মেহেদী হাসানের গল্প ‘সমঝোতা’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : মে ১৪, ২০২৩

আমার সামনে বসা মানুষটা চপচপ করে মুরগির মাংস দিয়ে পোলাও খাচ্ছে। তার গোঁফে মুরগির ঝোল লেগে আছে। তার নাককে নাক না বলে দুই লেনের হাইওয়ে বলাই ভাল। তার দুই লেনের এক লেনের ভেতর থেকে শ্বাস ফেলার সময় একটা বেয়াড়া লোম বেরিয়ে আসছে। আর শ্বাস নেয়ার সাথে সাথে সেটা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। বড় ভুঁড়ি নিয়ে সামনে ঝুঁকে খেতে হচ্ছে বলে কামারের হাঁপরের মতো শ্বাস নিয়ে যাচ্ছে সে।

 

এই লোকটার অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপারে আমার খেয়াল রাখতে হয়। তার ভাল-মন্দ বুঝে চলতে হয়। তার সাথে আমাকে হোটেল র‍্যাডিসন ব্লুতে আসতে হয়েছে। এখানকার `স্পাইস অ্যান্ড রাইস` রেস্টুরেন্টটা তার খুব প্রিয়। পোলাও আর মুরগির মাংস খাওয়ার জন্য কেউ ফাইভ স্টারে আসে? এই লোক আসে। তার সাথে আমাকেও আসতে হয়। তাকে সঙ্গ দেয়া আমার কাজের অন্যতম একটা অংশ। তবে আমার আজকের আসার সাথে অন্যদিনের আসার পার্থক্য আছে।

 

এই ভদ্রলোকের অগাধ টাকা। অনেকের কাছে হয়ত অগাধ মনে নাও হতে পারে। আমার কাছে অগাধ টাকাই মনে হয়। দুই দুইটা প্রাডো গাড়ি, একটা কার, ঢাকা শহরে বনানীর মতো জায়গায় ২১০০ স্কয়ার ফিটের দুইটা ফ্ল্যাট, গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি আছে তার। এক জীবনে মানুষের আর কী চাই? বছরে পরিবারসহ অন্তত দুইবার দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসেন। তার একমাত্র মেয়েটা আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোটই হবে। সেও বিদেশে লেখাপড়া করে। কাজেই তার টাকা আছে। অগাধ টাকা। আমি তার পি,এ। আমি উনার ডায়েরি মেইনটেইন করি, উনার যাবতীয় কাজের ও সময়ের হিসাব রাখি। উনি কিছু ভুলে গেলে মনে করিয়ে দেবার দায়িত্বও আমি পালন করি।

 

সন্ধ্যায় উনি যখন ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে এলিয়ে পড়েন, তখন উনার হুকুমে উনার গ্লাসে রেড ওয়াইনও এই আমিই ঢেলে দিই। উনি রেড ওয়াইন অর্ধেক বোতল শেষ করার পর আমাকে নানারকম ইশারা-ইঙ্গিত দেন। সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকি। কখনও আমার হাত বা কোমর ধরে ফেললে আমি ভদ্রভাবে ছাড়িয়ে নিই। মাঝেমধ্যে উনি কুৎসিত জোকস বলে ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসেন। তখন আমি নির্বিকার হয়ে তার কালো টাকমাথার দিকে তাকিয়ে থাকি। চকচকে টাকের ওপর ইন্টেরিওর ডিজাইনারের সাজিয়ে দিয়ে যাওয়া, মাথার উপরে থাকা ছোট ছোট বাল্বগুলোর আলোর প্রতিচ্ছবি দেখি। আমার নির্বিকার মুখ দেখে উনি বলেন, কী? এটাতে মজা পাওনি? দাঁড়াও, আরেকটা বলি। এটা আরও ডেঞ্জারাস জোক।

 

এরপর উনি আরও কুৎসিত গল্প বলা শুরু করেন। উনি আমাকে প্রায়ই বলেন, অফিসে শাড়ি পড়ে আসতে। আমি সালোয়ার-কামিজ পড়েই আসি। একা রুমের ভেতর চট করে শাড়ি উলটে ফেলতে কতক্ষণ? শুরুর দিকে বুক দুরদুর করত। অনেক ভয় পেতাম। এখন আর পাই না। এই লোক আর যাই হোক, গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মানুষ না। এসব থেকে বাঁচার একটাই উপায়, চাকরি ছেড়ে দেয়া। এই বাজারে আমার মতো সাধারণ সাবজেক্টে মাস্টার্স করা একটা মেয়েকে চল্লিশ হাজার টাকা বেতনে চাকরি কে দেবে? কষ্ট করে সংসার একাই টানতে হচ্ছে। শাহেদের সাথে সংসার শুরু করলাম তাও বছর দুয়েক হয়ে গেল। প্রেমের বিয়ে, তাই বাড়ি থেকেও কোনো রকম সাহায্য পেলাম না। শাহেদের বাবা-মাও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। তাদের সোনার টুকরা পুত্তুরকে যেন এক ডাইনি বুড়ি কেড়ে নিয়েছে।

 

শাহেদ এখনও বেকার। আমার বিশ্বাস ছিল, ওর বিসিএস না হলেও একটা ভালো সরকারি চাকরি ঠিক হয়ে যাবে। কে জানে কেন, হলো না তার চাকরি। সেও বছরখানেক চেষ্টা করেই হাল ছেড়ে দিল। দশ হাজার টাকা বেতনে কোনও একটা ফার্মে জব পেল। দু’দিন গিয়েই ফেরত এলো। এই দুই পয়সার বালের চাকরি নাকি তার পোষাবে না। কাজেই সংসার আমিই চালাই। তার সিগারেট থেকে শুরু করে জামা-কাপড় সবকিছুর টাকার জোগান আমিই দেই। বাড়ি ভাড়া আমি দেই, বিলগুলো আমি দেই। ঈদ-পার্বণে তার বাপ-মায়ের জন্য জামাকাপড়ও এই ডাইনি বুড়িটাই কিনে দেয়। শাহেদ তার বিশাল অবসরে দেশ নিয়ে চিন্তা করে, টিভিতে মন দিয়ে টক শো দেখে। রাতে খাবার টেবিলে আমাকে রাজনীতির জ্ঞান দেয়। দেশ ও দশের কল্যাণের নিমিত্তে তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাগুলি শোনায়। কবিতার ব্যাখ্যাও করে শোনায় কখনও।

 

কোন চাকরি-বাকরি খোঁজ করেছে কিনা জানতে চাইলে ঠোঁট উলটে সিগারেট ধরিয়ে আমার মুখের উপরে ধোঁয়া ছাড়ে। শাশুড়ি মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে বলে, বউ, তুমি কি বাঁঝা নাকি? তোমাদের বাচ্চা হয় না কেন? তুমি ডাক্তার দেখাও। আর কতদিন?

 

আমি হু-হা করে পার করে দিই। শাহেদের একটা কিছু না হওয়া পর্যন্ত আমি কী করে বাচ্চা নিই? সন্ধ্যায় একজনের গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে দিয়ে রাতে এসে বাচ্চা কোলে নেব? সেই বাচ্চাই বা দেখবে কে? বাচ্চার খরচ আসবে কোথায় থেকে? অবশেষে একটা খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি একটা ব্যাংকে শাহেদের ভালো চাকরি হতে পারে। পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকেও টাকা দিয়ে ঢুকতে হয়? আগে জানতাম না। ওদেরই বা দোষ দেব কী করে? দেশে সবাই খাচ্ছে। ওরাই বা কি দোষ করল? সে ঠিক আছে। কিন্তু টাকা পাব কোথায়? উপায়টা শাহেদই বাৎলে দিল। আমাকে বলল, তোমার স্যারের তো অনেক টাকা। তোমাকে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করে! চেয়েই দেখ না!

 

আমি যতই না বলি, শাহেদ ততই জেদ করে। সব কি আর ওকে বলা যায়? বাধ্য হয়ে বলেছিলাম, ঠিক আছে, বলে দেখব।

 

লজ্জার মাথা খেয়ে বলেও ফেললাম। স্যার খুব অনুশোচনা জানালেন। এরপর সরাসরিই এক ঘণ্টা আমার সাথে কাটাতে চাইলেন। আমিও তার সাথে চলে এলাম। টাকাটার খুব দরকার। স্যার খাওয়া শেষ করে এখন মুরগির হাড় চিবোচ্ছেন। আমার দিকে তাকিয়ে একবার বলল, কি, খাচ্ছ না কেন?

 

আমি কোন জবাব না দিয়ে মৃদু হাসি দিলাম। আমি চাচ্ছি সময়টা যেন খুব দ্রুত পার হয়ে যায়। এখানেই রুম ঠিক করা আছে। কেউ দেখবে না। কেউ জানবে না। শুধু টাকাগুলো হলেই শাহেদের ভবিষ্যৎটা নিশ্চিত হয়ে যায়!