মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৪৪

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২১

বন্ধু সামসুল আমীনের শেয়ার নেয়া এক ভিডিও ক্লিপ দেখছিলাম। কোথায় এক ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চে উঠে মাওলানা সাহেবের উস্কানিমূলক ওয়াজের প্রতিবাদ করছিলেন স্থানীয় একজন। সম্ভবত তিনি লোকাল পলিটিশিয়ান। শান্তভাবে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে ওয়াজে এভাবে উস্কানি দেয়া ঠিক নয়। হঠাৎ দর্শক-শ্রোতারা হৈচৈ করে উঠল। অতি-উৎসাহী একজন একটা ঢিল ছুড়ে দিল মঞ্চে। আর তখন পলিটিশিয়ান সেই ক্ষেপা ক্ষেপলেন। মাইকে চিৎকার করে গালি দিয়ে ওয়াজ বন্ধের ঘোষণা করলেন। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন কারো সাহস থাকলে সে যেন মঞ্চে আসে। না, কেউ মঞ্চে যাওয়ার সাহস করেনি। মুহূর্তে উত্তেজিত দর্শক-শ্রোতারা ভেজা বেড়ালের মতো চুপসে গেল। বুঝতে পারল, এখানে ‘জেহাদ’ চলবে না, বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখান থেকে কেউ পালাতে পারবে না। হাড়গোড় ভাঙা পড়ারও শঙ্কা আছে।

ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র চালানোর স্বপ্নে বিভোর এই উগ্র ধর্মান্ধরা এমনই। প্রতিরোধের মুখে পড়লেই চুপসে যায়, জেহাদের কথা ভুলে যায়, শেয়ালের মতো লেজ তুলে পালায়। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে মাওলানা মামুনুল হক মাইকে অনলবর্ষী বক্তা হয়ে কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে উত্তেজিত করে তুলছিলেন। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজপথ লাল করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেলেন। রাতে যেই না সাউন্ড গ্রেনেড ফাটা শুরু হলো, মঞ্চ থেকে যে লোকটি সবার আগে পালাল, তার নাম মামুনুল হক। এবং জেহাদের মধ্য দিয়ে সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসা হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্র কান ধরে ঢাকা ছাড়ল।

অর্থাৎ এরা প্রতিরোধকে ভয় পায়। বড় ভয়। সাম্প্রতিক সময়ে তারা চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ তাণ্ডব চালাল, কেউ তাদের প্রতিরোধ করেনি। তারা ভাবে, তাদের গায়ে তো ধর্মীয় পোষাক আছে, হাতে তো ধর্মের ঝাণ্ডা আছে, সুতরাং কেউ তাদের কিছু বলবে না, সবাই তাদের বাহবা দেবে। তারা ভাবে, এ দেশের সব মানুষ তাদের মতো ধর্মান্ধ। ডাক দিলেই সবাই রাস্তায় নেমে পড়বে। ডাক দিলেই ইসলামি হুকুমত কায়েম করে ফেলবে।

এটা যে তাদের কত বড় ভুল, তা তারা পঞ্চাশ বছরেও বোঝেনি। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধার্মিক। ধার্মিক, কিন্তু উগ্র ধর্মান্ধ নয়। অধিকাংশ মানুষ মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। উগ্র ধার্মিক হলে কেউ বিএনপিকে সমর্থন করত না, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করত না, নারী নেতৃত্বকে সমর্থন করত না। কেননা ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম। জিহাদ করে, ভোট দিয়ে পছন্দমতো ইসলামি দলকে তারা ক্ষমতায় বসিয়ে দিত। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে তা হয়নি। ইসলামি দলগুলো কখনোই আঠারোটি আসনের বেশি পায়নি এবং ভবিষ্যতেও পাবে না।

প্রায় সাত বছর পর সরকার এই উগ্রদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে গেল। আজ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উসকানিদাতাদের তালিকা করতে দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে উস্কানিদাতা এক তরুণ ধর্মীয় বক্তাকে। তার মোবাইলে নাকি পর্নোগ্রাফিও পাওয়া গেছে। অথচ এই ছেলেটাই দিনের পর দিন মানুষকে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে সবক দিয়েছে। উগ্র ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমাও হচ্ছে। হেফাজতের বেশ কজন নেতার এবং বেশ কটি মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।

ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের এই অ্যাকশন মৃদু, না ভারী, তা বোঝা যাবে কদিন পর। আমরা আশা করছি সরকার আর আপসের পথে পা বাড়াবে না। নিকোলো ম্যাকায়াভেলির কথাটা গুরুত্বপূর্ণ, ‘শয়তানের সাথে হাত মিলিয়ে কখনো যুদ্ধ এড়ানো যায় না। এভাবে যুদ্ধ এড়াতে হলে শাসকের ভেতর যে যোগ্যতা থাকার প্রয়োজন, সেই যোগ্যতা সবার থাকে না।’

যোগ্যতার সঙ্গে যুদ্ধ কি এড়াতে পেরেছে আওয়ামী লীগ? পারেনি। বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের কথামতো কত কী না করেছে! তাদেরকে কত প্রশ্রয়ই না দিয়েছে! তবু যুদ্ধ এড়াতে পারল না। তারা কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলল, আমরা দেখেছি। তারা কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ম্যুারাল ভাঙচুর করল, আমরা দেখেছি। তারা কীভাবে সংস্কৃতির চিহ্নগুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করল, আমরা দেখেছি। দেশের কয়েকটি জায়াগায় তারা যে সহিংসতা চালাল, আমরা দেখেছি। আওয়ামী লীগ তাদের এত কিছু দিল, তাদের সঙ্গে এত আপস করল, তবু তাদের সমস্ত ক্ষোভ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। কেন তাদের এত ক্ষোভ? মাদ্রাসা ছাত্রদের, যারা একাত্তর দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়েনি, কে তাদের এভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলল? ক্ষুব্ধ করে তুলল একাত্তরের পরাজিত শক্তির বংশধরেরা, পরাজয়ের গ্লানি এখনো যারা ভুলতে পারেনি।

এই কালে ধর্ম দিয়ে যে রাষ্ট্র চলবে না, তা এই উগ্র ধর্মান্ধরা বোঝে না। কীভাবে বুঝবে? তারা তো রাজনীতি বোঝে না, অর্থনীতি বোঝে না, বিজ্ঞান বোঝে না, কূটনীতি বোঝে না, রাষ্ট্রনীতি বোঝে না, সামরিক নীতি বোঝে না। একমাত্র জেহাদ ছাড়া তারা আর কিছু বোঝে না। জেহাদ কী জিনিস, তাও বোঝে কিনা সন্দেহ। তারা ভাবে জেহাদের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ফেললেই ইসলাম কায়েম হয়ে গেল। এত সোজা? পাকিস্তান পারেনি, আফগানিস্তান পারেনি। দেশ দুটি নরক হয়ে উঠেছে। সৌদি আরব, আবুধাবিসহ পৃথিবীর বড় বড় মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ধর্ম থেকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রীতিপূর্ণ উদার ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

বৃটিশরা আমাদের বড় উপকার করে দিয়েছিল আলীয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। আলীয়ার ছাত্ররা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের মতো চাইলেই এত উগ্রতা দেখাতে পারবে না। কারণ আলীয়া মাদ্রাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টা করা জরুরি। কোন কোন দেশ থেকে টাকাপয়সা আসছে, কী উদ্দেশে আসছে, তার খোঁজখবর রাখা দরকার। আয়ের উৎস খতিয়ে দেখা দরকার। সর্বোপরি দরকার কওমি মাদ্রাসার আমূল সংস্কার। নইলে এই ধরনের উগ্র ধর্মান্ধ তৈরি হতেই থাকবে। আর তাদেরকে ব্যবহার করতে থাকবে স্বার্থান্বেষী মহল। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, তারা যে ব্যবহৃত হয়, তা তারা বোঝে না। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করে তোলা পর্যন্ত তারা বুঝবেই না।

মানুষ অবশ্যই ধর্ম পালন করবে। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এবং অপরাপর ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজ নিজ ধর্ম পালন করুক। শান্তিমতো ধর্ম পালন করতে পারা নাগরিকের অধিকার। কিন্তু ধর্মের নামে সহিংসতা যারা করে, তাদেরকে রুখে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আশা করছি সরকার এবার সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে দমন করবে। আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ, উদার ও বহুত্ববাদী বাংলাদেশ চাই।

৭ এপ্রিল ২০২১