রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ২

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

প্রাসাদের বাইরে থেকে হঠাৎ কোলাহলের শব্দ ভেসে আসে। সেনাধ্যক্ষ ব্রাসিডাস এ সময়ে প্রাসাদে প্রবেশ করে ক্রোনাস ও নেস্টরের কানে কানে কথা বলে। নেস্টর সে খবর আবার রাজার কানে পৌছে দেয়। সেনাধ্যক্ষ চলে যায়।

ক্রোনাস: মহীয়সী জেকোনেত্তা, আপনার জন্য একটি চমৎকার সংবাদ রয়েছে। উপস্থিত সকলেই অবগত আছেন যে, গত সপ্তাহে নগরপাল ক্যাফিস যখন বাক্কাসের একটি মন্দির থেকে ধর্মীয় বক্তৃতা শেষে গৃহে ফিরছিলেন, তখন পথিমধ্যে গুপ্তঘাতকের হাতে তিনি নিহত হন। এতদিন ধরে সেই গুপ্তঘাতকের সন্ধান করার পর খানিক পূর্বে ঘাতক সৈন্যবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। সে এখন প্রাসাদের বাইরে সৈন্যদের প্রহরায় রয়েছে।
নেস্টর: মহীয়সী জেকোনেত্তা, আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন এই হত্যাকারীটি কে?
জেকোনেত্তা: কে?
নেস্টর: হা হা হা, জেকোনেত্তা, নিশ্চয় আপনি জানেন, সে কে? না জানবার কারণ নেই আপনার।
জেকোনেত্তা: না, আমি জানি না।

ক্রোনাস: আপনার জ্যেষ্ঠপুত্র ফেরেস। সব রকম প্রমাণপত্রসহ সে ধরা পড়েছে। মৃত নগরপালের হাতের মুঠোয় যে বোতাম পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সেই রকম বোতাম ছিল আপনার জ্যেষ্ঠপুত্রের পোষাকে।
ক্রোনাস:  মহীয়সী জেকোনেত্তা, কথায় কথায় শুধু ক্রাইস্টের নাম উচ্চারণ করছেন, কিন্তু জেসাসের সাথে আপনাদের মিলটা কোথায়? জেসাস ছিলেন সম্পদহীন একজন মহান মানুষ। আর আপনারা সবাই খ্রিষ্টধর্মের রক্ষক হয়ে সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন। জোশুয়া সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন আর আপনারা নিষ্ঠুরতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন।

নেস্টর: নিষ্ঠুরতার এ খেলা বন্ধ করুন জেকোনেত্তা। মানুষ যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় সে সৃষ্টিকে বাঁচতে দিন।
জেকোনেত্তা: মহামান্য, কেন আপনারা নগরপাল ক্যাফিসের জন্য এত দুঃখবোধ করছেন। সে ছিল এক নাস্তিক যুবক। জেসাস ক্রাইস্টের জন্ম সম্পর্কে সে নোংরা মন্তব্য করেছিল। মাতা মেরীর নামে সে কলঙ্ক দিয়েছিল।

নেস্টর: জেকোনেত্তা, মানুষের চিন্তা স্বাধীন। যে কোনো ব্যাপারেই তার স্বাধীন চিন্তা ব্যক্ত করবার অধিকার রয়েছে।
জেকোনেত্তা: প্রিয় নেস্টর, থিউসের সাধারণ জনতা এই মৃত্যুর পক্ষে। মাতা মেরীর গর্ভলাভ সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করে ক্যাফিস থিউসের সকল খ্রিষ্টানদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে। সাধারণ খ্রিষ্টানদের মতামত নেয়া হলে দেখবেন-

হলোফার: সাধারণ লোকরা আপনার মতো নয়। ধর্মকে তারা ভালাবোসে মনপ্রাণ দিয়ে। কিন্তু ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করা তারা কখনোই পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষরা অতটা নিষ্ঠুর নয়। শুধুমাত্র আপনারাই, উস্কানি দিয়ে তাদের নিষ্ঠুর করে তোলেন।
জেকোনেত্তা: রাজা হলোফারনেস, কোনো মানুষ যখন স্রষ্টার বিরুদ্ধে যায়, স্রষ্টার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে অথবা স্রষ্টাকে মানুষের কাছে হাস্যকর করে তুলতে চায় তখন মৃত্যুই তার একমাত্র যোগ্য শাস্তি।

হলোফার: বাহ চমৎকার যুক্তি আপনার। স্রষ্টার দায়িত্ব দেখছি আপনি নিজ হাতে তুলে নিয়েছেন। মহীয়সী জেকোনেত্তা, স্বয়ং স্রষ্টা যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সেই মানুষ যদি স্রষ্টার বিরোধিতা করে থাকে, মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই তাকে শাস্তি প্রদান করার। স্রষ্টা নিজে কি সত্যি এতটাই অক্ষম যে, তার শত্রুর বিচারের ভার মানুষকে নিতে হবে? স্রষ্টা যদি সব জেনে শুনে নিজেই নিজের শত্রুকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠান, তার বিচার করার, সেই সৃষ্টি ধ্বংস করার দায়িত্ব আপনার নয়।

সেনাধ্যক্ষ ও সৈন্যরা বন্দী ফেরেসকে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে।
জেকোনেত্তা: হে পুত্র আমার, তোমাকে এরা যেভাবে হাতে পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে আমার সামনে এনেছে তাতে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মতো একজন বন্দীর কোনোই ক্ষমতা নেই যে, তোমাকে এ অপমানের হাত থেকে রক্ষা করি।

হলোফার: জেকোনেত্তা, থিউসের সাধারণ নিয়মে একজন হত্যাকারীর একমাত্র শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা অভিযুক্তের কথা শুনতে আগ্রহী। ফেরেস, বলো, কেন তুমি নগরপাল ক্যাফিসকে হত্যা করেছিলে? ব্যক্তিগত ক্রোধ কিংবা ধর্মীয় কারণে? (ফেরেসের মুখ সামান্য নড়াচড়া করে) চুপ করে আছ কেন, কথা বলো।

ব্রাসিডাস: মহান রাজা, ওর কথা বলার শক্তি নেই। বন্দী করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধন্বিত সৈন্যরা তার জিহ্বা কেটে নিয়েছে।
জেকোনেত্তা: হায় ঈশ্বর! বুকটা আমার ভেঙে যাচ্ছে। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে!

হলোফার: হীয়সী জেকোনেত্তা, রাজার নির্দেশ ছাড়াই এ ঘটনা ঘটেছে। রাজার নির্দেশ ছাড়াই অতি উৎসাহীরা এমন সব ঘটনা ঘটায় যার দায়দায়িত্ব পরে রাজাকেই বহন করতে হয়।
জেকোনেত্তা: হে ঈশ্বর, আমার পুত্র তোমার ধর্মকে রক্ষা করবার জন্য যে হত্যাকাণ্ড ঘটালো, তার জন্য তাকে তুমি রক্ষা করো।

ক্রোনাস: ময়ীয়সী জেকোনেত্তা, পৃথিবীতে যদি কোনো ঈশ্বর থেকে থাকে সে নিশ্চয় অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে না। আপনার পুত্র একজন হত্যাকারী। সে একজন অপরাধী। বিচারের মুখোমুখী দাঁড়াতে হবে তাকে।
জেকোনেত্তা: মহান রাজা কায়াস হলোফারনেস, কোনো ব্যক্তিগত কারণে নয়; শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই ফেরেস যে ক্যাফিসকে হত্যা করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফেরেসের এই কৃতকর্মের জন্য আমি সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ওর যে দণ্ড সে তো ওর হয়েই গেছে। এবার শুধু ওকে বেঁচে থাকতে দিন।

হলোফার: হ্যাঁ, ফেরেস যা করেছে ধর্মীয় উন্মাদনায় এমন কাজ বহুজনেই করে থাকে। ধর্মীয় উন্মাদনা ব্যাপারটাই খুব খারাপ। বহুরকম রক্তপাত ঘটায়। কিন্তু মহীয়সী জেকোনেত্তা, যা আপনার পুত্র করেছে সে কাজটি খুবই জঘন্য। ধর্মের নামে নির্দয় ভাবে একটি প্রাণকে হত্যা করা!
জেকোনেত্তা: মহান রাজা, আমি কোনো তর্কে যেতে চাই না। আমার পুত্রের অপরাধের জন্য আমি আপনার কাছে করুণা ভিক্ষা করছি। আমার পুত্রকে আমার বুকের সান্ত্বনা হয়ে বাঁচতে দিন। শুধু ভাবুন, এক মা তার পুত্রের হয়ে করুণা ভিক্ষা করছে।
হলোফারনেস কিছুক্ষণ ভাবে।
হলোফার: মান্যবর ক্রোনাস, প্রিয় নেস্টর, মাতা জেকোনেত্তার আবেদনটি কি আমরা বিবেচনা করে দেখতে পারি? যদিও ফেরেসের অপরাধ ক্ষমাহীন তবুও তার জিহ্বার কথা ভেবে আমরা কি তার মৃত্যুদণ্ড রোধ করতে পারি?
ক্রোনাস: মহানুভব, ব্যাপারটাকে এতো সহজ করে দেখবেন না। ফেরেসকে যদি আমরা ক্ষমা করি তাহলে প্রতিটি রাজকর্মচারী এবং সৈন্যবাহিনীর লোকেরা আমাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। নগরপাল ক্যাফিস ছিল, রাজকর্মচারী ও সৈন্যবাহিনীর খুব প্রিয়পাত্র। ক্ষমতায় বসে আপনি যদি রাজকর্মচারী ও সৈন্যবাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চান তাহলে অবশ্য আমার বলার কিছুই নেই।

নেস্টর: মান্যবর ক্রোনাস যা বলেছেন তা খুবই সত্য মহান রাজা। তবে...
হলোফার: তবে?
নেস্টর: ফেরেসকে ক্ষমা করবার একটি মাত্র পথ খোলা আছে। সারা থিউসে একজনই আছে যে ফেরেসকে ক্ষমা করতে পারে। সে যদি ফেরেসকে ক্ষমা করতে রাজি থাকে, তাহলে বাকিরাও সে সিদ্ধান্ত নির্বিবাদে মেনে নেবে।
হলোফার: নেস্টর, তুমি কার কথা বলতে চাইছো স্পষ্ট করে বলো। তার নামটা অন্তত আমাদের জানা দরকার। বলো, কে সে?
নেস্টর: দিউনাসাস মন্দিরের অভিনেত্রী, মান্যবর ক্রোনাসের একমাত্র ভগ্নি এবং মৃত নগরপালের প্রিয়তমা স্ত্রী জোকাস্তা। জোকাস্তা ফেরেসকে ক্ষমা করলে রাজকর্মচারী কিংবা সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে আর কোনো রকম উত্তেজনা থাকবে না। জোকাস্তা এখন বিচারের রায় শোনবার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।

ক্রোনাস: কিন্তু মহানুভব রাজা, জোকাস্তা কি তার স্বামীর হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে রাজি হবে? কোনো মেয়ের পক্ষেই কি তা সম্ভব?
হলোফার: জোকাস্তা আপনার ভগ্নি। সে যে আমার কতটা প্রিয় তাও আপনি জানেন। তবুও তার হত্যাকারীকে আমি ক্ষমা করতে চাইছি একটি বিশেষ কারণে। সৈনিকরা ফেরেসের জিহ্বা কেটে নিয়েছে। ব্যাপারটার জন্য আমি কিছুটা নমনীয় হয়েছি। আপনি যদি এখন আপনার ভগ্নিকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারেন, আপনার অনুরাধে সে নিশ্চয় ফেলবে না।

ক্রোনাস: জোকাস্তা তার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসতো। কারো অনুরোধেই সে তার স্বামীর হত্যাকারীকে ক্ষমা করবে বলে আমার মনে হয় না।
হলোফার: ঠিক আছে নেস্টর, জোকাস্তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে এসো। আমরা সরাসরি তার কাছেই তার মতামত জানতে চেষ্টা করি। (নেস্টরের প্রস্থান) জেকোনেত্তা, মা হিসাবে আপনি জোকাস্তাকে অনুরোধ করে দেখুন। হয়তো ওর মন গলে যেতে পারে। ও বড় স্নেহশীলা মেয়ে। খুব ছোট থেকেই তাকে আমি চিনি। সে এই থিউসের এক গর্ব। দিউনাসাসের মন্দিরে যে একবার জোকাস্তার কণ্ঠে ক্যাটুলাসের কবিতার আবৃত্তি শুনেছে, সেই জানে সে কত বিশাল মনের অধিকারী। স্বামীর জন্য তার ভালোবাসাও ছিল বিশাল। ফেরেস তার সেই স্বামীকে হত্যা করেছে। ঘটনাটা জোকাস্তার জন্য খুবই বেদনাময়। তবুও আপনি তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে দেখুন, সে আপনার পুত্রকে ক্ষমা করতে রাজী হয় কিনা। চলবে