মাসুদ পথিকের ৪ কবিতা

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২০

স্বাধীনতা মা

তো, মালজোড়া ঘরের বারান্দায়, রক্তকাঠের চেয়ারে
বসে, হুঁকো টানছেন বাবা

সকালবেলা, চালের উপর এসে বসে গঙ্গাবুড়ি
তার দু`পাড়ে দুটো বনচড়ুই, সঙ্গম বিরহে
করছে কেমন আহাজারি

কাচারি ঘরের জানালার কাছেই আমার পড়ার টেবিল
পাশের বাড়ি থেকে ভোরের বাতাস এসে চেটে যায়
আমার লাজুক গাল, চুল

আমি যৌনতাড়িত হয়ে পড়ি কিছুকাল
শোন পুত, মেয়েটির চলনভঙ্গি বালা না, বলেন মা

কুনাঘরে, ভাত ফুটছে, ভাত
মা আঁচলে মুখ ঢেকে বসে আছেন, চুলোয় পুড়ছে দু`চোখ,
আমারও পোড়ে মন, টগবগ স্বজাতীয় আভিঘাত

বাবা ডাকেন, স্বাধীনতার মা, কই-গো
টিক্কাডা ধরাইয়া দিয়া যাও
হুঁক্কার আগুনডা নিব্বা গেছে...

বাবা ফুঁকেন হুঁকো, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ধুঁয়ো
আমার চুল পেকে যাচ্ছে হাওয়ায়, ক্রমশই
আর তা নিয়ে ঠাট্টা করে পাড়ার মোয়েরা,
স্পেশালি শায়েরি শালিকের ছোট বোন আয়েশা বেগম

মা উঠানে ছড়িয়ে দেন কিছু ভাত,
অনেক ক্ষুধার্ত পাখিরা ছুটে আসে
মা`রও-যে আজও উপোসবার

সামান্য দূর মাঠ, গরুর পিঠে একটা ফিঙে যায় নেচে
তার পিছু আমি দৌড়চ্ছি ভাতের ফেন খাওয়া ফেলে

আর শায়েরি শালিকও উড়ছে কাছাকাছি
আমিও উড়ি, উড়ে উড়ে তারকা হয়ে যাই অনন্তের মাঠে এসে

মা পিছু পিছু ডাকেন, স্বাধীনতা, ও স্বাধীনতা, ও বাপ
আমারে ছাইড়া যাইছ না রে...

প্রকৃত আমার উড়ার নেশাটাই জীবনের অভীষ্ঠ

শস্যদানা, অশ্রুবিন্দু

গোলায় তুলে রাখা শেষ সম্পদ, শস্যদানা। অশ্রু।
অশ্রুবিন্দু বুনছে লৌকিক চাষা
বাক্য চিহ্নিত এই ক্ষেতে, টানা
জৈবসার মিশ্রিত মাটি।

জল জল জল জল জল জল, কেবল।
উঁচুনিচু একটি বাক্যের মতো, অথবা সাপ।

বন্দুক উঁচু করে আছে আলগুলো।
নামছে, বেয়ে চোখের সেতু, শস্য সম্ভাবনা। রক্ত।
কাটা মুণ্ডু পড়ে আছে, বউয়ের।

দূর হিমালয় থেকে আসে, স্রোত।
মনের বরফ গলে যায় শুধু।
মাটির সম্মতি পেয়ে জেগে ওঠে লবণ সংসার।
চোখ, দুটি সন্তান।

গোলা ভরে ওঠে নদীতে। আর সমুদ্র বইছে উঠানে।
সাঁতার কাটে রক্তের সন্তান, অশ্রুবিন্দু।

পাখি আসে, ক্ষুধার্ত। খুঁটে খায় কান্নাগুলো
শস্যদানা ভেবে,
আবহমান জীবনীগ্রন্থ জুড়ে।
বিষয়টা জাদুকরী বা অলৌকিক না।

আমার উপস্থিতি

আর নিয়মের তারতম্য হলেই সত্য ভেঙে যায় না
আমি আমিই থাকি
বরং পাহাড়ের সন্তানগুলো আমার সঙ্গে খেলতে এসে বোরিং হয়

সারাদিন মজুর খাটার পর আমি সন্ধ্যাগুলোও বেঁচে থাকার চিন্তায় কাটাই
ফলে পাহাড়ের সন্তানগুলো খেলার কোনো ভালো সঙ্গী ভাবতে পারে না আমাকে

নদীও আসে, আসে বৃষ্টি চোখ বরাবর
কিন্তু কোনো অবসরই পায় না তারা আমার পৃথিবীতে
যদিও গ্যালাক্সি ও ছায়াপথ জুড়ে আমার আকৃতিও কম নেই

ভাবনার মাঠজুড়ে এই যে প্রান্তর, এখানে সমুদ্র এসে উপস্থিত হয়
আর তিমিগুলি মামা মামা বলে ডেকে করে কাঁধে ওঠার আবদার

তবুও আমাকে ফিরতে হয় করোনার চোখ ফাঁকি দিয়ে
বাড়িঅলার চোখ এড়িয়ে
যাপিত ব্যর্থতার চোরাগলিতে বসবাসকারী কেউ জানে না আমার যোগ্যতাগুলি

তো, আমি সুস্বাদু ব্যাকটেরিয়া হয়ে থেকে যাই শত্রুর জিভের নিচে
আর বউ ও প্রিয়সীর যৌনগন্ধী দেহে
কেননা মন বলে কিছু নেই, এই কথা বিজ্ঞান আবিষ্কারের পর
মেমোরির পাখিরাই গড়ে নিয়েছে এই নগর সভ্যতা

করোনাবিনাশী পাখি

তো, ধান চাষের পর ভয় ও আতংক এই দুটি পতঙ্গ,
অথবা করোনার মতো ঘনীভূত সন্দেহ তাড়াতে
মাঠে ছেড়েছি কোটি কোটি পাখালি

বুকের গোলায় জমানো দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বানিয়েছি
এইসব পতঙ্গবিনাশী পাখি

গহীনে নিহিত দেখি, এখনো, যুদ্ধ অন্তর্গত জাতে-বিজাতে
মাঠে মাঠে বাতাস ভারি হয়ে আসে রক্ত আর অনুতাপে

তবুও, অবাধ শৈশব দেখা যায় গ্রামের সামনে ও পেছনে
শিশু ও যুবকেরা ঘুড়ি উড়ায় কী অবলীলায়!
দীর্ঘশ্বাসের গর্ভে জন্মানো হালিকের পায়ে সুঁতো বেঁধে
ধানগাছ নাড়িয়ে সুঁতোকাটা ঘুড়ির পিছু ছুটে তারা

তথাপি আজও, করি অবলোকন সামান্য দূর থেকে, মাঠ
আর মাঠের এইসব কলরব স্তব্ধ করে দিয়ে
নিষ্ঠুর সন্ধ্যা নেমে আসে পৃথিবীতে

ফলে, ফলের আশাহীন রাত করুণার মতো নীরব ঘাতক
সময় খুব অসহায়, আর একা। একা।