রাজাকে হাসতে নেই

সফিক ইসলাম

প্রকাশিত : জুন ২৯, ২০১৯

রাজার নাম ভুমিবল আদুল্যদেজ। ভুমিবল আদুল্যদেজ থাইল্যান্ডের সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত একজন নিঃস্বার্থ ও পরোপকারী মহান রাজা হিসেবে। তাকে থাইল্যান্ডের জাতির পিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একজন বিশাল আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবেও তার পরিচয় সুদৃঢ়, জনগণের কাছে তিনি দেবতুল্য। জীবিতাবস্থায় তিনি বিবেচিত হয়েছিলেন জীবিত বুদ্ধ হিসেবে। তিনি জনদরদী ছিলেন। এমন একজন জনদরদী মহান রাজাকে খ্যাতনামা সাংবাদিক পল এম. হ্যান্ডলে’ আবিষ্কার করেছেন নতুন করে।

হ্যান্ডলের The King Never Smiles বইটি রাজা ভুমিবলের দীর্ঘ জীবনের নিরপেক্ষ এবং পরিপূর্ণ খতিয়ান। ৪৯৯ পৃষ্ঠার বিশালাকৃতির এই বইটিতে রাজার বিস্তৃত জীবনের গল্পের সাথে বাড়তি পাওনা হিসেবে পাওয়া যাবে থাইল্যান্ডের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি থাইল্যান্ডের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাসও।

আজকের থাইল্যান্ড রাষ্ট্রটি সকলের কাছে অতি পরিচিত একটি রাষ্ট্র। পর্যটকদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় রাষ্ট্র এটি। এই আকর্ষণের প্রধান নিয়ামক নিঃসেন্দহে যৌনশিল্প। থাইল্যান্ডের পত্যেয়া শহরকে বলা হয় পৃথিবীর sex capital. প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ থাইল্যান্ড ভ্রমণে যায় যাদের অধিকাংশের প্রধানতম লক্ষ্যই থাকে যৌনবিনোদন। এদের অধিকাংশেরই এই রাষ্ট্রটির ভেতর-বাহির জানার অবকাশ খুব একটা থাকে না।

থাইল্যান্ড নামটি নতুন। আগে এর নাম ছিল সিয়াম বাংলায় যা শ্যামদেশ। সিয়াম শব্দটির মাহাত্মও কম নয়। সিয়াম শব্দটি পালি শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ land of gold (স্বর্ণভূমি)। ১৯৩৯ সালে সিয়াম রাষ্ট্রটির নতুন নাম হয় থাইল্যান্ড। ‘থাই’ শব্দের অর্থ ‘মানুষ’। ফলে থাইল্যান্ড শব্দটির অর্থ দাঁড়াচ্ছে ‘মানুষের দেশ’। ‘থাইল্যান্ড’ শব্দটি নতুন হলেও যে অঞ্চলটি বর্তমানে থাইল্যান্ড নামে পরিচিত তার ইতিহাস, ঐতিহ্য বেশ পুরোনো। এখানকার প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ মানুষই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। থাই সংস্কৃতি অনেকটা স্বতন্ত্র এবং আবদ্ধ। থাইল্যান্ডই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ যা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের উপনিবেশ হয়নি। আগের প্রায় দুই শতাব্দী থাইল্যন্ডে পুরোপুরি রাজতন্ত্র থাকলেও ১৯৩২ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের প্রচলন ঘটে। ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৪৫। এসময়টা ছিল থাইল্যান্ডের ইতিহাসে রাজাবিহীন নানান চড়াই-উৎরাইয়ের সময়।

১৯৪৫ সালে নাটকীয়ভাবে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন ভুমিবল আদুল্যাদেজ। রাজা হিসেবে তাঁর অভিষিক্ত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না, সম্ভাবনাও ছিল না। চাকরি রাজবংশের সপ্তম রাজা প্রজাধিপকের রাজ্য ত্যাগের বছর পাঁচেক আগেই একমাত্র সন্তান মাহিদুল আদুল্যাদেজ মৃত্যুবরণ (১৯২৯ সালে) করেন। আধুনিক, উচ্চশিক্ষিত ও রূচিবান মানুষ হিসেবে মাহিদুল আদুল্যাদেজের সুনাম ছিল। তাঁকে থাইল্যান্ডের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু থাই-রাজপরিবারকে অনেকটা অভিভাকশূন্য করে তোলে। ১৯২৯ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মাহিদুল যখন মারা যান তখন বড় ছেলে আনন্দ মাহিদুলের বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর আর ছোটো ছেলে ভুমিবলের বয়স মাত্র দেড় বছর। ছোটোবেলা থেকেই আনন্দর শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না; প্রায়ই অসুস্থ থাকতো সে, পড়ালেখায়ও কোনো উৎসাহ ছিলনা তার। তথাপি রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে বড় ভাই আনন্দ মাহিদুলই ছিলেন অগ্রণী। কাজেই আনন্দ মাহিদুলেরই রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার কথা। স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ১৯৩৫ সালে আনন্দ রাজা হিসেবে মনোনয়নলাভ করেন, তবে শিক্ষার্জনের জন্য বিদেশে থাকায় সে সময়ে তাঁর রাজমুকুট পড়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৪৫ সালে আনন্দ মাহিদুল দেশে ফিরে আসেন। রাজা হিসেবে তাঁর অভিষিক্ত হওয়ার পথ মুক্ত। কিন্তু নিজের বেডরুমে পিস্তলের গুলিতে নিহত হন আনন্দ মাহিদুল। যে পিস্তলের গুলিতে নিহত হন আনন্দ, সেই পিস্তল কেবল দুজনের কাছেই ছিল। একজন আনন্দ মাহিদুল আর অপরজন ভুমিবল আদুল্যদেজ।

আনন্দ মাহিদুল আত্মহত্যা করেছেন, নাকি অন্য কেউ তাঁকে হত্যা করেছে সে মীমাংসা হয়নি, ভবিষ্যতে হবে এমন সম্ভাবনাও কম। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পরে তড়িঘড়ি করে রাজা হিসেবে ভূমিবলের অভিষেক, এবং অতপর অন্য সকল রাজকীয় হত্যাকাণ্ডের মতোই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে মূলধন করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জব্দ করার কৌশল যেকোনো উৎসুক মানুষকে এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে সন্দেহবাদী করে তুলবে। তবে আনন্দর মৃত্যুর পরিপূর্ণ সুবিধাভোগী যে ভুমিবল নিজে সে বিষয়ে কোনো সংশয়ই নেই। কারণ এই মৃত্যুর মধ্য দিয়েই ভুমিবলের রাজ্যাভিষেকের পথ সুগম হয়।

ভুমিবলের জন্ম আমেরিকায় এবং শিক্ষা জীবনের শুরু সুইজারল্যন্ডে। ছোটোবেলা থেকেই ভুমিবল ছিলেন সুস্বাস্থের অধিকারী, পড়ালেখার প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। ভুমিবল ছিলেন একজন চমৎকার সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর, ক্রিড়াবিদ এবং নাবিক। কিন্তু রাজ্যাভিষেকের পর থেকে এমন একজন উচ্ছল, ক্রিড়াপ্রেমী, সঙ্গীতপাগল বহুমুখী প্রতীভার মানুষের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখাটি পর্যন্ত কেউ দেখেনি কখনও তা বড়ই আশ্চর্যের ঘটনা।

The King never Smiles গ্রন্থের রাজা ভুমিবল অতিমানবীয় কোনো চরিত্র নয়, নয় দেবতুল্য কোনো অলৌকিক মানুষও; বরং সম্পূর্ণ রক্ত মাংশে গড়া একজন মানুষ। যার চরিত্রে রয়েছে নানান বৈপরীত্য। যিনি একধারে জনবান্ধব আবার ভীষণ স্বৈরতান্ত্রিক; পরোপকারী আবার দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক, নরম আবার কঠোর, শান্ত কিন্তু দীপ্ত, উদার কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা আবদ্ধ। ২০০৬ সালে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, রাজা হিসেবে তখন ভুমিবল পার করেছের ষাটটি বছর। রাজা এরপরেও বেঁচে ছিলেন আরো প্রায় দশ বছর, সবমিলিয়ে মোট সত্তর বছরের রাজসিক জীবন তাঁর। বলা চলে রাজা হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় পার করা একজন রাজার জীবন ছিল তাঁর।

ভুমিবল আদুল্যাদেজ রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন ১৯৪৬ সালের ৯ই জুন, মাত্র উনিশ বছর বয়সে। রাজ্যাভিষেকের পর থেকে তাঁর পরিচয় কেবল একনিষ্ঠ, কর্মঠ, দায়িত্বশীল, নিয়মানুবর্তী মহান পরোপকারী রাজা হিসেবে। নিহত বড় ভাইয়ের প্রতি তাঁর সম্মান এক মুহূর্তের জন্যও ম্লান হয় নি। নিজের রাজ্যাভিষেকের ঠিক আগে বড় ভাই আনন্দ মাহিদুলকে মরোনোত্তর রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সকল প্রথা পালন করেই তিনি নিজে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। আনন্দ মাহিদুলের প্রতি তাঁর সম্মান জনগণের কাছে দৃশ্যমান করে তোলেন তিনি। তাঁর নামে একটা ফাউন্ডেশন তৈরি করা হয়, আনন্দ মাহিদুল ফাউন্ডেশন। থাইল্যান্ডের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথ সুগম করতে এই ফাউন্ডেশন তৈরি করা হয়। এই ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত স্কলারশিপকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্কলারশিপ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে থাইল্যান্ডের মানুষের মন জয় করার কাজে নিবেদিত হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯৩২ সালে পরম রাজতন্ত্রের বিলোপের পর যে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সূত্রপাত হয় তাতে রাজা কেবল নিছক আচারি রাজা হিসেবেই থাকার কথা। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের তিনটি দায়িত্ব আছে। ‘The first one, he has the right to be consulted, so he has the right to be consulted by the prime minister or by the government. The second right, he has the right to warn; and then he has the right to encourage.’ ভুমিবল এই তিনটি দায়িত্বের প্রতিটির প্রতিই যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। রাজা হিসেবে তার মূল লক্ষ ছিল জনগণ। তিনি ছিলেন for the people but dedicated to poor। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে তিনি ছিলেন প্রতীজ্ঞাদ্ধ। দরিদ্র মানুষের প্রতি তাঁর সমবেদনার প্রকাশ ঘটে বালকবয়সেই। ভূমিবল বলেন, ‘ (বালক বয়সে) যখন আমরা কিছু গ্রহণ করতাম, অর্থ, তখনই আমরা এ থেকে গরীবের জন্য কিছু অংশ রেখে দিতাম। আমরা যদি কোনো অপরাধ বা ভুল কিছু করতাম আমাদেরকে জরিমানা দিতে হতো, তবে তা মায়ের কাছে নয়, বরং গরীবের জন্য রাখা একটি বাক্সে অর্থ সঞ্চয় করে।’ তিনি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে উৎসাহিত করেছেন। সেচ সুবিধার জন্য জলাধার নির্মাণ করেছেন। গ্রামীণ মানুষের কল্যাণের লক্ষে কৃষি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, পানিসম্পদ, যোগাযোগ ও শিক্ষায় প্রায় তিন হাজারেরও বেশি প্রকল্প তিনি নিজের অর্থে সম্পন্ন করেন।

ভুমিবলের অর্থনৈতিক দর্শন নির্মাণে শুম্যাকারের ‘ছোটোই সুন্দর’ (Small Is Beautiful) বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই বইয়ের মূল কথাই ছিল কেবল প্রবৃদ্ধি এবং ব্যয় বিবেচনায় উন্নয়ন যথার্থ নয়, বরং এর পরিবর্তে মানুষের জীবনযাত্রার ক্ষুদ্র কিন্তু টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা এবং স্বাবলম্বী হওয়া। পুঁজিবাদ এবং ভোগবাদীতাকে উৎসাহিত করা আসলে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। খুব ভদ্রভাবে এই শিক্ষার অর্থই হচ্ছো মানুষ জীবনে কঠোর পরিশ্রম করবে এবং খুব কম প্রাপ্তির মাধ্যমেই সুখী হবে এবং এভাবেই রাষ্ট্র বৃহত্তর সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।

অপচয়কে তিনি অপছন্দ করতেন। তা নিজের জন্য হোক, কিংবা অন্য কারো জন্য। সামরিক বাহিনির জেনারেলগণ যখন রাজার জন্য পাঁচ মিলিয়ন বাথ দিয়ে নতুন প্রসাদ বানিয়ে দিতে চাইলেন রাজা তা ফিরিয়ে দিলেন ‘অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা’ বলে। উপরন্তু রাজা সরকারকে জনগণের জন্য ‘অত্যাবশ্যকীয় জিনিস’ এর জন্য, যেমন নিরাশ্রয়ীদের জন্য নতুন বাড়ি তৈরির জন্য, বাজেটে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেন।

জনগণের প্রতি অঙ্গীকার, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং নৈতিক অবস্থান দিয়ে ভুমিবল জনগনের হৃদয়ে তার আসনকে কেবল স্থায়ীই করেনি বরং রাজতন্ত্রকে অনেকটা পাকাপোক্ত করেছে। আপাতদৃষ্টিতে রাজাকে মনে হবে একজন ভীষণ পরোপকারী, জনমুখী ও দরিদ্রবান্ধব রাজা হিসেবে। তিনি নিজের এমন একটি ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যে ‘all politicians are self-serving and corrupt. Only the king can help us.’ জাতির যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে তিনি অভিভাকের দায়িত্ব পালন করেছেন বটেতবে এর আড়ালে রয়েছে রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার প্রতি তাঁর অবিচল অঙ্গীকার। অত্যন্ত নরম সুরে কথা বলেন তিনি ক্ষণিকের জন্যও ভুলে যান নি যে তিনি একজন রাজা।

থাইল্যান্ডের সংবিধান অনুযায়ী সামরিক বাহিনি এবং সরকারি কর্মচারীরা সরাসরি শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করে। একারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনি এবং সরকারি আমলাদের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ রয়েছে। রাজা এই সুযোগকেও কাজে লাগিয়েছেন রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। কেবল রাজতন্ত্রের উপর অগাধ আস্থাশীলতার কারণে নিরঙ্কুশ সমর্থন ও আনুকূল্য পেয়েছে সামরিক বাহিনীর ও সরকারি দুর্নীতিগ্রস্ত পদস্থ কর্মকর্তারা; এর বিপরীতে গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক শক্তিকে প্রতিপক্ষ ভেবে তাদের প্রতি নিষ্ঠুর দমন-পীড়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ দেয়া হয়েছে।

সামরিক বাহিনির সাথে জনগণের যেকোনো আন্দোলনে তিনি সকল পক্ষকেই ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। ‘If unity is not practiced today, there is no tomorrow’ তবে এই ঐক্য অবশ্যই রাজতন্ত্রের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য মেনে নিয়ে। এই প্রশ্নাতীত আনুগত্যের কারণে তিনি প্রায়শই সামরিক বাহিনির পক্ষ নিয়েছেন। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক রাজা একদিকে বলছেন, ‘সামরিক বাহিনি এবং জনগণকে দেশের মঙ্গলের স্বার্থে একত্রে কাজ করতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো সংলাপের মাধ্যমে নিরসন করতে হবে’; আবার অন্যদিকে দুর্নীতিবাজ সামরিক পদস্ত কর্মকর্তারা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাজতন্ত্রের আনুগত্য প্রকাশ করে তখন তিনি আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলেন, ‘সামরিক বাহিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য একটি মহত কাজ করেছেন।’

দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি তাঁর নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের কথা তিনি স্বীকার করেন পরোক্ষভাবে। ১৯৬৭ সালে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘‘If all corrupt persons were executed, there might not be many people left, ... I am at my wit’s end to know how to remedy it.’’ সারিটের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা কারো কাছেই অজানা ছিল না, রাজার কাছেও নয়। কিন্তু রাজতন্ত্রের উপর অগাধ আনুগত্যের কারণে ভুমিবল সারিট এর সামরিক ক্যুকে মেনে নেন এবং তাকে সমর্থনও করেন। সরিটের সকল অপরাধ, দুর্নীতি ও নিষ্ঠুরতা মেনে নিয়েছেন কেবল রাজা ও রাজতন্ত্রের উপর প্রশ্নাতীত আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার কারণে। মৃত্যুর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই জানা গেল তার শতাধিক উপপত্নীর জন্য রাষ্ট্রের ও বৈদেশিক অনুদানের প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ডলার এবং আটহাজার একর সম্পত্তি তসরুপ করেছে। রাষ্ট্রীয় যেকোনো দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে রাজা যেন তাঁর রাজতান্ত্রিক উচ্চাভিলাস এবং ক্ষমতাকেই আরো পাকাপোক্ত করে তোলেন।

আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম, ঘুষ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় যেখানে সরকারি প্রকল্পগুলো অকার্যকর সেখানে রাজার অর্থে পরিচালিত প্রকল্পগুলো সচল এবং সফল। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের কারণে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার দায়ে সরকারের পতন হয়েছে একের পর এক। অন্যদিকে কেবল সফলতার পালঙকটুকু যুক্ত হয়েছে রাজার শিরে। তিনি এমনই একজন মানুষ যিনি নিজে পানিতে নেমেও নিজে না ভিজে থাকতে পেরেছেন, প্রকৃতই নাহোক অন্তত মানুষের কাছে। তাও কম বড় কথা নয়।

থাইল্যান্ডের সংবিধান রাজাকে কার্যত কোনো ক্ষমতা না দিলেও দিয়েছে বাড়াবাড়ি রকমের সম্মান। রাজা সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে। তাঁর সমালোচনা করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেউ এই আইন অমান্য করলে পনের বছর পর্যন্ত কারাদ- হতে পারে। কেবল রাজাই নন, রাজপরিবারের যেকোনো সদস্য, এমনকি রাজপরিবারের পোষ্য পশু নিয়েও কোনো সমালোচনা করা যাবে না। করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল হবে। আর থাইল্যন্ডে এই আইনের প্রয়োগও অত্যন্ত কঠোর। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং কারাদ-ভোগীদের সংখ্যার বিচারে থাইল্যান্ড পৃথিবীর প্রথম। এই আইনে সর্বোচ্চ পয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত কারাদ- দেওয়ার নজিরও স্থাপন করেছে থাইল্যন্ডের অতিউৎসাহী সামরিক আদালত।

২০০৫ সালে রাজা ভূমিবলের জন্মদিনের উৎসবে সমালোচনাকে স্বাগতঃ জানিয়ে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমিও সমালোচিত হতে পারি। সমালোচনার ভয়ে আমি ভীত নই। কেননা, এর ফলে আমি কি ভুল করছি, তা জানতে পারবো। কারণ, আপনি যদি বলেন যে রাজাকে সমালোচনা করা যাবে না, তার মানে হলো - রাজা মানুষ নন। যদি রাজা কোন ভুল না করেন, তাহলে তা দেখতে একবংশীয় হবে এবং রাজা কোনরূপ মনুষ্যচিত কর্মকা- করতে পারবেন না। কিন্তু রাজা ভুল করতে পারেন।’ বলাই বাহুল্য রাজার এ বক্তব্য কেবল কথার কথা। এখনও থাইল্যান্ডে রাজার সমালোচনাকে গর্হিত দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলাই বাহুল্য রাজার সমালোচনা করে প্রকাশিত এই বইটিও তাই থাইল্যান্ডে দণ্ডযোগ্য। প্রকাশের পর থেকে এ বইটি থাইল্যান্ডে নিষিদ্ধ।

রাজা বা রাজতন্ত্রের প্রতি সামান্যতম শৈথিল্যপ্রদর্শন করাকে তিনি সহ্য করতেন না। তা যদি জনপ্রিয়তম কোনো নির্বাচিত নেতার কাছ থেকেও আসে তবেও। যেমনটা ঘটেছে Chatichai সরকারের জন্য। যে চেয়েছিল রাজা থাকবে কেবল আচারি রাজা হিসেবে, তার কোনো নির্বাহী গুরুত্ব ও প্রয়োজন থাকবে না। তাই ভুমিবল Chatichai সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বলেন, ``Nobody can do everything alone. . . . The king at present does not carry the duty to run the country. He has someone else do it.`

পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র এবং কমিউনিজমকে তিনি রাজতন্ত্রের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেন। একারণে তিনি পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের প্রবল বিরোধী ছিলেন। থাই সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে তিনি এই বিরোধীতা করতেন, তবে এর মূলে ছিল রাজানুগত্যতার বিষয়টি। একরাণে কমিউনিস্ট উত্থানের যেকোনো সম্ভাবনাকে তিনি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছেন। শীতল যুদ্ধের সময়ে আমেরিকার কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাবকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন রাজতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করার কাজে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তিনি খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না কখনওই। রাজপুত্র ভজিরালঙ্কম-এর উপস্থিতিতে তামাস্সাত বিশ^বিদ্যালয়ে গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের উপর যে নৃশংসত হত্যাকা- চালানো হয়েছে থাইল্যন্ডের ইতিহাসেই কেবল নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও এমন নজির বিরল। বিশ^বিদ্যালয়ের এই আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে থাইল্যান্ডে বুরোক্রেটিক রাজনীতির শক্তি আরো বাড়তে লাগল। অর্থাৎ সরকারি আমলা ও সামরিক বাহিনির সদস্যরাই রাজনীতির প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে রয়ে গেল।

থাই সংস্কৃতিতে অভিজাত পরিবারের পুরুষদের অবারিত বহুগামীতার উন্মুক্ত। কিন্তু রাজা ভুমিবলের চারিত্রিক শৃঙ্খলা এবং স্ত্রীর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা তাঁকে প্রবাদপ্রতীম পুরুষে পরিণত করেছে। যদিও নিন্দুকেরা দুয়েকটি ঘটনা নিয়ে কানাঘুষা করতে ছাড়ে নি। এর একটি রাজার স্ত্রী সিরিকিত-এর বোনকে নিয়ে, আর অপরটি ১৯৬৫ সালের বিশ্বসুন্দরী Apasara Hongsakul নিয়ে। তবে এ দুটি ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা এতই কম যে তাকে থাই জনগণ খুব একটা আমলে নেয় নি কখনই। থাই জনগণ রাজাকে মহান বলেই জানে।

লেখকের কারিশমা এখানেই যে তিনি থাইল্যান্ডের সাধারণ জনগণের স্বভাব, রুচি, আবেগ এবং রাজার প্রতি প্রশ্নাতীত সম্মানের বাইরে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন একজন প্রচণ্ড স্বৈরাচারী রাজাকে। যিনি ক্ষমতার জন্য বহুবার আতাত করেছেন সামরিক বাহিনির সাথে এবং দুর্নিতিগ্রস্থ আমলাতন্ত্রের সাথে, তাদের সমর্থন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি শতাব্দীকাল টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন একটি মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী চরিত্রের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।

The King Never Smiles বইয়ে এমন একজন রাজার জীবনকাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে যাঁকে মানুষ কখনও হাসতে দেখে নি। এমন নয় যে রাজা ভুমিবল কখনওই হাসেন নি জীবনে, তাঁর মৃত্যুর পরে হাস্যজ্জোল রাজার কিছু ছবি প্রকাশিতও হয়েছে, যদিও সংখ্যায় তা খুবই কম। তবে লেখক এমন একজন রাজাকে আবিষ্কার করেছেন সে নিজে যেমন ছিলেন, তার ভেতরের মানুষটা যেমন ছিল, সবচেয়ে বড় কথা সে নিজেকে যেমন দেখতে চেয়েছিলেন।

যে রাজা কখনও হাসে নি সে এখন গত। ভুমিবল মারা গেছেন ২০১৬ সালের ১৩ ই অক্টোবর। থাইল্যান্ডের সংস্কৃতিতে হাসি মানুষের ইহজাগতিক আনন্দ ও সুখের প্রকাশ মাত্র। রাজা ভুমিবলের এই হাসিবিহীন মুখবয়ব জনগণের কাছে তাঁর আধ্যাত্মিক মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবেই বিবেচিত।

কিন্তু রাজার হাসি কখনও কি শোভন? একজন দায়িত্বশীল রাজা কি কখনও হাসতে পারেন? একজন মানুষকেও অন্নহীন, বস্ত্রহীন, শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন রেখে; একজন মানুষকে আনন্দহীন রেখে রাজা কি আনন্দিত হতে পারেন? একজন মানুষের দুঃখভোগের দায়ও কি রাজা এড়াতে পারেন? এমনকি দ-যোগ্য অপরাধীর অপরাধপ্রবণতা দায়ও কি রাজা এড়াতে পারেন? একজন রাজা যদি দার্শনিক রাজা হন, একজন রাজা যদি জনবান্ধব রাজা হন, একজন রাজা যদি প্রকৃত রাজা হন তবে তিনি কখনও হাস্যোজ্জল থাকতে পারেন না। একজন সত্যিকার রাজাকে হাসতে নেই।

একুশে বইমেলা ২০১৮