাকতে হয়।

ঔপন্যাসিকের প্রেরণা আসলে নিয়মানুবর্তিতারই ফল। অর্থাৎ প্রতিদিন লিখে যেতে হয়। হ্যাঁ, প্রতিদিন হয়ত উপন্যাস লেখা সম্ভব হয় না সত্যি, কিন্তু প্রতিদিন উপন্যাসটি নিয়ে অনুধ্যানের মধ্যে থাকতে হয়। প্রচুর নোট নিতে হয়। যে চরিত্রটি নিয়ে লিখব তার অবয়ব, চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-কল্পনা, আচার-আচরণ, যৌনতা, খাদ্যাভ্যাস এবং তার চারিত্রিক গুণাবলি-দোষাবলি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হয়। পোদ্রো নোবা তো তার চরিত্রদের ছবি পর্যন্ত আঁকতেন লেখার আগে। তাদের চেহারা, চুল, পোশাক-আশাক―সব এঁকে নিয়ে তারপর লিখতে বসতেন। বলছি না সবাইকে নোবা’র মতো করতে হবে। বলছি লেখার আগে মাথায় সাজিয়ে নিতে হয় সবকিছু। অর্থাৎ ডিজাইনটা করে নিতে হয়। এই সাজানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন। আর সময় বের হয় নিয়মানুবর্তিতা থেকে। চলবে

১৮ জুন ২০২১