মাহবুব মোর্শেদ

মাহবুব মোর্শেদ

মাহবুব মোর্শেদের গল্প ‘জাম্বুরা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১

নে তোর ভাবির সাথে কথা বল।
আমাকে হ্যালো বলার সুযোগটুকুও না দিয়ে ফোনটা রুমানাকে ধরিয়ে দেয় মঞ্জুর। রুমানা ঠোঁটকাটা মেয়ে। একইসঙ্গে হাসি, কথা আর ঠেস মারতে ওস্তাদ। মনে মনে ওকে আমি খলবলি বলে ডাকি। আর কেউ জানে না, গোপনে আমি ওর একটা নাম দিয়েছি। শব্দটার মানে অবশ্য আমি এখনও জানি না। তবে রুমানার কথা শুনলে এই শব্দটাই মনে হয় সবার আগে।

ফোন ধরেই রুমানা খলবল করে বলতে শুরু করে, ভাই তো মনে হয় আমাদের কথা ভুলেই গেছেন। ফোন করার সময় তো পানই না। ধরার সময়ও মনে হয় নাই। কয়দিন ধরে আপনার দোস্ত ফোন দিয়েই যাইতেছে ধরারও সময়ও পাইতেছেন না দেখি।
‌আসলে হইছে কী ভাবি...
আসলে কী হইছে সেটা তো আমরা ভালো করেই জানি। আপনি ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। দোকানের ছেলেটার জ্বর। করোনার মধ্যে বেচাবিক্রি তেমন নাই। মনমেজাজ খারাপ। এই তো? এইগুলার বাইরে কিছু থাকলে বলেন। বছরে তো আমাদের এইদিকে তো আসেন এই একবারই। গতবছর আসেন নাই করোনার দোহাই দিয়ে। এবার দেখি ফোনও ধরেন না। সেদিন গাছে শেষ চারটা জাম্বুরা দেখে আপনার কথা মনে পড়লো। মঞ্জুরকে বললাম, তোমার দোস্তকে ফোন দিয়া দেখো। নিজে থেকে মনে হয় এবারও আসবে না। ফোন না দিলে দেখবা তালে তালে ঠিকই ফাঁকি দিছে। ফিসফাস করে বলে, ভাই কি দোকানে না বাসায়?
দোকানে ভাবি।

দেখেন, আপনার দোস্ত আমারে ইশারায় না করে। বলেই হিহি করে হাসে রুমানা। আচ্ছা মকসুদ ভাই, ঠিক করে বলেন তো মানিকগঞ্জ আসতে চাইলে কি ভাবি মানা করে?

দোস্তর বাড়ি গেলে বউ মানা করবে কেন? আসলে হইছে কি ভাবি... আপনি বিশ্বাস করবেন না তবু বলি, এর মধ্যে মেলা কাহিনির মধ্য দিয়া গেলাম আসলে। সব কথা তো ফোনে বলা যায় না।

হ ভাই, ফোনে বলাও ঠিক না। কিন্তু যত সমস্যায় থাকেন দোস্তর ফোনটা তো ধরতেই পারতেন। আমরা তো কোনো বিপদেও পড়তে পারতাম। অসুখ-বিসুখ হলে লাগে না বন্ধু-বান্ধবের হেল্প? আপনারা না ছোটেকালের বন্ধু।

আমি একদম নাজেহাল হয়ে যাই। মুখে কিছু আসে না। একটু হু করি শুধু।
ভাই, সামনের শুক্রবার ভাবিকে নিয়ে চলে আসেন। সকাল সকাল আসবেন। ঘুম থেকে উঠে বাসে উঠবেন। এইখানে এসে সকালের নাস্তা মুখে দিবেন। সকালে ছিটা রুটি করবো, সাথে গরুর মাংসের ঝোল। ঝোলে ভিজায়ে ভিজায়ে সকালের রোদে বইসা দুই বন্ধু ছিটা রুটি খাবেন।

সকালের নাস্তা মনে হয় করা হবে না, ভাববি। নওরীন ঘুম থেকে দেরিতে ওঠে তো।
সকালের নাস্তা তাহলে বাদ। আপনারা জুম্মার আগে আসেন। আপনারা আসলেই গাছ থেকে পাকা জাম্বুরা পেড়ে শুকনা মরিচ, লবণ আর খাঁটি সরিষার তেল মাখায়ে দেব। আপনি যে তৃপ্তি নিয়া জাম্বুরা খান। খালি তাকায়ে দেখতে ইচ্ছা করে। দুপুরে খাবেন দেশি মুরগীর মাংস। ছোট ছোট আলু দিয়ে ঝোল ঝোল রান্না করবো মাটির চুলায়। সাভারে তো এইগুলা কিছু পান না।
জ্বি ভাবি।

কোনো তালবাহানা কিন্তু চলবে না, মকসুদ ভাই। প্রোগ্রাম ফাইনাল।
জ্বি ভাবি।

ফোন রাখার পর আমি পস্তাতে থাকি। তিন দিন ধরে মঞ্জুরের ফোন ধরছি না। আজও না ধরলেই হতো। হঠাৎ কী মনে করে যে ধরলাম। ধরেই ধরাটা খেয়ে গেলাম। আমি তো জানতামই ওরা এই সময়ে কেন ফোন দিয়েছে।

গত বছর করোনার দোহাই দিয়ে বিষয়টা এড়ানো গেছে। গত বর্ষার শুরুতে জাম্বুরা গাছে ফুল আসার পরপরই মঞ্জুর ফোন দিয়েছিল।

দোস্ত, আজকে তোর কথা মনে পড়তেছে খুব। জাম্বুরা গাছগুলো ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করতেছে। বৃষ্টির হইতেছে আর মনে হইতেছে ফুলের গন্ধ নিয়া পানি মাটিতে পড়তেছে। সারা বাড়ি মনে হয় জাম্বুরার গন্ধে ভরপুর হয়ে গেছে। তোর না এই গন্ধটা খুব পছন্দ। আসবি নাকি একবার। বৃষ্টির মধ্যে আয়, এক বেলা কাটায়ে যা।

আমি খেপে যাই। ব্যাটা, জাম্বুরা ফুলের গন্ধ নিতে এই করোনার মধ্যে আমি সাভার থেকে মানিকগঞ্জ যাব? আমার কি সেই আগের দিন আছে? ঘরে নতুন বউ। আমি সারাদিন থাকি ব্যবসাপাতি নিয়া সাভার বাজারে। চারদিকে জ্বরজারি। দেখা গেল, করোনার জীবাণু দিয়া আসছি তোদের। শোন, তোরাও একদম বাইরে যাবি না। খুব খারাপ অসুখ, বুঝলি।

মঞ্জুর বোঝে। বলে ঠিকই কইছিস দোস্ত। কী একটা অসুখ আইলো দুনিয়ায়।
সপ্তাহ দুই পর আবার ফোন দেয় মঞ্জুর। জাম্বুরা কিন্তু বেশ হইছে দোস্ত। ছোট ছোট জাম্বুরা থেকে ফুল ঝরা শুরু হইছে। তুই বিশ্বাস করবি না। সব কটা গাছ জাম্বুরায় হলফল করে উঠছে। পাতায় কী মিষ্টি গন্ধ রে।
আমার একটু লোভ হয়।
দোস্ত, ছবি পাঠা তো।

মঞ্জুর খুশি হয়। জাম্বুরার পেছনে তখনও গর্ভফুল লেগে আছে। ছবি দেখে মনে হয় গন্ধটাও যেন পাচ্ছি আমি। মনের অজান্তেই গভীরভাবে নিঃশ্বাস নেই। আচমকা বুকের ভেতরে জাম্বুরার এক পশলা গন্ধ ঢুকে পড়ে।
ওরে আবার কল দেই। দোস্ত, গাছে তো জায়গা নাই দেখি। এত জাম্বুরা তোরা খাবি কেমনে?
তুই কি আসবি না?
দেখি, করোনা কোন দিকে যায়। আমি না হয় দুইটা খাইলাম। কিন্তু বাকিগুলো?
এবার মনে হয় বিক্রি করা লাগবে রে।

আবার দুই সপ্তাহ পর মঞ্জুর ফোন দেয়, দোস্ত জাম্বুরা তো ডাসা হয়ে উঠলো। তুই কি আসবি? আসলে কিন্তু সেপ্টেম্বর পার করিস না।
কেমনে আসবো দোস্ত। দেখিস না কত লোক মরতেছে প্রতিদিন। চারদিকে ভাইরাস। এইবার মনে হয় আর হবে না।

আগস্ট যায়, সেপ্টেম্বর যায়। আমি কল্পনা করি, মঞ্জুরদের বাড়ির জাম্বুরা গাছের ডালগুলো পাকা জাম্বুরার ভারে নুইয়ে পড়েছে। গাছের তলায় গেলে জাম্বুরার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মঞ্জুর আর রুমানা প্রতিদিন একটা করে জাম্বুরা খাচ্ছে আর আমার কথা আলোচনা করছে।

আহারে মকসুদ ভাইটা থাকলে কী রকম চোখ বড় বড় করে জাম্বুরা যে খাইতো। শুকনা পোড়া মরিচের ঝালে চোখ দিয়া পানি পড়তো। এমন তৃপ্তি কইরা খায় গো।

রুমানাকে কথা দেয়ার পর নওরীনকে মানিকগঞ্জ যাবার বিষয়টা বলা ঠিক হবে কি না সেটা মনে মনে ভাবি আমি। জাম্বুরা খেতে মানিকগঞ্জ যাবার আইডিয়াটা কেমন? ভেবে নিজের মনেই কোনো জোর পাই না। নওরীন শুনলে কী বলবে ভেবে খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যাই। দুইদিন ভাবতে ভাবতে হুট করে বলি, মানিকগঞ্জ যাবা নাকি শুক্রবার, জাম্বুরা খাইতে?

নওরীন অবাক হয়ে আামার দিকে তাকায়, কী বলো?
না। মঞ্জুর ওইদিন ফোন দিয়ে বললো, আগে তো প্রতিবছর জাম্বুরার মৌসুমে আমাদের বাড়ি আসতি। এবার ভাবিকে নিয়ে আয় না। একটা দিন কাটায়ে যা।
তুমি প্রতি বছর জাম্বুরা খাইতে যাইতা? কই আমারে তো কোনোদিন বলো নাই।

যাইতাম মানে, ওই আর কি। মানিকগঞ্জে থাকতো না আব্বা। আমার স্কুল-কলেজ তো ওইখানেই। মঞ্জুর সেই থেকে বন্ধু। ছোটবেলা মঞ্জুরদের বাড়িতে কত যাইতাম। জাম্বুরা গাছে উইঠা আমি আর মঞ্জুর জাম্বুরা পাড়তাম। বুঝলা নওরীন, জাম্বুর ফুলের গন্ধটা আমার এত ভাল লাগে। আর বৃষ্টির মধ্যে জাম্বুরা গাছের পাতাগুলা হলফল করে এমন একটা গন্ধ ছড়ায়। তুমি নিজে না দেখলে বিশ্বাস করবা না।

কোনোদিন তো বলো নাই জাম্বুরা তোমার এত ভাল লাগে? আমাদের বাড়িতে তো তিনটা গাছ। কোনোদিন তো দেখলাম না একবার গাছগুলার দিকে তাকাইতে।

আমি নওরীনের দিকে বোকার মতো তাকাই। হইছে কী নওরীন। এইটা আসলে একটা উপলক্ষ বলতে পারো। প্রতিবছর যাইতাম তো। মঞ্জুরও প্রতিবছর নিয়ম করে ফোন দেয়। যাইতে যাইতে মনে হয় অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে।
তুমি আমার নাম ধরে ডাকতেছো। তুমি তো নাম ধরে ডাকো না। কী হইছে তোমার?
ওহ, সরি। বলে চুপ করে থাকি আমি একটু।

শোনো তোমাদের বাড়ির জাম্বুরা গাছগুলা কিন্তু আমি ভাল করেই খেয়াল করছি। তুমি মনে হয় বোঝো নাই। আসলে কী জানো, জাম্বুরা তো একটা উপলক্ষ। মনে করো, এই উপলক্ষে মানিকগঞ্জ বেড়ানো হইলো। রুমানা ভাবি ভালো রান্না করে। দেশি মুরগীর ঝোল খুব ভালো পারে।
কেন, আমি দেশি মুরগী ভালো পারি না?
তোমারটা তো অসাধারণ। কিন্তু ভাবি মাটির চুলায় কাঠে রান্না করে তো। মুরগীর মাংস থেকে থেকে ধোঁয়া ধোঁয়া একটা গন্ধ ওঠে। ওই জিনিশটা বুঝলা, গ্যাসের রান্নায় আসে না।

রুমানা ভাবীকে যে তোমার এত পছন্দ সেটা তো কোনোদিন বলো নাই। আমাদের বিয়েতে আসছিল?
আসছিল তো। লম্বা-চওড়া মহিলা। মঞ্জুরের পাশে দাঁড়ানো ছিল একটা ছবিতে। লাল একটা কাতান শাড়ি পইরা আসছিল।
ভাবির শাড়ির রঙও দেখি মনে রাখছো। কোনটা রুমানা ভাবী দেখাইও তো।
ফেসবুকে আছে তো।
তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে?
থাকবে না?
ভাবির সাথে চ্যাটও করো নাকি মাঝে মাঝে?
জিনিশটা অন্যদিকে যাচ্ছে দেখে আমি রুমানার ব্যাপারে একটা নেগেটিভ ভাইব দেওয়ার চেষ্টা করি।
রুমানা ভাবি বুঝলা একটু মফস্বলি আছে। গ্রামে থাকে তো।

নওরীন বলে, তাতেই যা দেখতেছি। স্মার্ট হলে তো তোমাকে খুঁজেই পাওয়া যাইতো না। জাম্বুরার ফুল আসলে মানিকগঞ্জ ছুটতা। জাম্বুরা একটু বড় হলে ছুটতা। পাকলে ছুটতা।
আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
নওরীন বলে, ভাবি কি সুন্দরী নাকি খুব?

আমি উত্তর না দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। পেছন থেকে নওরীন বলে, টেনশন নিও না। আজকেই আম্মারে বলতেছি, তোমার জামাই জাম্বুরা খাওয়ার জন্য পাগল হইছে। আমাদের গাছের জাম্বুরা খেলে আর ভুলতে পারবা না। পাকা মরিচ পুড়িয়ে সরিষার তেল মেখে খেতে দিবো। দেইখো।

নওরীনের সঙ্গে এইসব কথাবার্তার পর জাম্বুরা নিয়ে আমার সব আগ্রহ উবে যায়। সেদিনই নওরীনদের বাড়ি থেকে জাম্বুরা আসে। আগ্রহ আর বিস্ময় নিয়ে সেগুলো খেতেও হয় আমাকে। কিন্তু স্বাদটা তেঁতো। মনে হলো জাম্বুরার বিচিগুলো ঠিক মতো আলাদা করে নাই। জাম্বুরা বিচি খুব তিতা।

মাটির চুলায় রান্না করা মুরগীর মাংসও এসেছিল জাম্বুরার সঙ্গে। শ্বশুর বাড়ি থেকে জাম্বুরা আর মুরগীর মাংস চেয়ে এনে খাচ্ছি। শাশুড়ি কী মনে করলো ভেবে আমি লজ্জায় সিঁটিয়ে যাই। এইসব ঘটনা রুমানা বা মঞ্জুরকে বলা যায় না। ওরা শুনলেই বা কী মনে করবে। হয়তো আমার বলাতেই কোনো ভুল হয়েছে। অন্যভাবে বললেও পারতাম। কীভাবে বললে নওরীন বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতো সেটা আমি ভাবতে থাকি।

কিন্তু এটা তো সত্যি জাম্বুরা খেতে প্রতিবছর ঘটা করে মানিকগঞ্জ যাবার আইডিয়াটা ঠিক জুতের না। এমনও না যে জাম্বুরা খুব একটা দামি ফল। সাভার বাজারেই কত লোক জাম্বুরা বেচে। ত্রিশ-চল্লিশের বেশি দাম ওঠে না। মাঝে মাঝে তো বিশেও পাওয়া যায়।

আসলে জাম্বুরা বিষয়ও না সেইভাবে দেখলে। বছরে একবার মানিকগঞ্জ গেলে দুই বন্ধুর দেখা হয়। রিলেশন তো একরকম আলগাই হয়ে গিয়েছিল। আব্বা সাভারে পাকাপাকি চলে আসার পর আর তো মানিকগঞ্জ যাওয়া হয় নাই। মঞ্জুরও কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। পরে মঞ্জুরের বিয়ে উপলক্ষে আবার যোগাযোগ হলো। কোথায় জানি শুনেছিল সাভার বাজারে আমার কাপড়ের দোকান। সোজা বাজারে এসে খোঁজ লাগিয়ে আমাকে বের করেছিল। খলবলি হলেও রুমানা খুব অতিথিপরায়ণ। গেলে সারা বাড়ি মাথায় করে এমন যত্ন করা শুরু করে। মঞ্জুরও কাছ ছাড়ে না। সারাদিন স্কুল-কলেজের পুরনো দিনের গল্প চলতে থাকে দুই বন্ধুর।

নওরীনের বৈরী মনোভাবের কথা ওদের বলা যায় না। মঞ্জুর যদি শোনে, রুমানাকে নওরীন সহ্য করতে পারে না তাহলে অবাক হয়ে যাবে। ভাববে আমি রুমানাকে নিয়ে নেগেটিভ কোনো ধারণা দিয়েছি নওরীনকে। গত বছর করোনার ভয়টা খুব জেনুইন ছিল। এবারও দেওয়া যেত। কিন্তু করোনার ভয় হরেদরে সবারই কেটে গেছে। করোনার কথা বললে, মঞ্জুর হাসবে। কিন্তু নওরীন যে জাম্বুরা খেতে মানিকগঞ্জ যাবার আইডিয়াটা ভালভাবে নাও নিতে পারে সে ধারণা মনের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে আগেই আমার তৈরি হয়েছিল। তাই মঞ্জুরের ফোন ধরবো না বলে ঠিক করেছিলাম এবার। কয়দিন তো ধরলামও না। সেটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ধরেই বিপদ হয়ে গেল। ধরলাম তো ধরলাম। বউসহ শুক্রবার মানিকগঞ্জ যাবো বলে কথাও দিয়ে ফেললাম। না গেলে ওরা খুব মাইন্ড করবে।

হুট করে একটা অজুহাত অবশ্য দাঁড় করানো যায়। একটা ফোন দিয়ে মঞ্জুরকে বলা যায়, দোস্ত আমি তো জানতাম না যে শুক্রবার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত। নওরীনকে বলছিল, কিন্তু নওরীন আমাকে বলতে ভুলে গেছে। কাল রাতে হুট করে বলে শুক্রবার কিন্তু আম্মার বাড়ি যাবো। বল তো কী করি?

মঞ্জুর মেনে নেবে সহজে। রুমানা মানবে না। ছাই দিয়ে ধরবে। খুব ভালো কাজ হবে না। তবু অপশনগুলো মনে মনে ভাবতে থাকি।
নওরীনকে আবার বলা যায়।

গতবার যাইনি বলে মঞ্জুর খুব মাইন্ড করছে, বুঝলা। আজকে আবার ফোন দিয়ে বললো, তুই না আসলে বন্ধুত্ব কিন্তু এখানেই শেষ। যাবা নাকি শুক্রবার? সকালে গিয়ে বিকালে ফিরে আসবো। তোমার মনে হয় ভাল লাগবে। করোনার মধ্যে তো কোথাও যাও না তো কতদিন। সাভারে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছো না?

নওরীনকে আবার এইসব বলার কথা চিন্তা করতেই আমি ঘেমে উঠি। নওরীনের মনোভাব তো একরকম জানা হয়ে গিয়েছে। সে যাবে না। আমাকেও যেতে দেবে না। আমার জাম্বুরা আর দেশী মুরগীর ঝোল খাওয়ার ইচ্ছা নওরীন নিজস্ব আয়োজনে পূরণ করে সে মেসেজ দিয়ে ফেলেছে।

নওরীনকে না বলে ফেললে একা একা মানিকগঞ্জ যেতে পারতাম শুক্রবার। বলতাম, ইসলামপুর যাচ্ছি। নতুন মাল আসছে।

আমাকে একা দেখে রুমানা হয়তো অবাক হয়ে যেত। ভাবিকে তাইলে আনতে পারলেন না। আপনাকে সেদিন তো জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের এখানে আসাটা ভাবি কি অপছন্দ করে নাকি। আপনি তো মুখ খুললেন না। এখন তো দেখছি ঠিকই। বুঝছো মঞ্জুর, আমি তোমারে কইছিলাম না?

পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমি হয়তো বলবো, আসলে হইছে কী ভাবি... কাল রাত পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। মেলাদিন পর ঘুরতে যাবে বলে নওরীনও খুব খুশি ছিল। কিন্তু সকালে উঠে এমন মাথা ধরছে। আমাকে জোর করে পাঠালো। বলে, কথা দিছো যখন তুমি একা যাও। ওনারা কত আয়োজন করছে। কেউ না গেলে কেমন দেখায়।

কিন্তু এখন আর নওরীনকে মিথ্যা বলে মানিকগঞ্জ যাওয়া সম্ভব নয়। শুক্রবার ইসলামপুর যাবার কথা শুনলেই বলবে, ইসলামপুর না মানিকগঞ্জ? ইসলামপুরের কথা বইলা মানিকগঞ্জ গিয়ে জাম্বুরা খেয়ে আসবা, তাই না? আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, আসলেই কি জাম্বুরা খাইতে যাবা, নাকি অন্যকিছু?

ভাবতে ভাবতে আমিও মনে মনে চিন্তা করি, আসলে ঘটনাটা কী? জাম্বুরা খেতে মানিকগঞ্জ যাওয়ার আইডিয়াটা উদ্ভট মনে হয় আমার কাছেও। কিন্তু এতদিন বিষয়টা এইভাবে মাথায় খেলে নাই। নওরীন বলতে গেলে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। মঞ্জুরের বিয়ের পর প্রতিবছর যে জাম্বুরার মৌসুমে আমি মানিকগঞ্জ চলে যেতাম তার ভেতরের কারণ কী? রুমানার প্রতি কোনো দূরবর্তী আকর্ষণ কি আমার মনে কাজ করে? হয়তো আমিও জানি না। কিন্তু নওরীনের সিক্সথ সেন্সে বিষয়টা হয়তো ঠিকই ধরা পড়েছে। পুরাতন বন্ধুত্ব, গরুর মাংসের সঙ্গে ছিটা রুটি, শুকনো মরিচ লবণ আর খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে জাম্বুরা মাখানো, ছোট ছোট আলু দিয়ে মাটির চুলায় রান্না করা দেশী মুরগীর ঝোল এইগুলো হয়তো যে অজুহাত। হয়তো প্রতিবছর একবার রুমানাকে দেখতেই আমি মানিকগঞ্জ যেতাম। কিন্তু বছরে একবারই কেন?

শুক্রবার সারাদিন ফোন বন্ধ করে ঘুমাই আমি। মঞ্জুর আর রুমানা কতবার আমাকে ফোনে ট্রাই করছে সেটা ভাবি। একটা অজানা টেনশনে আমার চোখে ঘুম চলে আসে। তলপেটে কেমন চিন চিনে ব্যথা শুরু হয়। আর সারাদিন ধরে বৃষ্টি হয়। ঝমঝম ঝমঝম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি। স্কুল থেকে ফিরে আমি আর মঞ্জুর জাম্বুরা গাছের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছি। জাম্বুরা গাছে ফুল এসেছে। সেই ফুল ধোয়া গন্ধভরা পানি আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। কী রকম টকমিষ্টি লেবুপাতার গন্ধ। ওইসময় মঞ্জুরদের ঘর থেকে কে যেন ডাক দেয়, তোমরা অযথা ভিজতেছো কেন?

কণ্ঠটা রুমানার মতো। রুমানাকে দেখা গেল না। কিন্তু মনে হলো, বড় বয়সের রুমানা আমাকে আর মঞ্জুরকে ডাকছে। ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নওরীন।

তোমার কি শরীর খারাপ? নাকি মানিকগঞ্জ যাইতে না পেরে মন খারাপ? তুমি একাও তো যাইতে পারতা। এমনে মন খারাপ করে ঘুমানোর মানে আছে?

আমি কোনো কথা না বলে শুয়ে থাকি।
দুপুরে খাবা না? চারটা বেজে গেল। আজকে নিজের হাতে দেশি মুরগী রাঁধছি। গোসল সেরে আসো, খাবা।

শনিবারও ফোন বন্ধ করে রাখি। দিনটা ঢিমেতেতালায় কেটে যায়। ভেতরে ভেতরে একটা রাগ জমা হতে থাকে। রোববার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নওরীনকে বলি, আজকে ইসলামপুর যাব, মাল আনতে।

আমার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে নওরীন আর কিছু বলে না। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে মানিকগঞ্জের বাসে উঠে পড়ি আমি। মঞ্জুরদের বাড়িতে যখন পৌঁছালাম তখন আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। কাউকে না ডেকে উঠানের জাম্বুরা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেক সময়। গাছের ঘন পাতার দিকে চোখ। বৃষ্টি আমার চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। কখন যে রুমানা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। পিঠে আলতো স্পর্শ পেয়ে আমি চমকে উঠি।
রুমানা খিলখিল করে হেসে ওঠে।
ঠাডা পইড়া মরবেন তো। বাদলার মধ্যে এমনে কেউ গাছের তলায় দাঁড়ায়ে থাকে। চলেন, ঘরে চলেন।
আমি নীরবে রুমানার পেছন পেছন ঘরের ভেতর যাই। কোনো কথা বলি না।
তাইলে শেষ পর্যন্ত জাম্বুরার টানে আইসা পড়তে পারলেন?
আমি অস্থির হয়ে যাই। বলি, মঞ্জুর কই।

রুমানা হাসে। বলে, একেবারে ঠিক দিনে আসছেন। আপনার দোস্ত শহরে গেছে সেই সকালে। সকালে রোদ ছিল বলে বের হইছে। এখন দেখেন কেমন আসমান ছাওয়া বর্ষা নামলো। আপনি তো একেবারে ভিজে গেছেন।

আমারে ডাকতে গিয়া আপনিও তো ভিজে গেলেন। বারান্দা থেকে ডাক দিলেই পারতেন।
আপনাকে চমকায়ে দিতে চাইছিলাম। বলে, রুমানা খলবল করে হেসে ওঠে।