মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ১৮

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ২৩, ২০২০

বছর দুই আগে, শরিয়তপুরের নড়িয়ায় যখন পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙন চলছিল, আমি ও কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী দেখতে গিয়েছিলাম সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেখেছি কীভাবে নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছিল একটি জনপদ। নড়িয়ার এক লোক বিস্তর টাকা খরচ করে সুন্দর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সর্বানাশী পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙনে তলিয়ে গেল মসজিদটি।

প্রশ্ন, মসজিদ তো খোদার ঘর। খোদা কি রক্ষা করতে পারতেন না তার ঘরটি? পারারই তো কথা। কেননা তিনি তো মহাশক্তিমান। কিন্তু তিনি তো রক্ষা করলেন না। কেন করলেন না? এই জন্য যে, তিনি নিরপেক্ষ, তিনি নির্বিকার। তিনি যদি এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা হয়ে থাকেন, মানুষ যেমন তার সৃষ্টি, তেমনি মসজিদও। মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডাও। মুদিখানা, সুপারশপ, কাঁচাবাজার, মাছবাজার, মাংসবাজারও। তার কাছে সবাই সমান, সবকিছুই সমান। কোনোটাকে তিনি আলাদা চোখে দেখেন না। সে-কারণেই ধ্বংস করার সময় তিনি মসজিদকে রক্ষা করেন না। মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডাকেও না।

একইভাবে, মানুষের ভালো-মন্দের দায় তার উপর বর্তানো যায় না। যদি বর্তানো হয়, তবে চোর চুরি করলে, ডাকাত ডাকাতি করলে, ধর্ষক ধর্ষণ করলে, খুনি খুন করলে পুলিশ কেন গ্রেপ্তার করে? আদালত কেন শাস্তি দেয়? চোর তো খোদার হুকুমেই চুরি করেছে, ডাকাত-ধর্ষক-খুনি তো খোদার হুকুমেই ডাকাতি-ধর্ষণ-খুন করেছে। কেননা তার হুকুম ছাড়া কোনো কিছুই সংঘটিত হয় না। সুতরাং সব দোষ তার বলে, এভাবে তার উপর সব দায় চাপিয়ে কি চোর-ডাকাত-ধর্ষক-খুনিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়? হয় না। কেননা মানুষের কর্মের দায় খোদার ওপর চাপানো যায় না। কেননা তিনি কর্মনিরপেক্ষ, পাপ-পুণ্য নিরপেক্ষ। কেউ ছুটন্ত ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে গেলে কিংবা কুড়ি তলা ভবনের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলে কিংবা গলা পর্যন্ত বিষ খেয়ে ফেললে তিনি তাকে রক্ষা করবেন না। কারণ তিনি নির্বিকার।

কদিন আগে ঢাকার মিরপুরের টোলারবাগে মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন একজন। গতকাল মারা গেল আরেকজন, যিনি আগেরজনের প্রতিবেশী এবং একই সঙ্গে একই মসজিদে নামাজ পড়তেন। দ্বিতীয়জনকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন যে ডাক্তার, তিনি এখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। ওই মসজিদ থেকে আরো কতজন আক্রান্ত হয়েছে কে জানে। হয়ত জানা যাবে আরো কদিন পর।

ওদিকে গতকাল ভৈরবে যে লোকটি মারা গেলেন তিনিও নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। তার কাছ থেকে আরো কজন সংক্রমিত হয়েছে কে জানে। হয়ত জানা যাবে কদিন পর। মুসলমান বলে, মুসল্লি বলে খোদা মিরপুরের ওই দুজনকে রক্ষা করেননি। কেননা তিনি নিরপেক্ষ, নির্বিকার। তার ‘ঘর’ মক্কার ক্বাবা যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তিনি তার শক্তি প্রয়োগ করে খুলে দিচ্ছেন না। নবির সমাধি মদিনা যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তিনি তার শক্তি প্রয়োগ করে খুলে দিচ্ছেন না। নানা দেশের মসজিদগুলো যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তিনি সেগুলো খুলে দিচ্ছেন না। ভ্যাটিকান সিটি যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তিনি তা খুলে দিচ্ছেন না। মন্দিরগুলো যে বন্ধ করা হচ্ছে, তিনি খুলে দিচ্ছেন না। দিচ্ছেন না, কারণ তিনি নিরপেক্ষ, নির্বিকার। তার কাছে সবই সমান। সে-কারণেই ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না।’

করোনার এই প্রাদুর্ভাবকালে পৃথিবীর অনেক মুসলিম-প্রধান দেশের মসজিদগুলো বন্ধ করা হয়েছে। প্রশ্ন, বাংলাদেশে কি করা হবে? উত্তর, না। কারণ “আমরা পৃথিবীর সেরা মুসলমান। আমাদের মতো সাচ্চা মুসলমান পৃথিবীর কোথাও নেই। আমরা ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানের ইমান দুর্বল। সবাই কাফেরদের দালাল। সুতরাং ‘আল্লাহর গজব’ করোনা আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। করোনার কথা বলে মসজিদ বন্ধ করা যাবে না।” সরকার যদি মসজিদগুলো বন্ধ করে, তবে ধর্মব্যবসায়ীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। এই পরাজয় তারা মানবে না। সুতরাং মসজিদ বন্ধ করা যাবে না। ধর্মান্ধদের কাছে নতজানু সরকারের এই সাহস নেই। ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের এই সাহস নেই। এখানেই গণতন্ত্রের ফাঁক, এখানেই গণতন্ত্রের দুর্বলতা। স্বৈরতান্ত্রিক সরকার হলে পারত। তার মানে ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সরকারও এখানে অসহায়। কিছুই করতে পারবে না।

তবু বলি, হে মুসলমান, খোদা শুধু মসজিদে থাকেন না। ‘পূর্ব এবং পশ্চিম আল্লাহ তায়ালারই। সুতরাং যেদিকেই মুখ ফিরাও, সেদিকেই রয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞাত।’ (সূরা বাকারা ১১৫)। তার মানে খোদা সর্বত্র বিরাজমান। তিনি শুধু মসজিদে থাকলে মাঠে কি নেই? ঘাটে কি নেই? রাস্তায় কি নেই? স্টেশনে কি নেই? বন্দরে কি নেই? পাহাড়ে কি নেই? জঙ্গলে কি নেই? সমুদ্রে কি নেই? আছেন। আপনাদের শাস্ত্রমতে তিনি সর্বত্রই আছেন। আপনার ঘরেও তিনি আছেন। আপনার খাটের উপর তিনি আছেন, খাটের তলায়ও আছেন। আপনার বুকের ভেতরেও তিনি আছেন, আপনার নাসারন্ধ্রেও আছেন। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম―আপনি যেদিকে ফিরেই নামাজ পড়েন না কেন, যেখানে বসেই তাকে ডাকেন না কেন, হাটে-মাঠে-ঘাটে, ঘরে―তিনি শুনতে পাবেন।

জানি এসব কথা আপনাদের কর্ণকুহরে ঢুকবে না। কারণ আপনাদের প্রভু আপনাদের অন্তরে এমন এক সিলমোহর মেরে দিয়েছেন, যার কারণে আপনারা কিছুই শুনতে পান না, কিছুই দেখতে পান না, কিছুই বুঝতে চান না। তবু বললাম। তবু শূন্য মরুদ্যানে চিৎকার করে গেলাম।

পৃথিবীর মানুষ একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা মানবজাতির জন্য নতুন। গোটা পৃথিবী একসঙ্গে আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি। সম্ভবত আমাদের জন্যও একটি ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। যখন সতর্ক হওয়ার কথা ছিল তখন আমরা সতর্ক হইনি। কিন্তু সময় এখনো মনে হয় আছে। এই মুহূর্তে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে, সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, আগামি কদিনের জন্য গোটা দেশ লকডাউন করা হোক। আশা করি তা করে সরকার বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে।

২৩.৩.২০২০