স্নায়ুতন্ত্র আছে উদ্ভিদেরও

শুভময় বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০২১

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে গেছেন, যে কোনো উত্তেজনায় উদ্ভিদ সাড়া দ্যায়। তার নিজের তৈরি উদ্ভিদের বৃদ্ধি পরিমাপক যন্ত্র ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ ও উদ্ভিদদেহে উত্তেজনার বেগ নিরুপন যন্ত্র ‘রেসোন্যাণ্ট রেকর্ডার’ এর সাহায্যে বহু গবেষণার পর তিনি প্রমাণ করেন, উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়েরই জীবনশৈলীর মধ্যে বহু সাদৃশ্য আছে।

সুতরাং বলা যায়, প্রাণীজীবনের ছায়া বহন করে উদ্ভিদজীবন। কিন্তু উদ্ভিদের মস্তিষ্ক, অনুভূতি ও চিন্তাশক্তির কথা হয়তো অনেকের কাছে অজানা। লজ্জাবতী লতা স্পর্শ করলে পাতাগুলো বুজে যায়। অনেক ফুলের পাপড়ি দিনের আলোয় খুলে যায় আবার রাতের অন্ধকারে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক পতঙ্গভুক উদ্ভিদ (যেমন ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ) পতঙ্গের উপস্থিতিতে অত্যন্ত দ্রুত সাড়া দ্যায় ও শিকার ধরে। এসব ঘটনাগুলো উদ্ভিদের উত্তেজনায় সাড়া দেবার সরাসরি প্রমাণ।

১৮৮০ সালে চার্লস ডারউইন উদ্ভিদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বলেন, উদ্ভিদের মূলের অগ্রভাগ বা বীজমূল উদ্ভিদের গতিপ্রকৃতি ও কাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উদ্ভিদমূল অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি অঙ্গ। জল ও খনিজ লবণ শোষণের মাধ্যমে উদ্ভিদমূল মাটিতে থাকা জলের গুণগত মান বিচার করে। উদ্ভিদদেহে জলসাম্য, পুষ্টি, বৃদ্ধি, অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য, হরমোনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করাও বীজমূলের প্রধান কাজ। অনেকটা প্রাণীদেহের মস্তিষ্কের মতো। যেমন: মস্তিষ্ক প্রাণীদেহের অগ্রভাগে থাকে ও দেহের যাবতীয় কাজকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এই বক্তব্য ডারউইন তার ‘দি পাওয়ার অফ মুভমেন্টস ইন প্ল্যান্ট’ বইতে লিপিবদ্ধ করেন। এই বইটির কথা অনেক মানুষেরই অজানা।

পরবর্তীকালে অনেক বিজ্ঞানীই উদ্ভিদের উত্তেজনায় সংবেদনশীলতার কথা বলেছেন এবং তারা অনেকেই মনে করেন, শুধুমাত্র স্পর্শ নয়, উদ্ভিদ তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে ভেসে আসা শব্দ, সুর, অনুরণন ইত্যাদির প্রভাবেও সাড়া দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্পর্শ, শব্দ, তাপমাত্রা ইত্যাদি নানা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্দীপকের প্রভাবে সাড়া দিতে গেলে উদ্ভিদের দরকার একটি উন্নত ও সক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের। উদ্ভিদদেহে স্নায়ু ও স্নায়ুতন্ত্র কোথায়? অনেক গবেষণা ও অনুসন্ধানে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য আজ আমাদের সামনে এসেছে। যেমন: উদ্ভিদদেহে কিছু বিশেষ গ্লুটামেট রিসেপ্টর জাতীয় প্রোটিন পাওয়া গেছে, যা প্রাণীদেহে ‘নিউরো-ট্রান্সমিটার’ হিসাবে কাজ করে। আশ্চর্যের কথা, উদ্ভিদদেহে পাওয়া আরও অনেক প্রোটিন (যেমন: জি-বক্স প্রোটিন) দেখা গেছে। প্রাণীদেহে নিউরো-ট্রান্সমিটারের কাজকে উদ্দীপিত করে। অর্থাৎ দেখা গেল, উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের দেহেই সাধারণ কিছু বিশেষ প্রোটিন আছে, যা স্নায়ু-সংবহনের কাজে লাগে।  

বর্তমান কালে তৈরি অতি উচ্চমাত্রায় দৃশ্য বিবর্ধনকারী In higher magnification ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা সফলভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, নিউরো-ট্রান্সমিটার জাতীয় প্রোটিনের উপস্থিতিই শুধু নয়, দুটো উদ্ভিদ কোষের মাঝে দেখা যায় পূর্ণ গোলাকার থলির মতো গঠন বা ‘সাইন্যাপ্স’। এই সাইন্যাপ্স একটি উদ্ভিদ কোষ থেকে সন্নিকটবর্তী অপর একটি উদ্ভিদ কোষে উত্তেজনা পৌঁছে দিতে পারে। এছাড়া উদ্ভিদের সংবহনতন্ত্রের ভিতরে থাকা ফ্লোয়েমকলা স্নায়ুতন্ত্রের মতোই উদ্ভিদের সারা দেহে বিস্তৃত। যা নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে, উদ্ভিদের প্রয়োজন অনুযায়ী জল ও খাদ্য পৌঁছে দ্যায়। এছাড়া উদ্ভিদ ও জীববিদ্যার ছাত্ররা জানে, উদ্ভিদে ‘অক্সিন’ বলে একরকম হরমোন পাওয়া যায়, যাকে অনেক বিজ্ঞানী ‘নিউরো-ট্রান্সমিটার’ শ্রেণির রাসায়নিক বলে মনে করেন।

জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ বনের অধ্যাপক ড. ফ্র্যানটিসেক বালুস্কা পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন, উদ্ভিদদেহে অক্সিন হরমোন বিশেষ থলির মাধ্যমে সংবাহিত হয়, ঠিক যেভাবে প্রাণীদেহে নিউরো-ট্রান্সমিটার যাতায়াত করে। কিন্তু ঠিক কীভাবে বা কোন কার্যপ্রণালিতে এই ঘটনা ঘটে, তা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। অনেক বিজ্ঞানীর মতে, উদ্ভিদের বিবেচনাবোধ খুব উন্নত। প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, প্রাণীর মতোই উদ্ভিদের সঙ্গে বহু অণুজীব ও ছত্রাকের বন্ধুত্বপূর্ণ মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং উদ্ভিদ নিজের ‘বিবেচনায়’ বুঝতে পারে কোন অণুজীব বা ছত্রাক তার জীবনধারণের কাজে আসবে। প্রতিকূল পরিবেশে উদ্ভিদের নানা প্রকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অভিযোজন দেখা যায়, যা কেবলমাত্র উন্নত ও সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্র সমন্বিত জীবদেহেই পাওয়া সম্ভব।

উদ্ভিদের সময়জ্ঞান খুব প্রখর। দিনের কোন সময়ে সে সালোকসংশ্লেষ শুরু করবে, কোন সময়ে পরাগসংযোগী প্রাণীদের আগমনে সে ফুলে ‘নেকটার’ তৈরি করবে, উদ্ভিদ তা জানে। দিনেরবেলা কোন সময় তীব্র গরম হবে, সেটা বুঝে তারা বিশেষ ‘তাপমাত্রা প্রতিরোধক ব্যবস্থা’ স্থির করে নেয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, কোনো পতঙ্গের পত্রভুক লার্ভা এসে যদি পাতা খেতে শুরু করে, তবে সঙ্গে সঙ্গে লার্ভা প্রতিরোধক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ উদ্ভিদের প্রতিটি কোষে তৈরি হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যদি উদ্ভিদকে লার্ভার পাতা খাবার শব্দ রেকর্ডিং করে তার সামনে চালানো হয়, তাহলেও লার্ভা প্রতিরোধী বিষাক্ত রাসায়নিক শীঘ্র উদ্ভিদে তৈরি হতে থাকে! বিজ্ঞানীদের অনুমান, উদ্ভিদের চাক্ষুষ কোনো ইন্দ্রিয় না থাকা সত্ত্বেও সে বাহ্যিক উদ্দীপকগুলিকে ভালোভাবেই অনুভব করতে পারে।

প্রাণীদেহে নির্দিষ্ট সময় কাজ শুরু ও শেষ হয় একটি বিশেষ ছন্দে, একে ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ বলে। উদ্ভিদদেহেও খুব স্পষ্ট ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ দেখা যায় এবং কেবলমাত্র উদ্ভিদদেহে পাওয়া বেশকিছু প্রোটিন ওই ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ নিয়ন্ত্রণ করে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত, উদ্ভিদের প্রতিটি দেহকোষের ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড বার্নাড বিশ্বাস করতেন, পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদেরও সংবেদনশীলতার পরিবর্তন হয়। তিনি উদ্ভিদের ওপর অ্যানাস্থেশিয়া প্রয়োগ করে দেখান, অ্যানাস্থেশিয়ার প্রভাবে প্রাণীদেহের মতোই উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগম, সালোকসংশ্লেষ, চলন ইত্যাদির পরিবর্তন হয়। তারা আর ওই শারীরবৃত্তীয় কাজগুলোতে সাড়া দিতে পারে না। আসলে প্রাণীর স্নায়ুকোষের মতোই উদ্ভিদের প্রতিটি দেহকোষ সমান সংবেদনশীল।

এখনও উদ্ভিদের বহু আচরণ, বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজের কলাকৌশল রহস্যাবৃত। বিশ্বজুড়ে চলছে গবেষণা। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সেগুলোর যথার্থ প্রমাণ আমরা খুঁজে পাব।