কিছু ধ্বংস কিছু সুন্দরের জন্ম দেয়
তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসপ্রকাশিত : এপ্রিল ১৭, ২০২০
দুই বন্ধু। একজনের নাম আবুল, আরেকজনের নাম জন। দুজন পাশাপাশি গ্রামে থাকে। দুজনই ব্যবসায়ী। দুজনের মধ্যে সম্পর্কও খারাপ নয়। আবুল খুবই চালাক। খুবই মানে প্রচণ্ড চালাক। সবকিছুতেই তার চালাকি। প্রতিটি কাজকর্ম সে হিসেব নিকেশ করে চলে। এত এত হিসেব তাকে করতে হয় যে, দুই আর দুই যোগ করলে যে চার হয়, এটা করতেও তার সময় চলে যায় প্রায় সপ্তাহখানেক। কারণ সে ভাবতেই থাকে, আর ভাবতেই থাকে। সে শুধু ভাবেই, কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা! দুই এর সঙ্গে দুইকে আবার ফাঁকি দিয়ে কেউ এক সরিয়ে ফেলবে কিনা। নাকি ভুলে আবার দুই থেকে দুই-ই চলে যায়। কাউকেই সে বিশ্বাস করে না।
টাকা-পয়সা সে খুবই যত্নআত্নি করে রাখে। কাউকে দেয় না। তবে তাকে যদি কেউ টাকা দেয়, খুবই খুশি মনে সে সেই টাকা নিয়ে নেয়। টাকা নেবার জন্য সে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে, চা খাওয়ায়। মাঝে মধ্যে বাজার থেকে পান এনে পানও বানিয়ে খাওয়ায়। আর যদি বুঝতে পারে বেশি টাকা পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, তাহলে সে তার জন্য বিশাল আয়োজন করে। দেশি মুরগি জবাই করে, এমনকি বাজার থেকে তাজা দেখে রুই আর ইলিশ মাছও আনায়। কিন্তু একবার টাকাটা পেয়ে গেলে সে আর ওই টাকা তাকে কোনোদিনই নিয়ে যেতে দেয় না। খুব চাপাচাপি করলেও ম্যাক্সিমাম দশ হাজার টাকা দেয়। এর বেশি সে দেবেই না। তাও সেই বছর আর একটি পয়সাও সে তাকে ফেরত দেয় না। পরের বছর আবার ম্যাক্সিমাম দশ হাজার টাকা দেয়।
অপরদিকে ওই যে জনের কথা বললাম, সে আবার ঠিক উল্টো। সে খুব সহজ-সরল। কোনো চালাকি বা প্যাঁচ সে জানে না। আপনি তাকে অনায়াসে বিশ্বাস করতে পারেন। ধরুন, আপনার কাছে ৫০ হাজার টাকা আছে। টাকাটা নিরাপদে গচ্ছিত রাখা দরকার। আপনি যদি ওই সম্পূর্ণ ৫০ হাজার টাকা জনের কাছে রেখে আসেন, এবং কোনো একদিন হঠাৎ কোনো মধ্যরাতে তার কাছে গিয়ে বলে বসেন, আমার ৬০ হাজার টাকা দরকার, আপনার কাছে তো আমার মাত্র ৫০ হাজার টাকা রয়েছে, আর দশ হাজার টাকা এই রাতে কৈ পাব?
জন মোটেও দেরি করবে না। কিচ্ছুটি ভাববেও না। সে ঘরে গিয়ে ৬০ হাজার টাকা এনে আপনাকে দিয়ে দেবে। অথচ জন আপনাকে ঠিকঠাক চেনেও না। জন সবার সঙ্গেই এমনটা করে থাকে। এতে হয় কি, দুনিয়ার সবাই গিয়ে ওই জনের কাছেই তাদের সব টাকা রেখে আসে। মানুষ এমনও হয়েছে তার নিজের চেয়েও জনকেই বেশি বিশ্বাস করে। আর তার পরিণামে যেটা হয়েছে, দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ এখন শুধু জনের কাছেই তাদের সব টাকা গচ্ছিত রাখে। জন আবার সেই টাকা ব্যবসায়ও খাটায়। ঠাণ্ডা মাথায় সে পরিশ্রম করে। প্রচুর আয় করে এবং সেই আয় থেকে কেউ বিপদে পড়লে নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে দেয়। এবং শেষটায় জন হয়ে উঠেছে এলাকার বড় ভাই, মুরুব্বি।
অপরদিকে ওই যে আপনাদেরকে আবুলটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, সে একঘরে হয়ে বসে রয়েছে। কেউ তাকে আর বিশ্বাসই করে না। কারণ সে আসল টাকাটাও ফেরত দেয় না। সুতরাং কেউ তার কাছে টাকা রাখেও না। এমনও হয়, একবার কোনোমতে কেউ তার টাকা আবুলের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারলে সোজা আবুলকে একদলা থুথু দিয়ে দৌড়ে চলে আসে জনের কাছে। আপনাদের এতক্ষণ আবুল আর জনের গল্প বললাম। আমার এ গল্পটা কিন্তু সত্যি। কী, বিশ্বাস হলো না? প্রমাণ দেব? দিচ্ছি। জনের ভালো নাম ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ আর আবুলের অফিসিয়াল নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
আমেরিকায় সারা পৃথিবী থেকে যে-কেউ এসে কোনো বৈধ পেপারস ছাড়াই সেখানে একটা ব্যাংক একাউন্ট ওপেন করতে পারে এবং সেই একাউন্ট থেকে যে এটিএম কার্ডটি দেয়া হয় তা দিয়ে এই পৃথিবীর যে-কোন প্রান্ত থেকে যে-কোন সময় তার আসল টাকা তো তুলে নিতেই পারেই; এমনকি ৫-৭শত ডলার বেশি তুলে নিলেও আমেরিকা কিছুই মাইন্ড করে না।
এমনকি আপনি চাইলে অনলাইনে বসেও যে-কোন সময় যে-কোন স্থান থেকে ঐ একাউন্টের টাকা দিয়ে যা মন চায় তাই করতে পারবেন। কেন করছেন কি করছেন কেউ আপনাকে ফোন করেও জানতে চাবে না। অপরদিকে কোনো বিদেশি বাংলাদেশে গিয়ে দুনিয়ার বৈধ কাগজপত্র থাকলেও (রেসিডেন্ট ভিসা না থাকলে) কোনো একাউন্ট খুলতে পারবে না। একাউন্ট খুললেও সেই নিজের একাউন্টের নিজের টাকা তুলতেও তাকে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
আবার সেই বাংলাদেশের নিজ নাগরিকরাও তাদের নিজেদের কর্ষ্টের উপার্জিত টাকা বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে না। বছরে মাত্র ১০ হাজার ডলার, তাও যদি নিজে বিদেশে যায় তাহলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে। সুতরাং পরিণামে যেটা হয়, এই বাংলাদেশের মানুষও বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না। তারা টাকা-পয়সা সুযোগ পেলে হুন্ডি করে হলেও ঐ আমেরিকা বা কানাডায় নিয়ে যায়। কেউ কেউ একাউন্ট খুলে সুইচ ব্যাংকে। কানাডায় তৈরি হয় বাংলাদেশিদের টাকায় ‘বেগম পাড়া’। আর মালয়েশিয়াতে হয় ‘সেকেন্ড হোম’।
কারণ সারা পৃথিবীর মানুষ আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ডকে বিশ্বাস করে; সকলে জানে এরা তার টাকা ফেরত দেবে যখন দরকার তখনই। কিন্তু বাংলাদেশ টাকা ফেরত দেবে না। আর আবুল সারাক্ষণ শুধু তার ‘টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে চিন্তায় মগ্ন থাকে’। তার রিজার্ভ লুট হয়। তার রিজার্ভ হ্যাকিং হয়। তার সেন্ট্রাল ব্যাংকের ১২ হাজার কোটি টাকা লাপাত্তা হয়ে যায়। তারপরও তার দেশের জনগণ নিজেদের টাকা নিজেরা জরুরি দরকারেও বাইরে নিতে পারে না।
আমোরকারই একটা অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থার নাম ‘পে-পল’ যার ব্যাপ্তি বিশ্বব্যাপী। পে-পল ক্রস বাউন্ডারী ব্যাংকিং করে। অর্থাৎ পে-পল দিয়ে এই পৃথিবীর এক প্রান্তের টাকা মুহূর্তে অন্য প্রান্তে ট্রান্সফার করা যায়। পে-পল শতভাগ নির্ভরযোগ্য। প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হচ্ছে শুধুমাত্র এই পে-পল দিয়ে। কিন্তু পে-পল বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না।
পে-পল জানে বাংলাদেশ থেকে টাকা ফেরত নিয়ে আসা যাবে না, বাংলাদেশ শুধু টাকা নিতে জানে; সুতরাং তারা বাংলাদেশকে এলাউ করে না। বাংলাদেশ পে-পলে কোন একাউন্টও করতে পারে না। এই হলো আবুলের গল্প। আবুলরা যুগে যুগে আবুলই থেকে যায়। তাদের আবুল হয়ে থাকতেই ভালো লাগে। এই সব আবুলরা আবার পিএইচডি ডিগ্রি নেয়, আমেরিকায় পড়াশোনাও করে, কেউ কেউ স্কলার্সও। কিন্তু তারা জনের কাছ থেকে কিছুই শিখে না। শুধুই ২ আর ২ নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর খুঁজতে থাকে একটা টাকাও যেন বাইরে চলে না যায়। দেশের টাকা দেশে রাখতে হবে। এভাবেই আবুল একদিন আরও বড় আবুল হবে।
আবার আমার মতো কেউ কেউ সেই আবুলকে ফুটবলের মতো লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অমান্য করে বর্বর আইনকে, বর্বর রাষ্ট্রকে। আমি বিশ্বাস করি, আমার দলে লোক আস্তে আস্তে একদিন বাড়বেই। মানুষ তার নিজের ভালোটা বুঝবে না, এটা হতে পারে না। আবুলের আবুলীয় সংবিধান ধ্বংম না করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষ ওই ‘আবুল’ এর হাত থেকে রেহাই পাবে না। বাইরের সুন্দর চাকচিক্যময় করিৎকর্মা আর মেধাবী বিশ্বকে দেখতেও পাবে না। মাঝে মধ্যে কিছু ধ্বংস কিছু সুন্দরের জন্ম দেয়।
























