স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৬৫

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২২

আমির হামজা ইস্যুতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের কারো কারো দৈন্যদশা দেখে একটু বিস্ময় জেগেছে। কেউ কেউ তাকে রবীন্দ্রনাথ ও বব ডিলানের সমপর্যায়ে তুলে দিয়েছেন। চব্বিশ ঘণ্টা আগেও আমার মধ্যে সংশয় ছিল, আসলেই কি আমির হামজা নিভৃতচারী কোনো গীতিকার? বিশাল বাংলার গ্রামগঞ্জে তো এমন হাজারও কবি রয়েছেন, ফোকলোরের ভাষায় যাদেরকে কবিয়াল, বাউল, গায়েন বা পালাকার বলা হয়। আমির হামজা কি তেমন কেউ?

সেই কারণে আগের লেখাটিতে সাহিত্য বা সংগীতে আমির হামজার অবদান নিয়ে আমি ছিলাম খানিকটা সংশয়ী, দোদুল্যমান। কিন্তু তার প্রকাশিত বইয়ের গানগুলো পড়ে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম যে, গীতিকার হিসেবে তিনি অত্যন্ত নিম্নমানের। যাদের নূন্যতম সাহিত্যবোধ আছে, তারা একবাক্যে এ কথা স্বীকার করে নেবেন। এই নিম্নমান বোঝার জন্য ভলতেয়ার হওয়ার প্রয়োজন নেই; আবু সায়ীদ আইয়ুব, দীনেশচন্দ্র সেন বা ভূমেন্দ্র গুহ হওয়ার দরকার নেই। বাংলা সাহিত্যের তরুণতম কবিটিও একবাক্যে এটা স্বীকার করে নেবেন।

বাউল শাহ আবদুল করিম, রাধারমন, গিয়াসউদ্দিন, দূরবিন শাহ, আবদুস সাত্তার বা সাত্তার পাগলা, দীন শরৎ, বিজয় সরকার ও রশিদউদ্দিন সরকারসহ লোকগানের স্তম্ভদের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাংলাদেশে এখনও আবদুর রহমান বয়াতি, সাইদুর রহমান বয়াতি, শরিয়ত বয়াতি বা রীতা দেওয়ানসহ কয়েক হাজার বাউল, কবিয়াল, পালাকার, গীতিকার রয়েছেন, যাদের গান দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ। গানের মধ্য দিয়ে তারা নিরলসভাবে সংস্কৃতির সেবা করে যাচ্ছেন, মৌলবাদ-উগ্রবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানুষের বুদ্ধির মুক্তি ঘটিয়ে যাচ্ছেন। তাদের গান আমাদেরকে নাড়িয়ে দেয়, ভাবনার উদ্রেক ঘটায়, আমাদেরকে শেকড়ের দিকে টান দেয়। আমির হামজা এসব নিম্নমানের গান রচনা করে যদি স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়ে যেতে পারেন, তবে জীবিত এই কয়েক হাজার বাউল-গায়েন-লোকসাধকরা কয়েক বার নোবেল প্রাইজের যোগ্য।

কেউ কেউ বলেছেন, আমির হামজা মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান রচনা করেছেন। প্রশ্ন, তাকে কি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পদক দেওয়া হচ্ছে? না, দেওয়া হচ্ছে সাহিত্যে। আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এসব নিম্নমানের গান লিখে যদি তিনি রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হতে পারেন, তবে মুজিববর্ষ উপলক্ষে গত এক বছরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ভুলে ভরা, অসম্পাদিত যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে, যেসব বইয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, যেসব বই প্রকাশের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রকারান্তরে অপমান করা হয়েছে, সেই লেখক-সম্পাদক ও সংকলকরা প্রত্যেকে বাংলা একাডেমি, একুশে এবং স্বাধীন পদকের যোগ্য।

তবে বাংলার এই হাজার হাজার আউল-বাউল, পালাকার, কবিয়াল আর দেশসেরা সাহিত্যিকদের ডিঙিয়ে কীভাবে আমির হামজা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলেন? এখন একথা মোটামুটি স্পষ্ট যে, এর পেছনে রয়েছে বড় ধরনের প্ল্যান এবং বিনিয়োগ। এই পরিকল্পনার প্রধান পরিকল্পক কে, তা ‘প্রথম আলো’ ও ‘যুগান্তর’সহ নানা সংবাদমাধ্যমের খবরগুলো পড়লেই বোঝা যাবে।

কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এখন বেরিয়ে এলো সাপ। যেই সেই সাপ নয়, রীতিমতো গোখরো। পত্রিকাগুলো আপাতত এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মো. আমির হামজা ছিলেন একজন খুনের আসামি। আশা করি শীঘ্রই এটাও প্রমাণিত হবে যে, শুধু আসামি নন, আমির হামজা আদালত কতৃর্ক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি এবং বিএনপি সরকারের আমলে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর তদবিরের জোরে তিনি দণ্ড থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। আদালতের সংরক্ষণাগারে নিশ্চয়ই সেই রায়ের কাগজপত্রাদি রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা শীঘ্রই সেসব কাগজ বের করতে সক্ষম হবেন নিশ্চয়ই। এখন দেখার বিষয়, খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন আসামিকে স্বাধীনতা পদক প্রদানের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্র।

মাগুরা জেলা বিএনপির একজন বিএনপি নেতা ‘প্রথম আলো’কে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়েও অনেক গান রচনা করেছেন আমির হামজা। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যিনি গান রচনা করেছেন, একই সঙ্গে তিনি জিয়াউর রহমানকে নিয়েও গান রচনা করেছেন। বাংলাদেশের সুশীল সমাজ এবং রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়টাকে কীভাবে নেবেন, জানি না। যারা গত দুদিন আমির হামজার পক্ষাবলম্বন করে জ্বালাময়ী পোস্ট দিয়ে ফেসবুক ফাটিয়ে দিয়েছেন, আমলাতন্ত্রের দুবৃত্তায়নের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, এখন তারা কী বলবেন, কোথায় মুখ লুকাবেন, তা দেখার জন্য বিপুল কৌতূহলের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।

আশা করছি, স্বাধীনতা পদকের তালিকা থেকে মো. আমির হামজার নাম অচিরেই বাতিল করা হবে। বাতিল করা না হলে বাংলাদেশের হাজার হাজার কবি, সাহিত্যিক, আউল-বাউল, গীতিকার, পালাকারকে অপমান করা হবে। এবং স্বাধীনতা পদকের প্রস্তাবক কারা হবেন, নির্বাচক কারা হবেন, ভবিষ্যতের জন্য তা-ও নির্ধারণ করে নেওয়া আবশ্যক। নইলে আমলারা ভবিষ্যতেও এসব তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়ে যেতে থাকবেন।

একান্তই যদি প্রস্তাবক বা নির্বাচক হিসেবে আমলাদেরকেই রাখতে হয়, তবে সেসব আমলাকেই রাখা হোক, যারা শিল্প-সাহিত্যের খোঁজখবর রাখেন। এমন আমলার সংখ্যা একেবারে কম নয়। অথবা এই পদক প্রক্রিয়ার সঙ্গে দেশের জ্যেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকদের যুক্ত করা হোক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ একটি বেসামরিক পুরস্কার নিয়ে এমন তামাশা চলতে পারে না, চলতে দেওয়া উচিত নয়।

১৭ মার্চ ২০২২