মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৪২

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২১

চিম্বুক পাহাড়ের দেশ থেকে আজ ঢাকার শাহবাগে এসেছেন ম্রো জাতির মানুষেরা। বাঁশি বাজিয়ে, গান গেয়ে তাঁরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিসের প্রতিবাদ? চিম্বুক পাহাড়ের কাছে ম্রোদের ভূমি দখল করে নির্মিত হচ্ছে পাঁচতারকা হোটেল, ইকো রিসোর্ট। শিকদার গ্রুপ বানাচ্ছে। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা যাবে। কেন যাবে? কেন আবার? সেখানে ম্রোসহ অন্যান্য পাহাড়ি ‘চিড়িয়ারা’ থাকে। তারা মানুষ নয়, চিড়িয়া। সেই ‘চিড়িয়াদের’ দেখতে গেলে তো রাতে থাকতে হবে। থাকতে হলে তো হোটেল লাগবে। যেনতেন হোটেল হলে হবে না, ফাইভ স্টার হোটেল লাগবে, যার ভাড়া হবে প্রতিরাত ত্রিশ হাজার টাকা। এই হোটেল নির্মাণের জন্য পাহাড়ের ইকো সিস্টেম ধ্বংস করে দাও, বন ধ্বংস করে দাও, পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উচ্ছেদ করে দাও, তাদের ফসলি জমি নষ্ট করে দাও, তাদের ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে দাও। পূর্বপুরুষের ভূমি থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করে পাঠিয়ে দাও আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

এসব করার জন্য কি স্থানীয় ম্রোদের মতামত নেওয়া হয়েছিল? মতামত? তা আবার কী? ম্রোরা কি এদেশের নাগরিক? তারা কি বাংলা ভাষায় কথা বলে? তাদের পাহাড়ের নাম চিম্বুক পাহাড়। কবি ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব আজীজ জানালেন, ওই পাহাড়ের নামই নাকি বদলে দেওয়া হচ্ছে। চিম্বুক পাহাড়ের নতুন নাম হবে ‘সুফিয়া’। সুফিয়া পাহাড়। বাহ বাঙালি! বাহ! মহাকালী যেভাবে হয়ে গেছে মহাখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেভাবে হয়ে গেছে বি-বাড়িয়া, রামপুর যেভাবে হয়ে গেছে রসুলপুর, একদিন এভাবেই চিম্বুক পাহাড় হয়ে যাবে সুফিয়া পাহাড়। একদিন এভাবেই ‘ভাষা আন্দোলন’ হয়ে যাবে ‘জবান জিহাদ।’ কী চমৎকার! কী চমৎকার ভাষার রাজনীতি!

এই যে ম্রোরা সুদূর বান্দরবান থেকে শাহবাগে এসে দাঁড়ালেন, তাঁরা যে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাঁদের এই প্রতিবাদ কি রাষ্ট্রের কর্ণকুহরে আদৌ পৌঁছবে? মনে হয় না। আমার কিংবা আমাদের প্রতিবাদও কি রাষ্ট্র আমলে নেবে? মনে হয় না। কোথাকার কোন ছা-পোষা লেখক, তার আবার প্রতিবাদ! তার চেয়ে বরং আসুন একটি গল্প শুনি। একটা উপন্যাস শুরু করেছি। পটভূমি খাগড়াছড়ি থেকে বান্দরবান। উপন্যাসটি রচনার সূত্রে জানতে পারি মেনলে ম্রো কথা। ক্রামাদি মেনলে ম্রো। তার বাড়ি চিম্বুক পাহাড়ের দেশে, পোড়াপাড়া গ্রামে। ম্রো ছেলেদের চেয়ে একদমই আলাদা ছিলেন মেনলে। সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন পহাড়ে জঙ্গলে আর পাড়ায় পাড়ায়। সারাক্ষণ থাকতেন অন্যমনষ্ক। কখনো কখনো এমনও হতো যে কেউ তাকে ডাকলেও শুনতে পেতেন না। তিনি শুনেছিলেন, পোড়াপাড়াই শুধু পৃথিবী নয়, এর বাইরে আছে এক বিশাল পৃথিবী, যেখানে বাস করে লক্ষ-কোটি মানুষ। সেসব মানুষের আছে নানা ধর্ম। সনাতন, বৌদ্ধ, খৃষ্ট ও ইসলাম। তার মনে প্রশ্ন জাগল, মুরংদের তো দেবতা আছে। বিশ্বস্রষ্টা থুরাই আছে, পাহাড়ের দেবতা সাংতুং আর নদীর দেবী ওরেং আছে। তবু মুরংদের ধর্মের কোনো নাম নেই কেন?

পোড়াপাড়ায় তখন কোনো স্কুল ছিল না। প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা করতে পারছিলেন না মেনলে। ম্রো ভাষার কোনো বর্ণমালা ছিল না বলে মনের কথা লিখতেও পারতেন না। বান্দরবানের সুয়ালকে যখন স্থাপিত হলো ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়, ভর্তি হতে ছুটে গেলেন মেনলে। তিনি তো তখন পনেরায়, ভর্তির বয়স নেই। যৌক্তিক কারণেই ফিরিয়ে দিলেন হেড মাস্টার টি এন মং। কিন্তু মেনলে ভর্তি না হয়ে যাবেন না, ভর্তি তাকে হতেই হবে। তার শত মিনতি যখন উপেক্ষা করলেন হেড মাস্টার, তিনি তখন অনশনে বসে গেলেন স্কুলের সামনে। দিন যায়, রাত আসে, রাত গিয়ে দিন―তিনি ভাঙেন না অনশন।

কেটে গেল এক সপ্তাহ। এক ফোঁটা জলও নিলেন না মুখে। হেড মাস্টারের অবাক লাগে। পড়াশোনার প্রতি এত প্রবল আগ্রহ! মেনলের জেদের কাছে হার মানতে হয় তাকে, নিতে হয় ভর্তি। পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিলেন মেনলে। কয়েক মাসের মধ্যেই ডবল প্রমোশন পেয়ে ক্লাস টু এবং পরের বছর উঠে গেলেন ফোরে। স্কুলে লেখাপড়া করতে হয় বাংলা বর্ণমালায়। মেনলে ভাবলেন, মুরংরা তো সংখ্যায় এক লাখেরও বেশি, তাদের ভাষাও আছে, অথচ ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে কিনা বাংলায়। কেন? বাংলা তো মুরংদের মাতৃভাষা নয়। মাতৃভাষায় কেন পড়ালেখা করতে পারবে না? এই চিন্তা থেকে ক্লাস ফাইভে উঠে তৈরি শুরু করলেন ম্রো বর্ণমালা। ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনার পর বাড়ি ফিরতে হলো তাকে। আরও পড়ার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। হাইস্কুলটি প্রায় সত্তুর কিলোমিটার দূরে। তাছাড়া তার বয়স তো তখন আঠারো। এই বয়সে তাকে যে ক্লাস সিক্সে ভর্তি নেবে না, তা বুঝে গেলেন তিনি।

গ্রামে ফেরার পর ক্রমশ বদলে যেতে লাগলেন মেনলে। সারাদিন ঘুরে বেড়ান পাহাড়ে গুহায় আর জঙ্গলে। নিজমনে বিড়বিড় করেন সারাক্ষণ। লতাপাতার রস দিয়ে রঙ বানিয়ে ছবি আঁকেন পাথরের ওপর। ফাইভে পড়ার সময় ম্রো ভাষার বর্ণমালা তৈরির যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা শেষ করলেন কুড়ি বছর বয়সে। এক বৃষ্টিভেজা দিনে গ্রামের মাঠে ডাকলেন সমাবেশ। জমায়েত হলো পাঁচ-ছয় হাজার মুরং নারীপুরুষ। মেনলে প্রকাশ করলেন তার আবিষ্কৃত ক্রামা তথা ম্রো বর্ণমালা। হাজার হাজার বছর অপেক্ষার পর নিজস্ব বর্ণমালা পেয়ে ম্রোরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে, বাঁধভাঙা আনন্দে ভেসে যায়। সেদিন বিকেলে মুরংদের তিনি উপহার দেন এক নতুন ধর্ম। ক্রামা ধর্ম। আড়াই ঘন্টা ধরে সবাইকে বোঝালেন ক্রামা ধর্মের রুপরেখা, অনুশাসন ও নীতিবাক্যগুলি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই শুনল তার কথা। দেখল ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন। মেনলের কথা শেষ হওয়ার পর চিৎকার করে কাঁদল। তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল, তুমি মানুষ নও মেনলে, তুমি ঈশ্বরপুত্র। তুমি আমাদের দিয়েছ বর্ণমালা, দিয়েছ ধর্ম। আজ থেকে তুমিই আমাদের অবতার, তুমিই ঈশ্বর ক্রামাদি। তুমি স্বর্গের দেবদূত, আমাদের উদ্ধার করতেই পাঠানো হয়েছে তোমাকে।

প্রায় পাঁচ মাস ধরে বান্দরবানের পাড়ায় পাড়ায় ক্রামা ধর্মের অনুশাসন আর নীতিবাক্য প্রচার করেন মেনলে। বহু মানুষ দীক্ষিত হয় তার ধর্মে। একদিন, এক খাঁখাঁ রোদের দিনে, হঠাৎ তিনি নিখোঁজ। সবাই তো খুঁজে খুঁজে হয়রান। কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেলেন মেনলে? আশেপাশের পাহাড়, গুহা, জঙ্গল কিছুই বাদ রাখল না খুঁজতে। এখনো চলছে সেই খোঁজা। একবার ম্রো জাতির একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আসলে কোথায় গেলেন মেনলে ম্রো?’ তিনি উত্তর দিকে মুখ করে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেছিলেন, ‘হিমালয়।’ আমি বললাম, ‘ঘরবাড়ি ছেড়ে হিমালয়ে কেন?’ তিনি বললেন, ‘ভগবান বুদ্ধ কেন ঘরবাড়ি ছেড়ে অশ্বত্থতলায় গেছিলেন?’ আমি বললাম, ‘আপনি বলতে চাচ্ছেন মেনলে তপস্যা করতে গেছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ বললাম, ‘তিনি কি আদৌ ফিরবেন?’ পুব দিকে আঙুলের ইশারা করে তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই। এদিক থেকে সাদা ঘোড়ায় চড়ে ফিরে আসবেন মহান ক্রামাদি।’

গল্প শেষ হলো। আমরা জানি না মেনলে ম্রো আদৌ ফিরবেন কিনা। ফেরার কথা নয়। তিনি হয়ত হারিয়ে গেছেন। হয়ত স্বেচ্ছায় চলে গেছেন, কিংবা তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। একদিন তাঁর বংশধর ম্রোরা  এভাবেই হারিয়ে যাবে। উন্নয়নের নামে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে করতে একদিন তাদেরকেও ‘নিখোঁজ’ করে দেওয়া হবে। সংখ্যাগুরুরাই শাসন করবে এ দেশ। সংখ্যালঘু কেউ এদেশে থাকতে পারবে না। তাদেরকে থাকতে দেওয়া হবে না। কথা ছিল এই রাষ্ট্র ম্রোদেরকে নিজেদের মতো থাকতে দেবে। ম্রো ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে। ম্রোদের জন্য স্কুল খুলবে, কলেজ খুলবে, বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্রো ভাষায় তারা লেখাপড়া করবে।

হায় ইতিহাস! তুমি কত দুর্বল! কত শক্তিহীন! তোমাকে বারবার ভুলে যায় মানুষ। একদিন যারা নিপীড়িত ছিল, একদিন তারাই হয়ে ওঠে নিপীড়ক―এই হলো তোমার ইতিহাস। চলবে