হৃদয় ছোঁয়ার দিন

উপন্যাস ৩০

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০২০

একাকী রাতে পারুলকে নিয়ে উল্টাপাল্টা ভাবনা মাথায় আসে। দেশ হয়তো একদিন স্বাধীন হবে, তখন এই ফিল্ড হাসপাতালের দরকার হবে না। তখন পারুলকে ফিরে যেতে হবে ঢাকায় কিংবা অন্য কোথাও। পারুলের সেই নতুন জীবনে ছ্টটু যদি জায়গা করে নিতে চায় তবে পারুল কি করবে? মুহূর্তের আবেগে ছটটুর পশু হয়ে ওঠাকে কি পারুল ক্ষমা করবে? স্বাধীনতা মানুষকে উদার করে। সেই উদারতায় ছটটু কি পারুলের কাছ থেকে ক্ষমা পেতে পারে না?

আর যদি দেশ স্বাধীন না হয়? সেক্ষেত্রে পারুল প্রসঙ্গ অবান্তর। দিন মাস বছর শেষ হতে থাকবে, ওদের যৌবন নিঃশেষ হবে। এই লাইট মেশিন গান তখন অনেক ভারি মনে হবে। এই দেহটাই বোঝা হবে। যুদ্ধের মাঠ থেকে নিঃশব্দে সরে পড়তে হবে। আর পরাজয়! পরাজিতকে কেউ চায় না। পরাজিতরাই ইতিহাসের ভিলেন। ভিলেনের দায়িত্ব কেউ নেয় না। তাদের কেউ মনেও রাখে না। তারচেয়ে অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের মৃত্যু। তবে ছ্টটু আগেও দেখেছে, যুদ্ধ যাত্রার সময় ওর ভেতর যুদ্ধের ভাবনা ছাপিয়ে ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোই এলোমেলো জেগে ওঠে। এতে করে নিজেকে দুর্বল আর ভীরু মনে হয়। তবে যুদ্ধ শুরুর প্রথম গুলির শব্দ কানে এলেই সব ভাবনা-দুর্বলতা কোথায় মিলিয়ে যায়! মৃত্যুভয়, আহত হওয়া কিংবা ধরা পড়ার ভয় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চোখ আর মন শুধু শত্রু খোঁজে।

দু’দিন আগে কলা-বিক্রেতার বেশে এলাকাটা ঘুরে গেছে। পাকিস্তানিদের ঘাঁটি থেকে পাঁচশো গজ দুরে কাঁচা রাস্তা সোজাসুজি চলে গেছে। রাস্তার নিচু খাদ পানিশূন্য নালার আকৃতি নিয়েছে। জিরো আওয়ারের পনের মিনিট আগে ছটটুর দলটা রাস্তার খাদে নেমে এলো। রাস্তাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে এখান থেকেই আক্রমণ রচনা করা হবে। তারেকের দলটা এখন নিশ্চয়ই পশ্চিমপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এখনই তারেকের দলের কেউ এসে যাবে। তারপরই শুরু হবে আক্রমণ। নিচু কণ্ঠে মণ্ডলকে রকেট ল্যাঞ্চার বসানোর জায়গা দেখিয়ে সে সবার অবস্থান দেখে নিল। আক্রমণের আগের এই সময়টা সবচেয়ে উত্তেজনার। সবার হাত ট্রিগারে। হাত নিসপিশ করছে। এই শীতে ঘামছে সবাই। অনেকেই এসময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, অচমকা গুলি বেরিয়ে যায়। এ ধৈর্যচ্যুতির খেসারত দিতে হয় গোটা আক্রমণে।

অনেক সময় নিশ্চিত বিজয় রূপান্তরিত হয় পরাজয়ে। আস্তে আস্তে সময় চলে যাচ্ছে। ছটটু রেডিয়াম দেয়া ঘড়ির দিকে তাকালো, জিরো আওয়ার শেষ হতে চললো অথচ তারেকের দলের কারও দেখা নেই। এখন আগবাড়িয়ে কাউকে ওখানে পাঠানো যেতে পারে, অথবা নিজে যেয়ে দেখা যায়। ছটটু ঠিক করল, আর পাঁচ মিনিট দেখে নিজেই পশ্চিম প্রান্তে যাবে। মণ্ডলকে ইশারায় ডাকল। মণ্ডল মর্টার পোস্ট ছেড়ে ছটটুর কাছে এলো। ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা এলাকা। অভ্যাস বসে ছ্টটু আর মণ্ডল দুজনেই শক্ত মাটিতে শুয়ে পড়ল। কুয়াশা ঢাকা চাঁদের আলোতে ছটটু দেখল, মটার পোস্ট বসানোর জায়গায় এখন একটি গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। মাথা উঠানোর উপায়ও নেই এখন। মাটির কিছু উপর দিয়ে শিস কেটে তপ্ত গুলির ঝাঁক ছুটে যাচ্ছে। ওরা নিঃসন্দেহে ফাঁদে পড়েছে। পরমুহূর্তে মাথার উপর ছুটে এলো ট্রেসার বুলেট। কুয়াশা ঢাকা রাত দিনের আলোর মতো ঝললে উঠল।

উত্তর আর পূব, দু’দিক থেকেই গুলি আসছে। মাথাটা একটু উঁচিয়ে হাতের এসএলআরের নল পূবে ঘুরিয়ে ছটটু ট্রিগার চাপল। মণ্ডলকে বলল, সবাইকে নিয়ে দ্রুত রিট্রিট কর। মণ্ডলের হাতের এসএলআর দেখিয়ে ছটটু বলল, ম্যাগজিনসহ ওটা রেখে যা।
মণ্ডল জানতে চাইল, স্যার আপনি?
আ, কুইক রিট্রিট... গুলির শব্দে ছটটুর কথা চাপা পড়ে যায়। মণ্ডল ক্রলিং করে মূল দলের দিকে চলে যায়। এক পলক দেখে নিয়ে ছটটু আবার ট্রিগারে চাপ দিল। ক্রলিং করে ছটটু কিছুটা সরে এলো। এখন কোনও কিছুর আড়ালে যাওয়া দরকার। বিশ গজ দুরে একটা রেইনট্রি গাছ। ওই গাছের আড়ালে যাওয়াই এখন জরুরি। নিজের এসএলআর সাথে বাড়তি এসএলআর আর ম্যাগাজিন নিয়ে থেমে থেমে গুলি চালিয়ে ছটটু ওদিকের গাছের দিকে ক্রলিং করে এগুতে লাগল। আবার ছুটে এলো ট্রেসার বুলেট। গুলির উৎস খুব কাছেই মনে হচ্ছে। নিঃসন্দেহে অর্ধচন্দ্রাকার বৃত্তে আটকা পড়েছে ওরা। আরও অন্তত পাঁচ মিনিট পাকিস্তানিদের আটকাতে পারলেই দলের সবাই নিরাপদে সরে যেতে পারবে। ছ্টটু দ্রুত ক্রলিং করে এগুতেই ডান হাঁটুর নিচে কিছু একটা এসে লাগল। চিনচিন একটা ব্যথা যেন ছড়াচ্ছে। ট্রেসার বুলেটের আলোটা মিলিয়ে যেতেই ছটটু থেমে গেল। ম্যাগাজিন দ্রুত পাল্টে ফের গুলি শুরু করল ছটটু।

চারদিক থেকেই গুলি চলছে। কোনটা শত্রুর গুলি, কোনটা মিত্রগুলি, কে জানে! থেমে থেমে, হিসাব করে ছটটু গুলি ছুড়ছে আর শরীরটা টেনে নিচ্ছে রেইনট্রি গাছের দিকে। ডান হাঁটুর নিচে চুলকাচ্ছে। ট্রিগার থেকে হাত সরিয়ে ওখানে হাত দিতে হাতে লাগল তপ্ত তরল ধারা। একটা চিনচিন ব্যথা পা থেকে উঠে এলো ঊরুতে, কোমরে বুকে গলায় তারপর মাথায়। ব্যথায় দুচোখ বুজে এলো। চোখ খুলতেই ছটটু দেখল, সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। প্রথমে চোখে এলো ঘাস। সবুজ প্রান্তর। ঘাসের ভেতর একটা লাল বৃত্ত। বৃত্তটায় হাত ছোঁয়াতেই হাতে লাগল তপ্ত তরল। মনে পড়ল, কিছুক্ষণ আগে রাতের আঁধারে এ এলাকায় একটা যুদ্ধ হয়েছিল। এখানে শুয়ে থেকেই ছটটু কিছুক্ষণ আগেও গুলি ছুড়েছিল। ওদের পুরো দলটা দ্বিমুখি আক্রমণে পড়েছিল। তারপর... মনে পড়ছে, তখন আঁধার ছিল। আকাশে কুয়াশা ঢাকা চাঁদ ছিল। তারপর আকাশে সূর্য এলো কখন, না মনে পড়ছে না।

চোখ গেল ঘাসের বুকে বসে থাকা লাল বৃত্তের দিকে। সবুজের বুকে লাল বৃত্ত। কোথায় এই সবুজ আর লাল দেখেছে! হ্যাঁ, মনে পড়ছে এটা একটা পতাকা। কিন্তু এই পতাকা এখানে এই ঘাসের বুকে কে নিয়ে এলো! ছ্টটু মাথা উঁচু করে চারদিক দেখার চেষ্টা করল। আবার একটা চিনচিন ব্যথা পা থেকে ছড়িয়ে পড়ল মাথায়। চলবে